পাংখোয়া জনশ্রুতি

“সময়ের শুরুতে আমাদের পূর্বপুরুষেরা লুসাই দেশের এক গুহা থেকে বেড়িয়ে এসেছিল। আমাদের ছিল এক দৌর্দণ্ড প্রতাপশালী নেতা। তাঁর নাম ছিল লানদ্রক-পা, যে প্রথমবারের মত বুনো গয়ালকে বশ মানিয়ে গৃহপালিত করেছিল। সে এতটাই প্রতাপশালী ছিল যে দেবতার মেয়েকে সে বিয়ে করার প্রস্তাব দিয়ে বসে।

সে জগতের সকল জীবজন্তুকে তাঁর বিয়েতে সাহায্য করার জন্য ডাক দেয়। সকলে মিলে জঙ্গল কেটে দেবতার বাসা পর্যন্ত রাস্তা বানিয়ে তাঁদের রানীকে মহাসমারোহে তাদের মাঝে নিয়ে আসে। শুধুমাত্র শ্লথ আর কেঁচো তাঁদের রাজার ডাকে সাড়া দেয় নি। রাজা ক্ষিপ্ত হয়ে এই দুইজনকে অভিশাপ দেয়। অভিশপ্ত এই দুই প্রাণী তাই সরাসরি সূর্যের দিকে কখনোই তাকাতে পারে না।

সেই বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দ ফূর্তির মধ্যেই লানদ্রক-পা দেবতাকে তাঁর সবচেয়ে প্রিয় অস্ত্রটি উপহার দিয়ে দেয়। দেবতা অসন্তুষ্ট হলে সে অস্ত্রের ঝলকানি এখনো পাওয়া যায়। সেই অস্ত্রটি হচ্ছে ‘বিজলি’।

রাজার বিয়ের কিছুদিন পরই জঙ্গলে এক ভয়াবহ দাবানল শুরু হয়। আগুনের আঁচ থেকে বাঁচতে রানীর পরামর্শে সম্প্রদায়ের সবাই সাগরতটের কাছে নেমে আসে। এভাবেই আমরা এই দেশে এসেছিলাম। এটা সেই সময়ের কথা বলছি যখন মানুষসহ জগতের সকল জীবজন্তুর ভাষা একই ছিল। নতুন জায়গায় এসে সবারই খাদ্য যোগাড় করতে কষ্ট হচ্ছিল। এমনকি সাথে থাকা প্রাণীদের মাংশও তাঁরা খেতে পারছিলো না। যখন কেউ কোন প্রাণীকে হত্যা করতে যেত তখনই তারা এতটা করুণ স্বরে জীবনের ভিক্ষা চাইত যে কেউই আর তাঁদের হত্যা করতে পারত না।

রানী আর সহ্য করতে না পেরে বাবার কাছে অভিযোগ করে বসে। কন্যার মন রাখতে দেবতা অন্য সকল জন্তু ও পাখির কথা বলার ক্ষমতা কেড়ে নিল। তাই কথা বলতে পারে না এমন কিছু খেতে আমরা দ্বিধা করিনা।

পৃথিবীতে মানুষের উৎপত্তি ও বিকাশের বিষয়ের বিভিন্ন জাতির মধ্যে নানা রকম বিশ্বাস ও কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। এগুলোকে বিশ্বাস অথবা পৌরাণিক গল্প…যাই বলুন না কেন প্রচলিত এই কিংবদন্তিগুলো প্রতিটি সমাজের ঐতিহাসিক সম্পদ। এই গল্পগুলো থেকেই কোন একটি সমাজের অতীত ইতিহাস ও তার নৃতাত্ত্বিক ক্রম বিকাশ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

আমাদের পাহাড়ে অনেক গুলো জাতির বাস। প্রতিটি জাতি তাদের নিজস্ব ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধশালী। তাদের রীতিনীতি আলাদা, ঘর বানানোর পদ্ধতি, তাদের ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারেও রয়েছে ব্যতিক্রম। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই এই ধরনের অসংখ্য কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের কারণে প্রতিটি জাতির এই স্বকীয় সম্পদগুলো আমরা হারিয়ে ফেলছি। এখনই যদি আমরা এই বিষয়ে নজর দিয়ে পাহাড়ের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এই বিপুল জ্ঞান ভাণ্ডার ও প্রাচীন কিংবদন্তিগুলোকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে লিপিবদ্ধ করার ব্যবস্থা করার সাথে সাথে এগুলোকে ধরে রাখার ব্যবস্থা না নেই তাহলে একদিন এর সবই পুরোপুরি নির্মূল হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত জাতিদের মধ্যে “পাংখোয়া” অন্যতম। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি (সাজেক উপত্যকা), বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি এবং পাশ্ববর্তী ভারতের মিজোরাম রাজ্য সংলগ্ন সীমান্ত এলাকায় পাংখোয়া জাতির বসবাস রয়েছে। উপরে উল্লেখিত পাংখোয়া জাতির মধ্যে প্রচলিত এই প্রাচীন কিংবদন্তিটি অনুবাদ করা হয়েছে ১৮৬৯ সালে প্রকাশিত ‘দ্যা হিল ট্র্যাক্টস অফ চিটাগং: অ্যান্ড দ্যা ডুয়েলার্স দেয়ার ইন’ বইটি থেকে। লেখক ‘ক্যাপ্টেন টি.এইচ লেউইন’ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর হয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে ডেপুটি কমিশনার হিসেবে কর্মরত থাকার সময় উক্ত বইটি লেখেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!