এবার মরলে গাছ হবো

কিম্ভুত এক শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। ঘুমের ঘোরে শব্দের উৎস সহসা বুঝতে পারলাম না, বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগল। ঘটনা হল, সারারাত গাছের উপর যেই শিশির জমেছে, সেটাই এখন টপটপ করে তাঁবুর উপর পড়ছে। ঘড়িতে দেখি মাত্র ৬টা বাজে। যতই ঘুম ভাঙুক, হিম হিম ঠান্ডা ভোরে উষ্ণতার ওম লাগা স্লিপিং ব্যাগ থেকে চাইলেই কি বেড়িয়ে পরা যায়। আরেকটু ঘুমিয়ে নেয়ার চেষ্টায় তাই স্লিপিং ব্যাগটিকে জড়িয়ে চোখ বুজে রইলাম। ঘুমানোর যতটা ডেস্পারেটলি চেষ্টা করছি ততই তাঁবুর ফ্ল্যাপের উপর নেমে আসা  টপটপ শব্দ বোমা সমস্ত মনোযোগ কেড়ে নিচ্ছে।

গতরাতে বুড়ো কড়ই গাছে নিচে কষে তাবুটা পিচ করেছিলাম। না চাইতেও হিসেব করে বের করে ফেললাম, ঠিক পাঁচ সেকেন্ড পর পর একটি করে ফোঁটা পড়ছে। আর প্রতিটি ফোঁটার কম্পন একদম ঘিলুর তারে গিয়ে লাগছে। মানুষের মস্তিষ্ক বড়ই সাংঘাতিক জিনিস, এর মধ্যেই সে বম্বিংয়ের টাইম ইন্টারভাল বের করে ফেলল। একটা সময় খেয়াল করলাম অজান্তেই আমি পরবর্তী ফোঁটার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি। 

ফোঁটাগুলো আমাকে স্টিফেন হকিংন্সের “আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইমের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যেখানে শিশির কণা ও তাবুর প্রতিটি ইম্প্যাক্ট মহাকালের মত চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ছে, ঠিক যেভাবে পুকুরের শান্ত জলে ইটের টুকরো ছুড়ে মারলে ঢেউ হয়ে তরঙ্গগুলো ছড়িয়ে পড়ে। মহাকাল যেখানে চলে এসেছে সেখানে তো ঘুমকে পিছু হটতেই হবে। সকল আলস্য ঝেড়ে আমি স্টোভ ধরাতে বসলাম। এখন এক মগ কড়া কফি শরীরে না গেলে মাথার টপটপানি সারাদিন বিরক্ত করবে।

স্টোভের হিসহিস শব্দটা এখন আরাম লাগছে। অত্যাধুনিক জেটবয়েল স্টোভে দুই মিনিটের মাথায় পানি ফুটতে শুরু করল। মগে গরম পানি ঢেলে এক চামচ কফি গুলিয়ে তাঁবু থেকে বেড়িয়ে এলাম। কার্তিকের ভোরে এখনো প্রকৃতি জেগে উঠেনি, নীল কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। শিরশিরে ঠান্ডায় গরম কফির সমস্ত উষ্ণতা উপভোগ করতে করতে ক্যাম্প সাইটটি একবার চক্কর দিয়ে দিলাম। লোকালয় থেকে দূর, গাছগাছালিতে ছাওয়া নিঃসঙ্গ দ্বীপের মত এক টুকরো উঁচু জমির মাঝে নিজেকে আবিষ্কার করে অনাবিল আনন্দ হল। 

শহরের কোলাহল, ছুটতে থাকা মানুষের ভিড়, ধুলোবালি আর প্রত্যাশা-প্রাপ্তির টানাপোড়নের অহেতুক ব্যস্ততায় ত্যক্ত হয়ে গতকাল এখানে ছুটে এসেছি। আমার সাথে তাঁবু আছে, রান্নার তৈজস পত্র আছে আর আছে বই। মানুষ্য সমাজ থেকে দূর গাছ আর পাখিদের মাঝে কিছুদিন ক্যাম্প করে থাকব। হাঁটবো না, কোন পাহাড় টাহাড় চড়বো না, হাতি ঘোড়া মারব না- জাস্ট শুয়ে বসে থাকব, খিদে পেলে চাল-ডাল ফুটিয়ে নেব, হ্যামকে ঝুলে সারাদিন বই পড়ব, আর পড়ে পড়ে ঘুমাব- এই হচ্ছে গ্র্যান্ড প্ল্যান।

যেই উঁচু জায়গাটিতে তাঁবু ফেলেছি তাঁর তিন দিকেই দিগন্ত বিস্তৃত ধান ক্ষেত। আর পূর্বদিকে বিশাল বড় এক দিঘী। বহু বছর আগে এই দিঘী যখন কাটা হয় সেই মাটি ফেলেই ভিটির মত এই জায়গাটুকু উঁচু করা হয়েছিল। সেই মাটিতে লাগানো হয়েছিল হরেক রকম গাছ- কড়ই, জাম, বেল, তেঁতুল, অশ্বত্থ, কাঁঠাল আর চাপালিশ। সেগুলোই আজ মহীরুহ হয়ে এক টুকরো জমিটির আকাশ ঢেকে দিয়েছে। দূর দূরান্ত পর্যন্ত কোন ঘর বাড়ি চোখে পড়ে না। উত্তরের বড় রাস্তা থেকে দুই মাইল ধান ক্ষেতের মাঝ দিয়ে আইল ভেঙে এখানে আসতে হয়। দীঘির টলটলে জলরাশি পেরিয়ে গাছগাছালির ফাঁক দিয়ে অপর পাড়ের পুরনো শ্মশান মঠের চূড়োটুকুই শুধু আবছা দেখা যাচ্ছে।

কফিতে চুমুক দিতে দিতে দিঘীর উঁচু পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। কচি ঘাসের ডগায় বিন্দু বিন্দু শিশিরকণা জমে আছে। এটুকু আসতে আসতে ট্রাউজারের নিচের অংশ ভিজে গেল। খালি পায়ে ভেজা ঘাস মাড়ানোতে বাতাসে খুবই হালকা একটি সবুজাভ মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। লোভীর মত বার দুয়েক বুক ভরে গভীর নিঃশ্বাস নিয়ে নিলাম। ভেজা সজীবতার নির্মল আনন্দ রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়লো। নিচে তাকিয়ে দেখি উপরি হিসেবে জুটে গেছে একগাদা চোরাকাঁটা। 

দীঘির উপর কুয়াশার ধোঁয়াটে একটি আস্তরণ ঝুলে আছে। হুট করে দেখলে মনে হবে দীঘির পানি বুঝি বাষ্প হয়ে উড়ে যাচ্ছে, আবার ঘন হয়ে ওখানেই ঘুরপাক খাচ্ছে। দিগন্তের ওপারে সূর্য উঠে গেছে। ছাই রঙা কুয়াশার পর্দার পিছনে ম্লান সাদা চাকতি মত সূর্যটিকে বড় অসহায় লাগছে। দিঘীর পাড়ের কাছে পুঁতে রাখা একটি বাঁশের আগায় একটি ফিঙেকে নিশ্চল বসে থাকতে দেখে মনে হল, সাদা-কালো পৃথিবী দেখতে নেহাত মন্দ নয়। ছাই রঙা কুয়াশার ক্যানভাসে দূরের কালো রঙা গাছের সারি আর টলটলে পানিতে ফিঙেটির কালচে প্রতিবিম্ব-  সহজ সরল সৌন্দর্য। একটু পর সূর্যের তেজের সাথে কুয়াশারা আর পাল্লা দিয়ে পারবে না, ধীরে ধীরে ভোজবাজির মত আকাশে মিলিয়ে যাবে। 

বলতে না বলতেই কুয়াশার ফাঁক গলে সোনা গোলানো আদুরে রোদ আড়মোড়া ভেঙে উঠল। তখনই খেয়াল করলাম ডানপাশে কী যেন চিক চিক করে উঠল। তাকিয়ে দেখি ঘাসের মধ্যে মাকড়সার বুনে যাওয়া জালে বিন্দু বিন্দু শিশির ফোঁটা জমেছে। আলো পেয়ে শিশির বিন্দুগুলো হীরের মত জ্বল জ্বল করছে। হতে পারে গতরাতে গলার হারটি খুলে রেখে দিঘির জলে কোন অপ্সরা নাইতে নেমেছিল। অনাহুত আগুন্তুককে দেখে পালিয়ে যাবার সময় হারটি নিতে ভুলে গেছে। 

টিপিটিপি পায়ে হারটির কাছে এগিয়ে গেলাম। ঝুঁকে বসে সন্তর্পণে একটি হীরের বিন্দুকে তর্জনীর আগায় নিয়ে নিলাম। ছোটবেলায় বৃষ্টির পর এমন করেই শহুরে বারান্দার গ্রিলে হীরক বিন্দু জমে থাকত। এভাবেই তর্জনীর আগায় হীরের বিন্দু নিয়ে, এক চোখ বন্ধ করে উল্টো পৃথিবী দেখার খেলায় মেতে উঠতাম। এক ফোঁটা সেই হিরক বিন্দুর মধ্যে পুরো ব্রক্ষ্মান্ড দেখে ফেলতাম। অচিণ দেশের, তেপান্তরের মাঠে ছুটে বেড়ানোর ডাক শুনতে পেতাম। 

দিঘীর উপর দিয়ে এক ঝাঁক বক উড়ে গেল। ধীরে ধীরে ছোট এই অরণ্যভূমির অন্যান্য বাসিন্দারাও জেগে উঠতে শুরু করেছে। একজোড়া ঘুঘু দেখতে পেলাম, বেল গাছে বাসা বেঁধেছে। কুয়াশা ঘেরা নিস্তব্ধতার মাঝে ঘুঘুর ভারিক্কি ডাক বিষন্নতার আবহে গ্রাস করে ফেলে। বিষণ্ণ গানে বিরক্ত হয়েই বুঝি একঝাঁক শালিক নেমে এল মাটিতে, শুরু হল উনাদের কিচিরমিচির ঝগড়া। শালিকগুলোর সাথে যোগ দিল কয়েকটি চড়ুই। 

গতকাল বিকেলে এখানে আসার সময় দেখেছিলাম ক্ষেতজুড়ে উঁচু বাঁশের খুটিতে দেয়ালের মত করে কারেন্ট জাল লাগানো। অবাক লাগায় ক্ষেতে নিড়ানির কাজে থাকা চাচাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ক্ষেতজুড়ে এভাবে জাল লাগানোর কারণ কী? মুখে এক গোছা পাকা দাড়ি, কাছা বাধা লুঙ্গি ও নীল শার্ট পড়া পোড়াটে চেহারার চাচা উত্তরে বলেছিলেন, বদমায়েশ চড়ুইগুলো ধান সব নষ্ট করে ফেলে। ঝাঁক বেঁধে ওরা যখন ক্ষেতে নামে আসে তখন শব্দ করলে দিশেহারা হয়ে পালানোর সময় পাখিরা জালে আটকে যায়। 

চাচার কথা শুনে অনেক অবাক লেগেছিল। এখনো আমরা পুরনো ধ্যান ধারনা নিয়েই পড়ে আছি। শিক্ষা দীক্ষায় একটুও অগ্রসর হতে পারিনি। নামেই শুধু কৃষিপ্রধাণ দেশ হয়ে আছি। কর্পোরেটাজিশেনের প্রভাবে কৃষি সম্পর্কিত আমাদের প্রাচীন দেশজ সকল জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। জেনেটিক্যালি মডিফাইড, উচ্চফলনশীল হাইব্রিড বীজ, কেমিক্যাল সার, কীটনাশকের দুষ্টচক্রে হারিয়ে গেছে কৃষি। তা না হলে, গ্রামের কৃষক অহেতুক চড়ুই মারা ফাঁদ কেন পেতে রাখবে। দেশজ জ্ঞান থাকলে তো সে ক্ষেতে চড়ুই আসার খুশী হত বরং। ক্ষতিকর কীট পতঙ্গ খেয়ে ফেলায় কৃষকের উপকারই হত। 

মানুষের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল অতীতের ভুল থেকে আমরা কিছু শিখি না। তা না হলে মাও সেতুংয়ের দ্যা গ্রেট স্প্যারো ক্যাম্পেইন ব্লান্ডারের কথা জানার পরও কিভাবে একজন কৃষক চড়ুই পাখি মারার ফাঁদ পাততে পারে। কৃষকের কথা না হয় বাদ দিলাম, এলাকার শিক্ষিত কৃষি অফিসারগণই বা কি করেন, বুঝি না। মাও সেতুংয়ের এই স্প্যারো ব্লান্ডারের গল্পটা ছোট করে বলি। 

চিনের সর্বময় ক্ষমতা তখন চেয়ারম্যান মাওসেতুংয়ের হাতে। একবার কৃষি বিষয়ক একটি গোয়েন্দা রিপোর্ট মাওয়ের হাতে গেল। সেখানে লেখা ছিল, চড়ুই পাখিরা প্রতি বছর যেই পরিমাণ পাকা ধান খেয়ে ফেলে তা দিয়ে ৬০ হাজার মানুষ ভাত খেতে পারবে। এই রিপোর্ট পড়ে চেয়ারম্যানের মাথা খারাপ হয়ে গেল। আগপিছ না ভেবে, কারও সাথে কোনরকম শলাপরামর্শ না করে ডিক্রি জারি করলেন, দেশ থেকে চড়ুই পাখির নাম নিশানা মিটিয়ে দিতে হবে। নেয়া হল রাস্ট্রীয় উদ্যোগ।

যথা আজ্ঞা জাঁহাপনা বলে, চায়নার আবাল, বৃদ্ধ, বনিতা, ছাত্র-ছাত্রী, কারখানার শ্রমিক, সৈন্য, পুলিশ সকলে মিলে মেতে উঠল চড়ুই পাখি নিধনে। পাখির বাসা খুঁজে ডিম ভেঙে দিয়ে, বিষ মেশানো খাবার দিয়ে, রাইফেল দিয়ে চড়ুই নিধন করতে  লাগলো। সবচেয়ে জনপ্রিয় ও কার্যকরী উপায় ছিল ধাওয়া দেয়া। সবাই মিলে বিকট শব্দ করে চড়ুইদের এমনভাবে ধাওয়া করত যেন বিশ্রাম নেয়ার জন্য কোথাও বসতে না পারে। উড়তে উড়তে ক্লান্ত হয়ে পাখিগুলো যখন নিচে এলিয়ে পড়ত তখন তাদের নির্মমভাবে হত্যা করা হত। 

এমন ধ্বংসযজ্ঞের ফলে, কিছুদিনের মধ্যে চায়নার মত বিশাল একটি দেশ থেকে চড়ুই পাখি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। মানুষের এমন নির্বোধের মত কাজ দেখে প্রকৃতি নিশ্চয়ই তখন খুব হেসেছিল। তাই চড়ুই নিধনের ফলাফল পাওয়া গেল হাতেনাতে। শস্যক্ষেতগুলো ছেয়ে গেল পঙ্গপালের আতঙ্কে। যেই ফসল বাঁচানোর জন্য এত কিছু করা হল তা আর বাঁচানো গেল না। এক মৌসুমে ক্ষেতের সব শস্য পঙ্গপাল খেয়ে সাফ করে দিল। যার প্রভাবে শস্যভাণ্ডার সব খালি হয়ে গেল। খাদ্যের অভাবে পড়লো কোটি কোটি মানুষ। শুরু হল দুর্ভিক্ষ, দ্যা গ্রেট ফেমাইন। 

পরবর্তীতে গবেষণায় জানা গেল, যেই চড়ুই পাখিদের বংশ সহ উজাড় করে ফেলা হয়েছিল, মূলত তাদেরই খাদ্য ছিল এই পঙ্গপাল। ফুড চেইনে চড়ুই না থাকায় জ্যামিতিক হারে তাই বেড়ে গিয়েছিল পঙ্গপালের সংখ্যা। প্রকৃতি থেকে চড়ুই নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ফলে মারা গিয়েছিল কয়েক লাখ মানুষ। প্রকৃতির ভারসাম্যের জন্য তার প্রতিটি উপাদানই অপরিহার্য। এর কোন একটি কম বেশি হলে শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। সেই ভারসাম্য ঠিক করতে চেইন রিয়েকশনের মত নেমে আসে নানা রকম বিপর্যয়। ইতিহাসের এত এত নির্মম শিক্ষাও আমরা বেমালুম ভুলে যাই। না হলে পাখি মারতে ফসলের মাঠে কেউ জাল পেতে রাখে! 

সদ্য কেনা হ্যামকটা এবার টানানোর পালা। একপাশে বেল আরেক পাশে কড়ই গাছে হ্যামকটি বেঁধে এলিয়ে গেলাম। বন ধোয়া বাতাসে হ্যামকটি মৃদুভাবে দুলছে। হ্যামক থেকে সবকিছু অন্যরকম লাগে। মা গাছগুলো আশীর্বাদের মত মাথার উপর ডালপালা মেলে আছে। সবুজ পাতাগুলোর ঘন জালের ফাঁক গলে সূর্যের সোনালি আলো চুইয়ে প্রবেশ করছে। সবুজের সাথে সোনালী সূর্যের এই লুকোচুরি খেলা আলো ছায়ার মোজাইকের মত লাগছে। 

বেলা বাড়ার সাথে সাথে পান্থকুঞ্জে কোলাহল বাড়ছে। সাত সকালে বাসা বানানোর কাজে লেগে গেছে একটি লাল ঝুটি কাঠঠোকরা। কিচিরমিচির অর্কেস্ট্রার মাঝে থেমে থেমে ট্রে-রেট-টেট বিট মিলেমিশে যাচ্ছে। ইতিউতি খুঁজে পাখিটাকে কাছাকাছি দেখতে পেলাম না। একঝাঁক শালিক খড়কুটো নিয়ে ঝগড়া লাগিয়ে দিয়েছে। খুব ভালো করে খেয়াল করে দেখেছি, শালিকদের মেজাজ সর্বদা ফোরটি নাইন অবস্থায় থাকে। একটু ছুতো পেলেই হল, শুরু করে দিবে ঝগড়া।  

পাখিদের অর্কেস্ট্রার মাঝে সাথে নিয়ে আসা বইটি খুলে বসলাম। গত কয়েকদিন ধরে পিটার হলেবেনের লেখা “দ্য হিডেন লাইফ অফ ট্রিস” বইটি পড়ছি। জার্মান অরণ্যবিজ্ঞানী পিটার ওললেবান দীর্ঘদিন গাছেদের পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিলতিল করে লুকায়িত গাছেদের রহস্যময় জগতকে আবিষ্কার করে কাব্যিকভাবে তা লিখে গেছেন। সত্যি বলতে, কংক্রিটের দেয়ালে বন্দি অবস্থায় বইটি শেষ করতে চাইনি বলেই অস্থির হয়ে এখানে ছুটে এসেছি। পান্থকুঞ্জের কোলাহল থেকে মনযোগ সরিয়ে মুহুর্তের মধ্যে আমি হলদে কাগজে ছাপা কালো অক্ষরগুলোর মাঝে হারিয়ে গেলাম। 

যত পড়ছি, তত অবাক হচ্ছি। বইটির প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি তথ্য আমাকে বিহ্বল করে দিয়েছে। আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে যে কত বড় দুনিয়া রয়ে গেছে তা ভাবতেও কেমন লাগে। এতদিন পর্যন্ত আমি গাছেদের আলাদা আলাদা স্বত্বা হিসেবেই দেখে এসেছি। একটি গাছের সাথে আরেকটি গাছ, বা সহজভাবে বললে পুরো বনের প্রতিটি গাছ যে একে অপরের সাথে কানেক্টেড এটা কখনো ভেবে দেখিনি। লোকচক্ষুর আড়ালে মাটির নিচে অদৃশ্য সুতোর মত  ছত্রাকের নেটওয়ার্ক দিয়ে গাছেরা একে অপরের সাথে কানেক্টেড থাকে। এই ছত্রাক নেটওয়ার্কের নাম হল মাইসেলিয়াম। মানুষ যেমন ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েবের মাধ্যমে একে অপরকে মেইল দেয়, ছবি পাঠায়, ট্যাগ করে, সেভাবেই গাছেরা মাইসেলিয়ামের মাধ্যমে তথ্য ও ভাবের আদান-প্রদান করে। তাই এদের উড ওয়াইড ওয়েবও বলা হয়। 

এভাবেই মা গাছেরা ছোট চারাদের দেখভাল করে, দুর্বলদের প্রয়োজনীয় পুষ্টি পৌঁছানোর ব্যবস্থা করে। এভ্যবেই তারা অতীতের সকল স্মৃতি , জ্ঞান, অভিজ্ঞতার তথ্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে হস্তান্তর করে। শেষ কবে বন্যা হয়েছিল, পরবর্তী খরা হবার সম্ভাবনা কবে হতে পারে এমন তথ্যও মা গাছগুলো পরবর্তী প্রজন্মকে জানিয়ে যায়; যেন চারাগুলো নিজেদের অভিযোজিত করে নিতে পারে। অরণ্য যে অনেকগুলো গাছ নিয়ে কেবলই একটি জায়গা না, বরং একটি জীবন্ত কমিউনিটি, যারা আনন্দ, রাগ, সুখ, দুঃখ, বেদনার মত অনুভূতি একে অপরের সাথে ভাগাভাগি করে নেয়। ভিন্ন জাতের হলেও বিপদ আপদে একে অপরকে সতর্কবার্তা পাঠায়, সাহায্য করে। এমনকি বয়ষ্ক গাছেরা নবীনদের বাঁচাতে খুশি খুশি জীবন বিসর্জন দিয়ে দেয়। বইটি শেষ করে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। টের পাচ্ছি নির্মল ঘোরলাগা আনন্দ পুরো শরীরজুড়ে ছোটাছুটি করছে, আমি আরাম করে তা উপভোগ করছি। 

বিশাল সব গাছেদের ছায়ায় হ্যামকের দুলনিতে পুরো চারপাশের সবই পরাবাস্তব লাগছে। মনে হচ্ছে অন্যকোন জগতে এসব ঘটছে। আকাশের সাথে মাটির, বাস্তবতার সাথে স্বপ্নর জগৎ একাকার হয়ে গেছে। পাখিদের আনন্দের গান, খুনসুটি, ভালোবাসার আকুতি ও  ঝগড়ার সুরেলা ঐকতানের সাথে কার্তিকের মিঠে হাওয়ার দোল আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দিল। 

কয়েক ঘন্টা কেটে গেল- নাকি মিনিট? কে জানে। গাছেদের মাঝে সময় অদ্ভুত আচরন করে। এখানে সময়ের কোন গাছপাথর থাকে না। এদিকে বেলা গড়িয়ে গেছে। কুয়াশার চাদর গুটিয়ে নিয়েছে প্রকৃতি। টলটলে জলে সূর্য সোনালী কিরণ ঢেলে দেয়ায় দীঘিটি আকাশের নীল আয়না হয়ে গেছে। দূর থেকে ঢং ঢং ঘন্টার কাঁপা কাঁপা শব্দও ভেসে এল মাত্র। এতক্ষণে  পুরোহিতের ঘুম ভাঙলো বুঝি। তাকিয়ে দেখি দীঘি পেরিয়ে দিগন্তরেখায় গাছপালার উপর দিয়ে শ্মশান মন্দিরটির চূড়া এখন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তেড়েফুঁড়ে যেন স্বর্গে যাবার আয়োজন করছে কেউ। 

বোধ বুদ্ধি ভাব শুন্য হয়ে মাথাটা  ঝিম ধরে আছে। নিজেকে অন্যরকম লাগছে। মনে হচ্ছে গাছেদের মধ্যে থেকে আমার কিছু একটা হয়েছে। গাছেদের রহস্যময় দুনিয়ার সাথে কোনভাবে জড়িয়ে পড়েছি। এই অনুভূতি শুধু আমার মনে মনে হয়নি। আমার শরীর, মন, আত্মা সবকিছু নিয়েই ওতপ্রোতভাবে পেঁচিয়ে গেছি। আমার প্রতিটি নিঃশ্বাস প্রশ্বাসের সাথে গাছের নিভৃত স্পন্দনের তরঙ্গ টের পাচ্ছি। আমার যাপিত জীবনের ব্যস্ততা বেমালুম ভুলে গেছি। আবছা আবছা অস্পষ্ট কিছু ভাবনা মাথায় আছে বটে কিন্তু এই মুহুর্তে সেগুলো গুরুত্বপূর্ণ লাগছে না। এখানে সময়ও অনেক ধীরে বইতে থাকে। গাছের শিকড়ের সাথে, ধীরে ধীরে, একটু একটু করে। পাতা ঝরে, নতুন কুঁড়ি আসে, গাছেরা দাঁড়িয়ে থাকে ঠায় অবিচল; সময়ের জ্ঞান কুড়াতে কুড়াতে, মহাকালের প্রজ্ঞাবান সাক্ষী হয়ে। 

আরও অনেকক্ষণ হ্যামকে শুয়ে রইলাম। উঠে কী করব। আশেপাশে কারোই তাড়া নেই। গাছেদের নেই, পাখিদের নেই। সবকিছুই কেমন স্থির, নিশ্চল, শান্ত হয়ে আছে। তারপরেও কী জীবন্ত! অরণ্য ভূমির এমন জীবন্ত স্বরুপ আগে এমনভাবে উন্মোচিত হয়নি। স্থিতধী গাছেরা, হুটোপুটি করা পাখিরা, ভূঅভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা রহস্যময় মাইসেলিয়ামের জাল আর আমি- সবকিছু এক সুতোয় বাঁধা জটিল এক ধাঁধা যেন। প্রত্যেকে একে অপরের সাথে কোন অদৃশ্য শক্তি দ্বারা সম্পর্কিত। 

প্রকৃতির এক ভিন্নরুপ এবার উন্মোচিত হল। গাছেদের নিঃশব্দ কথোপকথন, আনন্দ বেদনা ভাগ করে নেয়া, সবল গাছের স্বেচ্ছায় দুর্বলের সাথে খাবার ভাগাভাগি করে নেয়া, একে অপরের খেয়াল রাখা- এটাই তো জীবনের পারফেক্ট ব্লু প্রিন্ট। প্রতিযোগিতা নয়, সহযোগিতা ও সহমর্মিতা। তাড়াহুড়ো নয়, স্থিরতা। অরণ্যের কোন দরকার পড়ে না সময়ে সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলার। অরণ্য তার নিজের মত চলে, নিজের মত সময় নিয়ে বেড়ে উঠে। 

কত কিছু শেখার আছে অরণ্য থেকে। বোধ হবার পর থেকে শুধু ছুটেই চলেছি। একের পর এক চাওয়ার পিছনে তাড়া করে বেড়ানো, একটি পেয়ে গেলে তৎক্ষনাৎ আরেকটি না পাওয়ার অতৃপ্ত ক্ষিদে নিয়ে আমৃত্যু ছুটে চলা। একটি মুহুর্ত চুপচাপ বসে জীবনকে কে শুধু জীবনের জন্য উপভোগের কোন সুযোগ নেই। কিন্তু এখানে আমি কোন রকম তাড়া অনুভব করছি না। কোথায় পৌঁছাতে হবে না, চুপ করে এখানেই বসে থাকতে হবে। কোন কাজ শেষ করার জন্য কেউ ঘাড়ের উপর চেপে বসবে না। এখানে শুধু একটাই কাজ, বুক ভরে অরণ্যমাখা শ্বাস নাও, সঞ্জীবনী বায়ু দেহের প্রতিটি কোষে পৌঁছে দাও। 

পঁচে গলে যাওয়া পার্থিব জীবনে আবার ফিরতেই হবে। কিন্তু ফিরে যাবার আগেএই মুহুর্তটুকুই আজীবনের জন্য স্মৃতি হয়ে যাবে। গাছেদের মাঝে থেকে শেখার চেষ্টা করছ। প্রতিনিয়ত শিখছি অহেতুক চাওয়া-পাওয়ার প্রপঞ্চের পিছনে ছুটে কোন লাভ নেই। মুহুর্ত উপভোগের জন্য আগের চেয়ে কিছুটা হলেও ধীর স্থির হতে হবে, ধৈর্য্যবান হতে হবে। নির্বাক গাছেরা আমার সাথে তার সমস্ত রহস্যের আড়াল তুলে দিয়েছে। বারবার আমাকে বলছে,  শান্ত হও! একটু থমকে দাঁড়াও। চারপাশে জ্ঞ্যাত অজ্ঞাত কত কিছু হচ্ছে তা চোখ মেলে দেখো একটু, বুক ভোরে তাজা শ্বাস নাও, নবতেজোদ্দীপ্ত হও। বাঁচো আর বাঁচতে দাও।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!