দুইদিন ধরে হাসপাতালে দৌঁড়াতে হচ্ছে। বড় চাচাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে। সবার মন এমনিতেই ভালো নেই। কিভাবে এই অবস্থার মোকাবিলা করব বুঝে উঠতে পারছি না। তার উপর হাসপাতালের গেইট দিয়ে ঢুকার সময় যে পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে সেটা সহ্য করা আমার কর্ম নয়। রাস্তা থেকে আই.সি.ইউ পর্যন্ত যেতে রীতিমত তিনবার চেকিং করা হয়। প্রতিবার একই জিনিসের পূর্নাবৃত্তি, অযথা সময়ক্ষেপন।
এরপর আবার আমার সাথে একটা ব্যাগ ও থাকে সবসময়। সেই ব্যাগে আমি দুটা বই নিয়ে আসছি। প্রতিবারই ব্যাগ খুলে বই গুলো বের করা হয়। ব্যাগ থেকে বই বের হতেই পাশে বসে থাকা পুলিশ উঠে এসে বইয়ের পাতা উলটে যেতে থাকে। নিজের নিরাপত্তার স্বার্থেই ধৈর্য্য ধরে সহযোগীতা করে যাই। বিরক্ত লাগলেও জানি এটার দরকার আছে। আবার ভাবি আজকাল বই নিয়ে ঘুরতেও অনেক কিছু ভেবে ঘর থেকে বের হতে হবে। আজকে আমার ব্যাগে কাঞ্চনজঙ্ঘার জায়গায় ধর্মত্বত্তের উপর লেখা কোন বই বা ধর্মীয় কোন গ্রন্থের ছবি ওয়ালা কোন বইও থাকতে পারত। তখন কি আইন শৃঙ্খলার রক্ষাকারী বাহিনী যারা গেইটে গেইটে আমাদের চেকিং করছেন তারা কি ব্যাপার টাকে স্বাভাবিকভাবেই নিত…নাকি আমি সন্দেহের কাতারে পড়ে যেতাম?
দেশের অবস্থা ভালো না… !!!
সব জায়গায় কেমন একটা সন্দেহ আর আতংকের কালো মেঘ জমে আছে। কেন এমন হচ্ছে, কিসের মায়াজালে আটকে গিয়ে উঁচু স্তরের বাসিন্দা শিক্ষিত(!) এই তরুনরা এমন পথে নামতে প্রভাবিত হচ্ছে। এইসব হাবিযাবি চিন্তার মাঝেই খবরে দেখলাম মহাশ্বেতা দেবী মারা গেছেন। মনে পড়ে গেল তার অমর রচনা ‘হাজার চুরাশির মা’ সুজাতার কথা কথা। তার সন্তান ব্রতীর কথা।
নকশাল আন্দোলনের পটভূমি্তে লেখা এই উপন্যাস টি আসলে কোন বিষয় টাকে ফোকাস করেছে আলাদা ভাবে কখনো সেটা বুঝে উঠতে পারিনি। মাঝে মাঝে মনে হয় এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস, যেখানে খুব সুক্ষ্ণভাবে তিনি তার রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরেছেন। আবার কখনো মনে হয় একটি সামাজিক উপন্যাস, যেখানে সমাজে বিদ্যমান নানা শ্রেনীর মানুষদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক, টানাপোড়ন, পার্থক্য আর সংঘাত টাকেই তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন।
পরিবারের শান্তশিষ্ট চুপচাপ থাকা ছেলেটি একদিন নকশাল আন্দোলনে্র সাথে জড়িয়ে পড়ে। কোলকাতার সেই উত্তাল সময়ে পুলিশের হাতে একদিন ধরা পড়ে যায়। রাজনৈতিক মতবাদ ও ক্রিয়াকলাপের জন্য ব্রতীসহ অন্যান্য অসংখ্য তরুনকে নির্দয়ভাবে হত্যা করা হয়। একদিন খবর আসে মর্গ থেকে তার ছেলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সুজাতা মর্গে গিয়ে দেখেন তার ছেলের নাম হারিয়ে গেছে সংখ্যার ভিড়ে। মর্গে ব্রতীর লাশের নম্বর হাজার চুরাশি।
লেখাপড়ায় ভালো সমাজের ঝলমলে জায়গায় বসবাস করা ব্রতী কিভাবে জড়িয়ে পড়েছিল নকশাল আন্দোলনের সাথে? আসলেই কি তারা সমাজকে সুস্থ করার জন্যই ঝাপিয়ে পড়েছিল এই আন্দোলনে? সমাজের অসুস্থতা দূর করার নামে শ্রেণী শত্রু খতম করে দেয়ার জন্য কোন জিনিস টা তাদের প্রভাবিত করেছিল। নাকি বলা উচিত ব্রেইন ওয়াশ করেছিল??
এইসব উত্তর খুঁজতেই একদিন পথে নেমে যান ব্রতীর মা সুজাতা। তিনি এক মায়ের দৃষ্টিতে অন্বেষন করেন তার ছেলে কেন এমন করল।
সমাজের উঁচু স্তরের বাসিন্দের এক্সট্রা প্রিভিলেজড সন্তানরা কেন এই ধরনের বিপথে পা বাড়াচ্ছে সেটা ব্যাখ্যা করা আমার পক্ষে সম্ভব না। আমার তো মাথাতেই আসেনা কিভাবে এই ছেলে গুলো এমন সব চিন্তা মাথায় ঠাঁই দিতে পারে। কিসের এত অস্থিরতা তাদের আর কোন জিনিস টা থেকেই বা তারা মুক্তি পেতে চাইছে।
সব কিছুর পর একটাই জিনিস আমার আমার মনে হয়। এই সব ঝামেলার পিছনে যতটা না আইডিওলজি বা ইজম দায়ী তার চাইতে কয়েকগুন বেশী দায়ী আমাদের মধ্যে চলমান পারস্পরিক অস্থিরতা। বস্তুগত জিনিসপত্রের লোভ আর মোহের জালে আমরা আটকে গেছি। এখন কোন কিছুর সাথেই আমাদের আর মেন্টাল এটচমেন্ট নেই।
আমি তো এখন পর্যন্ত এমন কোন আইডিওলজি দেখলাম না যেখানে উগ্রপন্থার স্থান নেই। হোক সেটা সামাজিক, রাজনৈতিক আর্থিক বা ধার্মিক। পৃথিবীর সব কটি (আমার জ্ঞান যতটুকু) আইডিওলজি/ইজম/তত্ত্ব ব্লা ব্লা…সব কিছুর মধ্য থেকেই উগ্রপন্থা জন্ম নিতে পারে।
সব কিছু নির্ভর করে পারসপেক্টিভের উপর। আমার বিশ্বাস মানুষের মধ্যে ভালো-খারাপ দুটাই সমানভাবে বিরাজ করে। কারো কারো ক্ষেত্রে সেটা ইকুইলিব্রিয়াম স্টেজে থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে ভালো ডমিণেটিং হয় আর খারাপ দিকটা রিসেসিভ থাকে। কারো কারো ক্ষেত্রে খারাপ দিক টা ডমিনেট করে।
আমাদের মধ্যকার অস্থিরতায় খারাপ দিক টা একটিভ হয়ে উঠছে। দিন দিনি আমাদের মধ্যকার পশুটাকে জাগিয়ে তুলছে। আর এটাই আশংকার বিষয়।