কিছুক্ষণ আগেই দাঁড়িয়ে ছিলাম তিন দেশের (বাংলাদেশ, ভারত ও মিয়ানমার) বর্ডারে। বাংলাদেশের পূর্ব দিকের এই বর্ডারকে ‘তিন মাথা’ বা ‘তিন মুখ’ হিসেবেই সবাই চেনে। তিন কোণের একটি পিলার তিন দিকে তিন দেশের সীমানা দেখাচ্ছে। শুধু তিন দেশের বর্ডার বলেই নয়, প্রায় ২৯০০ ফিট উচ্চতার এই চূড়াটি বাংলাদেশের একটি অন্যতম প্রমিনেন্ট চূড়া। স্থানীয় বম অধিবাসীদের কাছে এটা রাম্রি তল্যাং নামেও পরিচিত। খুব ভোরে পাড়া থেকে রওনা হয়েছিলাম। ইচ্ছা ছিল তাড়াতাড়ি চূড়ায় ওঠার। যত দ্রুত সেটা পারা যায় ততই লাভ। কেননা আজকেই বাড়ি ফেরার পথ ধরব। অনেক দিন হয়ে গেল পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরছি। বাড়ি ফেরার চিন্তায় সবাই বেশ চনমনে ছিলাম। কিন্তু চূড়ায় ওঠার শেষ ধাপটি ঘন ছনের বনে ঢাকা থাকায় আমাদের বারোটা বেজে গেল।
পিলার দর্শন করে আবারও ছনের জঙ্গল পেরিয়ে একসময় খোলা জায়গায় এসে পড়লাম। সামনেই একটি জুমঘর পেয়ে ওটার মাচায় বিশ্রাম নিতে বসলাম। যেদিকেই চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। নানা রকম সবুজ। ধানের চারাগুলোও বেশ বড় হয়েছে। দক্ষিণ থেকে মৃদু একটা বাতাস বইছে। সেই বাতাসে ধানগাছগুলো নুয়ে নুয়ে যাচ্ছে। পাহাড়জুড়ে ধানগাছগুলোর যেন নাচন শুরু হয়েছে। একদিকে কিছু গাছ নুয়ে যাচ্ছে তো অন্যদিকে আবার সোজা হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা গ্যালারির মেক্সিকান ওয়েভের মতো। সেই ঢেউখেলানো নৃত্যের তালে তালে সূর্যের আলো পড়ে আবার পুরো পাহাড়ের রংও পাল্টাচ্ছে। কোনো জায়গায় গাঢ় সবুজের শেড, কোথাও বা কচি কলাপাতার সবুজাভ। মাঝেমধ্যে উত্তরে ছুটতে থাকা মেঘের দলছুট সারিগুলো সূর্যকে ক্ষণিকের জন্য ঢেকে দিচ্ছে। ঢেউখেলানো সবুজের গালিচার ওপর আলো-ছায়ার সেই খেলার দৃশ্য যে কী মোহনীয়, তা লিখে বোঝানো যাবে না। হতবাক হয়ে প্রকৃতির খেলা দেখতে দেখতে বেলা যে কখন গড়িয়ে গেল, তা টের পাইনি। কেউ একজন ফেরার তাড়া দেওয়ায় আবারও হাঁটা শুরু করলাম।
ধুপানিছড়াপাড়ায় ফিরে এসে একটু ধাতস্ত হতেই শুনতে পেলাম, একটা চাপা গুমগুম আওয়াজ। পাড়ার কারবারি দাদার কাছে জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এই পাড়ার নিচ দিয়েই নেমে গেছে রাইক্ষ্যং নদী। পাড়ার ঠিক নিচেই রাইক্ষ্যংয়ের স্রোত এক জায়গায় বাধা পেয়ে ভয়ংকর হয়ে তার ক্ষোভ জানাচ্ছে। অতীতে পাড়ার লোকজন ভাবত ভয়ংকর এক পানির দানো এই গুমগুম আওয়াজ করে। সেই থেকে এর নাম দিয়েছে তারা ‘তুই কু তুমু’ বা ‘পানির গর্জন’। দাদার মুখে গল্প শুনে সবাই এর সাক্ষাত্ পাওয়ার জন্য মুখিয়ে উঠলাম। যাদের বাসায় ফেরার একটু হলেও তাড়া ছিল তারা বাসার কথা বেমালুম ভুলে গেল।
পাহাড়ি পিচ্ছিল পথ ধরে পাড়া থেকে যত নিচে নামতে থাকলাম, গর্জন ততই বাড়তে লাগল। একসময় আমরা উন্মাতাল পাহাড়ি নদী রাইক্ষিয়াংয়ের বুকে এসে পড়লাম। এ জায়গায় নদীর চেহারা বেশ ভয়ংকর। কিছুদিন আগেই পুকুরপাড়া হয়ে ধুপানিছড়ার পথে এসেছি। সেখানে রাইক্ষিয়াংয়ের রূপ আবার আলাদা। বান্দরবান-রাঙামাটির সীমানা পাঁচিলের মতো যে পর্বত শ্রেণিটি দাঁড়িয়ে আছে, তার নাম ‘লম্বোক রো’। এই লম্বোক রো শ্রেণির সর্বোচ্চ চূড়া ‘থিনদোলতে তল্যাং’-এর ঢাল থেকে সৃষ্টি হয়েছে খরস্রোতা রাইক্ষিয়াং। পূর্ব দিকের বর্ডার ধরে এটি রাঙামাটির বিলাইছড়ির বুক দিয়ে কাপ্তাইয়ে গিয়ে মিশেছে।
আমরা যেখানে আছি, রাইক্ষিয়াংয়ের উত্স থেকে জায়গাটা খুব বেশি দূরে নয়। উেসর এত কাছে বলেই হয়তো রাইক্ষিয়াং এখানে কোনো শান্তশিষ্ট নদী নয়। এখানে সে রাগী, উন্মাদ ও ভয়ংকর। শত শত বছর ধরে বাধা হয়ে দাঁড়ানো পাহাড়কে হিংস্রভাবে চিড়ে-ফুঁড়ে, পাথরের দেয়াল ভেঙেচুরে রাইক্ষিয়াং পরাক্রমশালী বীরের মতো নিজের পথ তৈরি করে নিয়েছে। বাংলাদেশের অন্য কোনো পাহাড়ি নদী চলার পথে এত ঘন ঘন ওপর থেকে নিচে আছড়ে পড়ে তার উচ্চতা কমিয়েছে কি না আমার জানা নেই। এর অর্থ হলো, এই নদী তার যাত্রাপথে ঘন ঘন জলপ্রপাত হয়ে পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসেছে। তাই রাইক্ষিয়াং এত খরস্রোতা, তার গতির এত তীব্রতা। আমরা এমনই একটি জলপ্রপাতের মাথায় চলে এসেছি। এরই নাম ‘তুই কু তুমু’ বা ‘পানির গর্জন’।
রাইক্ষিয়াং এখানে দুই পাশের পাহাড় ফেড়ে ধাপে ধাপে সিঁড়ির মতো নেমে গেছে। তার ঠিক সামনেই তৈরি হয়েছে ছোট একটি ক্যাসকেড। তীব্র পানির স্রোত এখানে এসে অদ্ভুত রকমের শান্ত হয়ে গেছে। স্বচ্ছ নীল রঙের অগভীর এক প্রাকৃতিক সুইমিং পুল যেন। বিশাল বিশাল গাছের সবুজ ছাউনির ফাঁক গলে সূর্যের সোনালি আভার ছিটে আপাত স্থির সেই নীল পানির ওপর পড়েছে। এতটুকু দেখেই অবাক বিস্ময়ে বিহ্ববল হয়ে যাই।
কে জানত আমার হতবাক হওয়ার পালা এখনো শেষ হয়নি। প্রকৃতি তার লুকিয়ে থাকা হাজারো রহস্যের জালে আমাকে বেঁধে ফেলবে। একটু পরই দেখি ক্যাসকেডের পানি গড়িয়ে আবারও নিচে নেমে গেছে। পানির গতিপথটা খেয়াল করতেই দেখলাম সামনে দুই পাশের পাহাড় আরো বেশি সরু হয়ে গেছে। আবছা অন্ধকারের ভেতর থেকে পানির আওয়াজ গম্ভীর হয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। পিচ্ছিল পাথুরে দেয়াল ধরে, কাঁটাগাছের ডাল ঝুলে শুধু নিচে নেমেই যাচ্ছি, অবাক করা পথ আর শেষ হচ্ছে না। কিন্তু যতই কাছে এগিয়ে যাচ্ছিলাম ততই উপলব্ধি করছিলাম সামনে আরো কিছু আছে; অন্য রকম কিছু।
অবশেষে নিচে নেমে আসতেই তীব্র পানির একটা ঝাপটা মুখে এসে লাগল। বিমূঢ় হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। মোহগ্রস্তের মতো তার দিকে হাঁটা দিলাম। পানির ঝাপটায় চোখ জ্বালা করছে, তবু এগিয়ে যাচ্ছি তার নিচে নিজেকে সঁপে দিতে। ওপর থেকে আছড়ে পড়া স্বর্গীয় জলতরঙ্গ শরীরের সব আক্ষেপ, হতাশা, ক্ষোভ, কলুষতা ধুয়ে নিয়ে গেল। আমি যেন পরিশুদ্ধ হয়ে আবার মর্ত্যে ফিরে এলাম।
ফিচার ছবি: জাকিউল দীপ
অভিযানের সময়কাল: ২০১১
2 Responses
অদ্ভুত লেখনী। প্রতিটি লাইনের সাথে আমিও যেনো এগিয়ে চলেছি রাইখং এর বিস্মিত পথে….
রাইক্ষ্যংয়ের পথে হেঁটে গেলে বিষ্মিত হতেই হবে।