মৃদু বাতাসে দোল খাওয়া ফিনফিনে লাল স্বর্গীয়, রেশমের মত মসৃণ; কমনীয় ও মোহময় পপি ফুল। সেই ফুলের নীচে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে কন্ঠমণির মত সবুজ রঙা বীজাধার। ধরণীর বুকে শীতলতা নেমে এলেই কেবল পরিপুষ্ট হয় সেই ফল। এরপর এক শীতের বিকেলে সুঁচালো ছুড়ি দিয়ে তাঁর মসৃণ গায়ে আঁচড় কেটে দেয় কৃষাণ কৃষাণী। সেই ঘা থেকে রাতভর বিন্দু বিন্দু করে ক্ষরিত হয় শ্বেতরক্ত। ভোরের প্রথম সূর্যকিরণের স্পর্শে ঘটে যায় জারণ বিজারণ, শ্বেতরস রঙ পালটে হয়ে যায় কালচে বেগুনী; যা চেঁছে নিলেই পাওয়া যায়- দ্যা মিল্ক অফ প্যারাডাইস, যাকে আমরা আফিম হিসেবে জানি।
ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে যদিও স্পষ্টভাবে কিছু বলা নেই তবে আমার প্রায় সময়ই মনে হয় এডাম আর ইভ বোধ হয় স্বর্গে বসে এই আফিম ফলই চেখেছিলেন, যে কারণে স্রষ্টা তাঁদের উপর নারাজ হয়েছিলেন। এটাই গন্ধম হোক বা না হোক, এডাম ও ইভ এই ফল খেয়ে থাকুক বা না থাকুক, ইতিহাসের একদম শুরু থেকেই যে এই ফলটি ছায়ার মত মানুষকে অনুসরণ করে যাচ্ছে সেটা তো মানতেই হবে। শুধু জ্ঞানবুদ্ধির ধারক ও বাহক হোমো সেপিয়েন্সই নয়, এই ফলের মোহ থেকে নিয়ান্ডারথালরাও দূরে ছিল না। প্রত্নতাত্ত্বিকভাবেই আজ প্রমাণ করা যায় প্রায় ত্রিশ হাজার বছর আগে থেকেই মানুষ আফিম ব্যবহার করে আসছে। সুমেরীয়, এসিরীয়, মিশরীয়, গ্রীক, রোমান, আরব, ভারত, ইউরোপ, চিন সুপ্রাচীন সব সভ্যতাই এর নেশায় চুর হয়ে ছিল, আছে আর ভবিষ্যতেও থাকবেই!
আফিমের সাথে আমার প্রথম পরিচয় একেবারে ছোটবেলায়। আমার বোন উপহার দিয়েছিল ‘নীল কোমল’। হোস্টেলের বিছানায় শুয়ে কাথার নিচে টর্চ লাইট জ্বালিয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম কলোনিয়ান সাংহাইয়ের আফিমখানায়। টিনটিন যেহেতু আফিমের বিরুদ্ধে লড়াই করে তাই তখন থেকেই মাথায় গেঁথে গিয়েছিল যে এটা খারাপ জিনিস। কিন্তু সেই সাথে তখন থেকেই নিষিদ্ধ কৌতূহলও যে জাগেনি সেই কথা জোর করে বলতে পারিনা। তখন কি আর জানতাম তার অনেক বছর পর খোদ আমি কোন একদিন এমন এক আফিমের সাম্রাজ্যে গিয়ে হাজির হব আর এত কাছ থেকে এই নীল নীল স্বপ্নময় দুনিয়ার হালচাল দেখতে পাব? আমার সেই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রার গল্প পরে একসময় বলা যাবে, আপাতত আমরা উপনিবেশিক বাংলার সাথে আফিমের সম্পর্কের ঐতিহাসিক পটভূমিটা একটু জেনে আসি।
পপি ফুল ভারতবর্ষের স্থানীয় প্রজাতি না। আনাটোলিয়া (স্পেন), তুরষ্ক ও পারস্য হয়ে ভারতবর্ষে এটি প্রবেশ করেছে। ঠিক কবে আর কাদের হাত ধরে আফিম এসেছে এটা সঠিকভাবে বলার এখন আর কোন উপায় নেই। কারও ধারণা আরব বণিকরা ব্যথানাশক হিসেবে আফিম এদেশে নিয়ে এসেছিল। আবার কেউ বলে বাদশা সিকান্দারের হাত ধরে এদেশে আফিম এসেছে। যাদের মাধ্যমেই এসে থাকুক না কেন, গাঁজার সাথে পাল্লা দিয়ে আফিম এক পর্যায়ে ভারতবর্ষের সমস্ত স্তরে নিজের জায়গা করে নিতে পেরেছিল। মোগল আমলে রাজ দরবার থেকে শুরু করে সৈণ্য সামন্ত, অভিজাত শ্রেণী, দিন মজুর, চাষি সর্বক্ষেত্রে আফিম সেবনের প্রচলন ছিল। আফিম সেবন আমাদের সাংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছিল। দিন মজুর ও কামলারা সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর দিন শেষে দাওয়ায় বসে একটু আফিম সেবন করত। এতে তাঁদের শরীরের ব্যথা বেদনা প্রশমন হত, রাতে আরামের ঘুম হত, সকালে তরতাজা হয়ে আবার কাজে নামতে সুবিধা হত। অন্যদিকে সম্ভ্রান্ত শ্রেণীদের মধ্যে আফিম সেবন ছিল আভিজাত্যের ব্যাপার। অতিথি আসলে আফিম দিয়ে আপ্যায়নের চল ছিল তখন। এখনও যেমন জর্দা পান ছাড়া কোন অনুষ্ঠানের খাওয়া দাওয়া সম্পূর্ণ হয় না, তখনকার দিনে আফিম ছাড়া অতিথি সৎকারের কথা ভাবা যেত না। আফিমের এমন সার্বজনীন ও বহুল ব্যবহার দেখে মোগলরা এর উপর আবগারি শুল্ক আরোপ করে এর থেকে বিপুল অর্থ আয় করতে থাকে।
ভারতের উর্বর জমিতে তখন থেকেই পপি খুব ভালো জন্মাতো। ১৬শ শতকে ইউরোপিয়ান বেনিয়ারা ভারতে অন্যান্য পন্যের সাথে আফিমের বানিজ্যও শুরু করে। প্রথমদিকে পর্তুগীজরা পরবর্তীতে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারত থেকে আফিম সংগ্রহ করে তা পশ্চিমে সরবরাহ করা শুরু করে। বানিজ্যের ফলে চাহিদা বেড়ে যায় বহুগুন সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে পপি চাষ। বক্সারের যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অরাজকতা ও দৌরাত্ম্যে অন্যান্য দেশ পিছু হটে যায়, ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষের মত আফিম বানিজ্য একচেটিয়া দখল করে নেয়।
ব্রিটিশদের আফিম ট্রেডের মডেল নীল চাষের মতই ভয়াবহ ছিল, কিন্তু শতগুন বড় স্কেলে। ব্রিটিশ বেনিয়ারা সাধারণ চাষিদের আফিম চাষে বাধ্য করত। এর জন্য চাষিদের অগ্রীম কিছু টাকা দাদন হিসেবে দেয়া হত। নগদ কিছু অর্থ হাতে পেয়ে চাষিদের সাময়িক কিছু সুবিধা হলেও তারা চিরদিনের জন্য গোলামির চক্রে আবদ্ধ হয়ে যেত। দাদন নেয়া চাষিদের বাধ্যতামূলকভাবে বেনিয়াদের নির্ধারন করা দামে আফিম সরবরাহ করতে হত। উৎপাদিত আফিমের বিনিময়ে চাষিরা যেই দাম পেত, অগ্রীম নেয়া দাদনের সাথে এডজাস্ট করে তাঁদের কোন লাভই থাকত না। দুইবেলা ভাত খেতে বাধ্য হয়ে তাঁদের আবার দাদন নিতে হত। কেউ ঠিকঠাকভাবে পণ্য সরবরাহ করতে না পারলে সেপাই পেয়াদা দিয়ে উত্তম মাধ্যম দেয়া হত, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হত। যত ধরণের ভয় ভীতি অত্যাচার নিপীড়ন সম্ভব- বাই এনি মিনস নিরীহ কৃষকদের আফিমের ফাঁদে আঁটকে রাখা হত। এভাবেই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রায় বিনামূল্যে ভারতবর্ষ থেকে টন কে টন আফিম সংগ্রহ করত। ভারতের বিহার, উড়িষ্যা, নদিয়া, অধুনা বাংলাদেশের যশোর, কুষ্টিয়া পরিনত হয়েছিল আফিম উৎপাদনের প্রাণকেন্দ্র। পাটনায় তৈরী করা হয়েছিল বিশাল আফিম শোধনাগার।
পাটনার ফ্যাক্টরিতে তৈরি হওয়া আফিমের দলা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর উৎকৃষ্ট মানের জন্য জনপ্রিয় হয়ে যায়। সেই আফিমের নাম হয়ে যায় ‘বেঙ্ল মাড’। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার চাষিদের উৎপাদিত আফিম পাটনার শোধনাগার থেকে কাঠের পেটিতে ভরে চলে আসত কোলকাতা। কোলকাতার আলিপুরে ছিল অপিয়াম অকশন হাউজ। এখানেই বেঙল মাডের নিলাম ডাকা হত। এখন যেমন সিলেটের চায়ের নিলাম হয় চট্টগ্রামে। সে রকম আফিমের নিলাম। এখান থেকেই আফিম কিনে ব্রিটিশ কোম্পানির সাহেবরা পাড়ি দিত চিনে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এই ব্যবসা নিয়ন্ত্রনের জন্য একশ্রেণীর দালাল নিয়োগ দিয়েছিল। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত দালাল ছিলেন দ্বারকানাথ ঠাকুর। আফিম বোর্ডের দেওয়ান পদে চাকরী করতেন তিনি। চাকরির পাশাপাশি উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া জমিদারিতে আফিম চাষের প্রচলন করেন। কোম্পানি থেকে দাদন বাবদ উনি একটি কমিশন তো পেতেনই তাঁর উপর চাষিদের ভাগ থেকেও একটা অংশ মেরে দিতেন। অল্প দিনের মধ্যেই দ্বারকানাথ ঠাকুর বিপুল অর্থের মালিক বনে যান। এরপর লবন ও আফিম ব্যবসায়ে লগ্নি করার পাশাপাশি মহাজনি কারবার শুরু করেন। অভিযোগ আছে অন্যান্য ব্যবসায়ী ও দালালদের সুবিধা পাইয়ে দিতে তিনি উৎকোচও নিতেন। ঘুষ নেয়ার অভিযোগে একবার তাঁর নামে কোম্পানির কোর্টে মামলাও উঠেছিল, যদিও সেটি প্রমাণ করা যায়নি। নিজের জাত নিয়ে সবসময় ইনফেরিওর কমপ্লেক্সে ভোগা দ্বারকানাথ কুলীন সমাজে প্রবেশে সুবিধা হবে ভেবে আরও বিত্তশালী হবার চেষ্টা চালিয়ে যান। কোম্পানীর শেয়ার কিনে লগ্নি করেন, জাহাজ কিনে সরাসরি বানিজ্যে নামেন, অতঃপর একটি ব্যাংকও খুলে বসেন। কোম্পানীর চাকরী, কোম্পানীর কমিশন খেয়ে নিজের জমিদারিতে আফিম চাষ, সেই আফিম নিজেই নিলামে কিনে নেয়া, নিজের জাহাজে করে সেই আফিম হংকং-ক্যান্টন-সাংহাই বন্দরে বিক্রি করা- এভাবেই গুটি কয়েক দ্বারকানাথ ঠাকুরদের সাহায্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর আফিম মনোপলি এক অন্য মাত্রায় চলে গিয়েছিল।
নামমাত্র মূল্যে আফিম সংগ্রহের ক্ষেত্র তো এভাবে প্রস্তুত হয়ে গেল। এখন এই আফিম বিক্রি করার বাজারও তো দরকার, তা নাহলে তো আর ব্যবসা হবে না। এখানে আবার ব্রিটিশদের খুব মজার একটা স্ট্যান্ড ছিল। তারা স্থানীয় বাজারে আফিম ছেড়ে মোগলদের মত আবগারী শুল্ক আদায়ে খুব একটা আগ্রহী ছিল না। বরং তারা স্থানীয়দের আফিম সেবনে একপ্রকার নিরুৎসাহিতই করত। একপর্যায়ে স্থানীয়দের আফিম সেবন বন্ধ করার উদ্দেশে ব্রিটিশরা অপিয়াম অ্যাক্ট নামে একটি আইনও পাশ করেছিল। ব্রিটিশরা দাবি করে, ভারতবর্ষের ত্রাতা হিসেবে স্থানীয় বাজারে আফিমের বিক্রিকে তারা অনৈতিক হিসেবে দেখত। কিন্তু এরাই আবার চায়নায় আফিম রপ্তানি করাকে তাঁদের অধিকার মনে করত। কী ভন্ডামি ! আসল কথা হচ্ছে চাইনিজদের মত, ভারতীয়রাও যদি আফিমের নেশা সারাদিন চূড় হয়ে থাকত তাহলে এত সস্তায় এত সহজে এত সংখ্যায় শ্রমিক মজুর পাবে কোথায়? পুরো বানিজ্যে এরাই তো ছিল মূল চালিকাশক্তি! তাই ব্রিটিশরা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ বাজার চাইনিজদেরই নেশাখোর বানানোর কাজে তাঁর সর্বশক্তি নিয়োগ করে দিল।
ঐতিহাসিকরা বলেন অষ্টাদশ শতাব্দীর চিন সাম্রাজ্য ব্রিটেন ও তাঁর সকল উপনিবেশের চাইতে বেশী সম্পদশালী ছিল। তবে দুটি দেশের মধ্যে একটি বিষয়ে খুব মিল ছিল, সেটা হল আসক্তি। চাইনিজরা আসক্ত ছিল বা বলা ভাল তাঁদের আসক্ত করা হয়েছিল আফিমে। আর অন্যদিকে ব্রিটিশরা আসক্ত ছিল চায়ে। চায়নার সাথে বানিজ্য শুরুর পর থেকে ব্রিটিশদের জন্য চা একটি অপরিহার্য পণ্য হয়ে উঠেছিল। বিয়ার ও শেরি ছেড়ে বিত্তবান থেকে শুরু করে গড়পড়তা আম ব্রিটিশ সবাই চায়ের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছিল। কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির একটি গবেষণা মতে, সেই সময় প্রতিটি ব্রিটিশ পরিবার তার আয়ের শতকরা পাঁচ ভাগ চায়ের পিছনে খরচ করত।
সাধারণভাবে বানিজ্যের একটি সরল হিসেব হল আমি যদি কোন পণ্য আমদানি করি তাহলে এর বিনিময়ে অন্য আরেকটি পণ্য রপ্তানি করব। কিন্তু চায়নার সাথে বানিজ্য করতে গিয়ে নাক উঁচু ব্রিটিশদের হল সম্পূর্ণ অন্যরকম অভিজ্ঞতা। প্রথমত, চায়নার সাথে বাণিজ্য করার অনুমতি পাওয়াই ছিল মুশকিল। সেই সময়ে চায়নার মেইনল্যান্ডে বিদেশিদের প্রবেশাধিকার ছিল না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে সম্রাটদের হাঁটু গেড়ে কুর্নিশ করে করে তারা বাণিজ্য করার অনুমতি আদায় করে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি জাহাজ ভর্তি করে চা, পোর্সেলিন ভাসের মত পণ্য আমদানি করতে থাকে। কিন্তু এর বিপরীতে চায়নায় কোন পণ্যই তারা রপ্তানী করতে পারে না। কারণ সেই সময়কার চায়না প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল। ব্রিটিশদের কোন পণ্যের প্রতিই চিনাদের আগ্রহ ছিল না। ফলে এই বিপুল পরিমানের চা ব্রিটিশদের বাধ্য হয়ে রৌপ্য মূদ্রার বিনিময়ে কিনতে হত। একপর্যায়ে অসম বানিজ্য এমন আকার ধারণ করে যে ব্রিটেনের চায়ের নেশা মেটাতে রৌপ্য মুদ্রার মজুত সব চায়নার রাজকোষাগারে চলে যেতে থাকে।
এই সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসে ভারতের তৎকালীন বড়লাট ওয়ারেন হেস্টিংস। চায়না বন্দরের চোরাকারবারি ও স্থানীয় মাফিয়াদের সাথে আগে যোগাযোগ করা হয়। প্রথমদিকে ব্রিটিশরা বিনামূল্যে তাঁদের কাছে আফিম সরবরাহ করে। জাহাজ ভর্তি করে আফিমের চালান বন্দরের দূরে এসে ভিড়ত, জাহাজ খালাস করত সাংহাই-এর মাফিয়ারা। তারপর ডিঙি নৌকো চড়ে আফিম পৌঁছে যেত চিনের মূল ভূখন্ডের ঘরে ঘরে। বন্দরের শুল্ক কর্মকর্তাদের মুখ বন্ধ করা হত ঘুষ দিয়ে। উৎকৃষ্ট মানের বিনামূল্যের ভারতীয় আফিমে ভেসে গিয়েছিল চিনা ভূখন্ড।
জাতির অধঃপতন ঠেকাতে চিনা সম্রাট আফিমের চোরাচালান বন্ধের কঠোর নির্দেশ দেন। বন্দরগুলোতে নিয়োগ দেয়া হয় সৎ ও যোগ্য প্রশাসক। সেই প্রশাসকের নাম ছিল লিন সে সু। একবার লিন তল্লাশি চালিয়ে ২০ হাজার ব্যারেল আফিম ব্রিটিশ জাহাজ থেকে জব্দ করে নষ্ট করে ফেলে। প্রভুত ক্ষতি হওয়াতে ব্রিটিশরা এতে ক্ষেপে যায়। রীতিমত পার্লামেন্টে বিল পাশ করে ব্রিটেন চিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করে। ততদিনে ভারতে লুঠ করে আর চিনে আফিম বেঁচা অর্থে ব্রিটিশদের নৌশক্তির কোন তুলনা ছিল না। ব্রিটিশ যুদ্ধ জাহাজ আর ভারতীয় সেনাদের হামলায় চিনারা যুদ্ধে হেরে যায়। ফলস্বরুপ চিনাদের অপমানজনক নানকিং ট্রিটিতে সই করতে হয়। এই চুক্তি আওতায় চীন নষ্ট করে দেয়া সব আফিমের ক্ষতিপূরণ দিবে, এই যুদ্ধ করতে ব্রিটিশদের যেই খরচ হয়েছে তা পরিশোধ করবে, সেই সাথে হংকংকে ৯৯ বছরের জন্য ব্রিটেনের কাছে বিনামূল্যে লিজ দিতে বাধ্য থাকবে।
সব মিলিয়ে সেই সময় চীনের কাছ থেকে মোট ২১ মিলিয়ন ডলার মূল্যের ক্ষতিপূরণ আদায় করেছিল ব্রিটেন। কিন্তু এই চুক্তিতে আফিমের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এরপরেরো চীনে আফিম নিষিদ্ধ ছিল। যা কারণে কয়েক বছর পর ব্রিটেন আবার চায়নায় হামলা চালায়। শুরু হয় দ্বিতীয় আফিম যুদ্ধ। এইবার ব্রিটেনের সাথে ফ্রান্স ও আমেরিকার মত পরাশক্তিগুলোও যোগ দেয়। এবারও চায়না যুদ্ধে হেরে যায়। ক্যান্টন সাংহাইয়ের মত আরও পাঁচটি বন্দরে তারা অবাধ বাণিজ্যের দখল নিয়ে নেয়। এবার ব্রিটেন আর আগের ভুল করেনি। এইবার চুক্তিতে অবাধ আফিম বাণিজ্যের বৈধতা আদায় করে নেয়। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে গোটা চিনজা্তিকে নেশাখোর বানিয়ে ফেলেছিল ইংরেজরা। ধারণা করা হয় সেই সময়ে চায়নার প্রায় ত্রিশ শতাংশ মানুষ আফিমে আসক্ত ছিল। এর মধ্যে বেশীরভাগই ছিল যুবক। আফিমের প্রভাবে চীনে মারা যায় কয়েক লক্ষ মানুষ। শেষ হয়ে যায় চিনাদের কর্মশক্তি। ভারতীয় আফিমের নেশায় বুঁদ হয়ে নষ্ট হয়ে যায় একটি আস্ত প্রজন্ম। মোরাল গ্রাউন্ডে অনেক কন্ট্রোভার্সি থাকতে পারে তবে এই কথা অনায়াসে বলা যায় যে, ১৯৪৮ পরবর্তী সময়ে কমিউনিশট বিপ্লব ও ৫০ দশকে নিষ্ঠুরতম সাংস্কৃতিক বিপ্লব না হলে চায়না হয়ত আজও আফিমের নেশায় চুর হয়েই থাকত।
এরপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এল, উপনিবেশ আমল শেষ হল, সেই সাথে ভারতীয় আফিম বানিজ্যেরও সমাপ্তি ঘটল। কিন্তু বাংলার আফিমের গল্প যেখানে শেষ, সেখান থেকেই আরেকটি নতুন গল্প শুরু। বাংলার আফিমের গল্প বলতে গিয়ে এত এত ইতিহাস কপচানোকে ধান ভানতে শীবের গীত মনে হতেই পারে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা পুরোপুরি বুঝে উঠার জন্য অতীতও একটু ঘুরে আসা জরুরি। কারণ কথায় আছে না, হিস্টরি রিপিটস ইট সেলফ। এ কারণেই দ্বারকানাথের অবতারনা করতে হল। সেই আমলের দ্বারকানাথের সাথে এই আমলের বদির আদতে কোন পার্থক্য নেই। উৎপাদক-সরবরাহকারী-ভোক্তার চক্র বুঝাতে ও আফিম ট্রেডের ভুক্তভুগী হিসেবে চায়নার প্রসঙ্গটাও তাই স্বাভাবিকভাবে লেখায় চলে এসেছে।
আফিম রহস্যের সমাধান সহজ কোন বিষয় নয়। কেউ কেন আফিম সেবন করে, কিভাবে এর প্রতি আসক্ত হয়, কেউ কেন আফিম চাষ করে, কেউ কেন আফিম চাষ করায়, কিভাবে এর কেনাবেচা হয়, কোন সরকার চাইলেই কি এখন আফিম ট্রেড চিরতরে বন্ধ করতে পারে,সেই সাথে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, ভাষা, সংস্কৃতি, স্বাধীনতা ও যুদ্ধের মত জটিল কিছু বিষয়ও এর সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত। এই নীল বিভ্রমের পরবর্তী পর্বে আমরা এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করব।
9 Responses
অদ্ভুদ ঘোর লাগা এক সময়ের চিত্রায়ন দেখলাম মনে হলো লেখা পড়তে পড়তে। ধন্যবাদ আপনাকে। অসাধারন লেখনী।
ধন্যবাদ।
খুব সুন্দর প্রতিবেদন ।
ধন্যবাদ।
ইতিহাস কপচানো মোটেও ধান ভানতে শিবের গীত মনে হয় নাই। খুব উপভোগ করে পড়লাম পুরো লিখাটা। পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ। পরবর্তী পর্বটি এ মাসেই প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে।
এত্ত বড় ইতিহাস জড়িয়ে আছে আফিম কে ঘিরে, অবিশ্বাস্য লাগছিল পড়তে পড়তে , কেমন একটা ঘোরলাগা ইতিহাস..
অসাধারণ লিখা ভাইয়া।💜
ধন্যবাদ 🙂