সীমান্তের শেষ বসতি

চিনি ছাড়া গাঢ় লিকারে চুমুক দিচ্ছি আর পাড়ার মুরুব্বিদের উত্তেজিত কথোপকথন মনযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছি। বম ভাষার বাক্যালাপ পুরোপুরিভাবে বুঝতে না পারলেও সকলের অসন্তোষ বুঝতে কোন সমস্যা হচ্ছে না। এমন একটি জটিল ও উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে বসে আমি তখন মুগ্ধ হয়ে ভাবছি বান্দরবানের দুর্গমে বসবাসকারী পাহাড়ি জাতিগোষ্ষ্ঠিদের সামাজিক রীতিনীতি কতই না চমৎকার। কিভাবে কোন সমস্যার উদ্ভব হলে তারা সম্মিলিতভাবে সেটা মোকাবেলা করেন। পাহাড়ে কোন নেতা এককভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় না। এখানে সকলে মিলে আলোচনায় বসে, যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে সকলের জন্য ভালো হবে এমন একটি মিমিংসায় আসার চেষ্টা করে। এটাই হয়ত অংশগ্রহণমূলক গনতন্ত্রের প্রকৃত উদাহরণ। আমি মনে মনে শুধু দোয়া করছিলাম তাঁদের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত যেন আমাদের পক্ষেই যায়। 

বম জাতিগোষ্ঠি অধুষ্যিত ছিমছাম এই পাড়াটির নাম চাইক্ষ্যং। মায়ানমার সীমান্ত লাগায়ো বাংলাদেশের একেবারে শেষ মানব বসতি। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২১৪০ ফিট উচ্চতায় মদক পর্বতশ্রেণীর ঠিক ঢালেই পাড়াটির অবস্থান। চাইক্ষ্যং থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে মায়ানমার সীমান্তের ওপাড়ে রয়েছে আরেকটি পাড়া। সেই পাড়াটির নাম পিক্ষ্যং। উপনিবেশিক বেনিয়াদের একে দেয়া কাল্পনিক সীমান্তরেখা এখানে আদপে কোন কাজ করে না। দুটি পাড়ার অধিবাসীরাই একে অপরের পাড়ায় আসা যাওয়া করেন, সীমানা বাঁধা হয়ে দা&ড়ায় না। পাসপোর্ট ভিসার তো বালাই নেই। বিশেষ করে চাইক্ষ্যং পাড়ার লোকজনের দৈনন্দিন বাজার সদাইয়ের জন্য মাত্র বিশ মিনিট দূরত্বের সীমানা পেড়িয়ে পিক্ষ্যং পাড়ায় যাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত, কারণ বাংলাদেশের বড় কোন বাজারে গিয়ে আবার ফিরে আসতে তাদের কমপক্ষে দুইদিন লেগে যায়। সীমান্ত ঘেঁষা এই পাড়ায় এবার বিশেষ একটি পরিকল্পনা নিয়ে এসেছি। আমাদের পাগলাটে পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে কারবারি দাদা পাড়ার মুরুব্বিদের নিয়ে এই শীতের সকালে জরুরি বৈঠক ডেকেছেন

কি ছিল আমাদের পাগলাটে পরিকল্পনা? এবার আমরা পরিকল্পনা করেছি বাংলাদেশের পূর্ব সীমান্তের সবগুলো চূড়ায় আরোহণ করব। বিশেষ করে মদক পর্বতশ্রেণীর উত্তর থেকে উৎপত্তি হয়ে যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছে সেই রিজলাইন ধরে একেবারে দক্ষিণে যেতে থাকব। রিজলাইন ধরেই নর্থ ফেইস দিয়ে আরোহণ করার চেষ্টা করব বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দু সাকা হাফং। এই জায়গাটুকু বাংলাদেশের অন্যান্য পার্বত্য অঞ্চলের মত নয়। এখানে দুর্লঙ্ঘনীয় গিরি শিরা ও দুর্ভেদ্য জঙলের সাথে সাথে মানুষ্যসৃষ্ট বেশ কিছু উটকো সমস্যা আছে। সীমান্তের একেবারে লাগোয়া বলে এই পুরো অঞ্চলজুড়ে ভিনদেশের আরাকানের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র যোদ্ধারা প্রায়শই এখানকার দুর্গম অরণ্যে আশ্রয় নেয়। এই গেরিলা যোদ্ধারা যেহেতু লুকিয়ে থাকতেই এখানে আশ্রয় নিয়েছে তাই আমাদের মত বেশভূষার শহুরেদের দেখে কি আচরন করে বসবে তা আগে থেকে ভেবে নেয়া খুব মুশকিল। এক্ষেত্রে তাঁদের ভাষা বুঝতে না পারা বা তাঁদের সাথে ঠিকভাবে কমিউনিকেট করতে না পারাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 

এইতো গেল সমস্যার একটি দিক। সমস্যার সবচেয়ে জটিল ও ভয়ংকর অংশের নাম ‘নাসাকা’ (বর্তমানে “তাতমাদো”), মায়ানমারের কুখ্যাত বর্ডার পেট্রোল এজেন্সি। তাদের দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে গেরিলা যুদ্ধ করতে করতে তারা যখন তখন সীমানা টপকে এপাড়ে চলে আসে। এই অঞ্চল দিয়েই যেহেতু গেরিলারা চলাচল করে তাই নাসাকা নিয়মিত এই পথে টহল দিয়ে বেড়ায়। নাসাকার হিংস্রতা  সম্পর্কে স্থানীয়দের মধ্যে একটি কথাই প্রচলিত আছে- কাউকে দেখতে পেলে নাসাকা আগে গুলি ছুড়বে, পরে এসে লাশকে পরিচয় জিজ্ঞেস করবে। লোকমুখে গুজব শোনা যায় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের প্রবেশ রুখতে নাসাকা নাকি সীমান্তের জায়গায় জায়গায় মাইন পুঁতে রেখেছে। স্থানীয়দের কাছ থেকে বর্তমান পরিস্থিতির বাস্তব তথ্য ও সাহায্য নিয়ে এই সমস্যাগুলোর সম্ভাব্য সমাধান খুঁজে নিতেই আমাদের এখানে আশ্রয় নেয়া। 

ঘরের পরিবেশ থমথমে হয়ে আছে। হঠাৎ করেই তাঁদের আলোচনা থেমে গেছে। এবার বোধ হয় রায় দেবার পালা। চেহারায় গাম্ভীর্য ধরে রেখে কারবারি দাদা যা বললেন তা সংক্ষেপে বললে দাঁড়ায়- আমরা যা করতে চাচ্ছি তা অনেক বেশি বিপদজনক। এখানে জীবনের শংঙ্কা আছে। তাই তাঁরা আমাদের পরিকল্পনা মাফিক বর্ডার ধরে না যাবার পরামর্শ দিচ্ছেন। পুরো বর্ডার সশস্ত্র গেরিলাদের বিচরন, নাসাকার আতঙ্ক, মাইন ছাড়াও কিছুদূর পর পর বড় পশু ধরার ফাঁদ পাতা আছে। জঙ্গল দিয়ে যাবার সময় একটা ভুল পা পড়লে সুঁচালো করে চাঁছা গাছের গুঁড়ি এসে পা এফোঁড় ওফোঁড় করে দিবে। পাড়ার শিকারিদের ভাষ্যমতে এটাই সবচেয়ে বেশি আতঙ্কের। আমরা শহরের মানুষ, জঙ্গলকে তো সেইভাবে চিনব না; তাই ভুলে ফাঁদে পা পড়াটাই খুব স্বাভাবিক। আর এখানে তো কোন পথও নেই, পুরোটাই গভীর জঙ্গল। রিজলাইন ধরে যাবার বিষয়ে তাঁরা কোন ধরণের সাহায্য করতে অপরাগ। দাদার কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। আকাশ ভাই মরিয়া হয়ে পাড়ার মুরুব্বিদের বোঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।  সেই কোন সকালে মিটিংয়ে বসেছিলাম। এখন দুপুর গড়িয়ে বিকাল হয়ে গেছে তবুও কোন কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। মাঝে কেবল চিনি মাখিয়ে বিন্নি চালের ভাত খেয়েছি। এখন প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়ে গেছে। এত ঝুঁকি নিয়ে পাড়ার লোকজন কিছুতেই আমাদের একা ছাড়বে না, আবার এই পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবার জন্য পাড়ার কেউ রাজিও হচ্ছে না। আমি চুপচাপ কাঁচের গ্লাস ভরে আরেক প্রস্থ চা নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে মাচায় এসে দাঁড়ালাম। 

অদ্ভুত সুন্দর পাড়া এই চাইক্ষ্যং। মদকের পশ্চিম ঢালে স্তরে স্তরে সাজানো পর্ণকুটিরগুলো ছবির মত লাগছে। ঢালের ঘরগুলোর সামনে বিশাল এক মাঠ। সেই মাঠে অসংখ্য গরু গয়াল ছাগল ঘাষ খেয়ে বেড়াচ্ছে। এক ঝাঁক মুরগীও বাচ্চাকাচ্চা সমেত অবিশ্রান্তভাবে ঠুকরে খেয়ে যাচ্ছে। মাঠের আরেক পাশে পাড়ার ছেলেরা ফুটবল খেলছে। মাঠের শেষপ্রান্তে বিশাল বিশাল গাছ প্রাচীরের মত পাড়াটিকে আগলে রেখেছে। বিশাল এক এম্ফিথিয়েটার যেন। মাঠের উত্তর সীমানার উপরে মুকুটের মত উঠে গেছে জারজিন সিপ চূড়া, সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে যা ২৬৫০ ফিট উঁচু। পশ্চিমের প্রাচীন অরণ্যরাজির ফাঁকফোকর দিয়ে কেওক্রাডং পর্বতশ্রেনীর আবছা আভাস পাওয়া যাচ্ছে। 

ভাবতেই কেমন লাগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সৈন্যদের সাথে যুদ্ধ করতে এই পাড়ার পাশের ঝিরি দিয়েই যাতায়াত করত ব্রিটিশ সৈন্যরা। বান্দরবানের এই অঞ্চলটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি ওয়ারফ্রন্ট ছিল। মারমা ভাষায় যোদ্ধাকে বলা হয় ‘চাই’ আর ‘ক্ষিয়াং’ অর্থ ঝিরি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যরা এই পথ ব্যবহার করে আরাকানে যুদ্ধ করেছিল। সেই থেকেই স্থানীয় ভাষায় এর নাম হয়ে যায় চাইক্ষিয়াং। এই পাড়ার আদি নাম ছিল ‘রিয়াংবিল’। ঝিরির নাম থেকেই পরবর্তীতে পাড়ার নাম হয়ে যায় চাইক্ষিয়াং। বেখায়ালেই পাড়ার দক্ষিণে চোখ চলে গেল। সেখানে আকাশ জুড়ে আছে ‘সারতেল থাই নাগ’ চূড়া। এই নামের অর্থ কচ্ছপের পিঠের মত যে পাহাড়। এর চাইতে যথার্থ নাম আর হতেই পারে না। সারতেল থাই নাগের পর একে একে সাকা হাফং, সাদরা, জোগী, জো তল্যাং সহ পুরো মদক পর্বতশ্রেনী যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। এই ডাক উপেক্ষা করা কঠিন। সংকল্পকে আরেকটু দৃঢ় করে নিয়ে ঘরে ঢুকে গেলাম। শেষ পর্যন্ত জানিয়ে দিলাম, সাহায্য পাই বা না পাই আমরা যাবই। আমাদের দৃঢ়তা দেখেই হয়তা দুজন তরুন শিকারী শেষ পর্যন্ত আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজী হয়ে গেলেন। 

পরদিন খুব সকালে আমরা সাতজনের দল মদকের রিজলাইন ধরে অনিশ্চয়তার পথে রওনা হয়ে গেলাম। যতই সাহস ও দৃঢ়তার কথা বলি না কেন, মনে মনে সবাই বেশ ভয়ে ভয়ে ছিলাম। বিশেষ করে যেই রাস্তাটা মায়ানমারের দিকে ঢুকে গেছে সেই অংশটি পেরুবার সময় বুকের ভিতর কেউ যেন ঢাক বাজাচ্ছিল। কিছুদূর এগুনোর পর বাঁশের জঙল শুরু হল। মুলি বাঁশ বেশ ঘন সন্নিবেশিত হয়ে আছে। প্রথমদিকে কোনভাবে দুই বাঁশের ফাঁক দিয়ে শরীর গলিয়ে দেয়া গেলেও কিছুক্ষণ পর জঙ্গল এত গভীর হয়ে গেল যে ব্যাকপ্যাক সহ আর যাবার কোন উপায় নাই। বাধ্য হয়ে তখন দা দিয়ে বাঁশ কেটে কেটে এগিয়ে যেতে হচ্ছে। এভাবে আমাদের চলার গতি অবিশ্বাস্য রকমের ধীর হয়ে গেল। এক কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতেই পুরো বেলা চলে গেল। এরপর শুরু হল লতানো ঝোপের জঙ্গল। মদকের এই অংশ কয়েক বছর আগে বোধ হয় জুম হয়েছিল। লতানো আগাছা দিয়ে পুরো পাহাড় ভরে গেছে। এর মধ্য দিয়ে পথ বের করে এগিয়ে যেতে খুব কষ্ট হচ্ছিল। সেদিনের আবহাওয়া এত আর্দ্র ছিল যে সবাই প্রচন্ড ঘামছিলাম। গরমে তৃষ্ণাও পাচ্ছিল প্রচুর। সাথে থাকা পানি দিয়ে যেখানে দুদিন চালানোর পরিকল্পনা ছিল বৈরী আবহাওয়া ও পথের কারণে তা একদিনেই শেষ হয়ে গেল। এদিকে বিকেল গড়িয়ে মদকে দ্রুত রাত নেমে আসছে। পানির অভাবে রিজলাইন থেকে আমরা পানির সন্ধানে নেমে যেতে বাধ্য হলাম। 

পাহাড়ের খাঁজ ধরে নামতে নামতে ঘন্টা দুয়েকের মাঝেই ছোট একটি ঝিরির সন্ধান পাওয়া গেল। আরেকটু এগিয়ে যেতেই এখানে মানুষের চলাচলের চিহ্ন দেখতে পেলাম। গাছের গুড়িতে চলাচলের সময় দা’র কোপ দিয়ে গেছে। পাহাড়ে পথ চলার ক্ষেত্রে এটা একটি সংকেত। আরও কিছুক্ষণ হিমঠান্ডা ঝিরি ধরে এগিয়ে যেতে পুরনো একটি জুম ঘর পাওয়া গেল। পূর্বের ধারনাটি তাহলে ঠিকই ছিল। দুই তিন বছর আগে এই ঢালে কেউ জুম করেছিল। প্রায় ক্ষয়ে যাওয়া জুম ঘরে কোন রকমে রাত কাটানোর প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম। লাকড়ি জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়ে চুলায় খিচুড়ি বসিয়ে ভাবতে বসলাম কোথায় আমাদের ভুল হল। আসলে আমরা জাগতিক সব সম্ভাব্য সমস্যা নিয়ে এত বেশি চিন্তিত ছিলাম যে মূল যেই চ্যালেঞ্জ- পাহাড়, তাকেই ভুলে গিয়েছিলাম। অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস থেকে আমরা পাহাড়কে খুবই হালকা ভাবে নিয়েছিলাম, সেটাই পাহাড় আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। এত উচ্চাভিলাষী একটি পরিকল্পনার কী নিদারুন পরিণতি। 

যেইসব বিপদের কথা ভেবে আমরা আতঙ্কিত ছিলাম সেগুলো কিছুই ঘটেনি। তৃষ্ণায় কাহিল হয়ে পরিকল্পনা মাফিক আমরা গন্ত্যবেও পৌঁছাতে পারিনি। এই অভিযানে আমাদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে চুরচুর হয়ে গিয়েছিল। নতুনভাবে আমরা শিখে গেলাম পাহাড় হেলাফেলা সহ্য করে না। গভীরভাবে চাইলেই শুধু সে তাঁর দ্বার খুলে দেয়। 

5 Responses

  1. অভিযান এর বাকি দিন গুলোর গল্প ও জানতে, পড়তে ইচ্ছা করতেছে।

  2. “পাহাড় হেলাফেলা পছন্দ করেনা” এটা একটা চিরন্তন সত্য 🌼

  3. সুন্দর লিখেছেন। পরের অংশের অপেক্ষায় রইলাম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!