লাং তাং

গত বছর নেপাল থেকে ফেরার পর থেকেই মনে হচ্ছিল এবার আমার একা হিমালয়ে যাওয়া দরকার। নিজের সাথে অনেক বোঝাপড়া জমে গেছিল। আর সেই সাথে এত বছর ধরে পাহাড়ে কতটা টিকে থাকতে শিখলাম সেটা যাচাই করাও জরুরি হয়ে পড়েছিল। সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে শেষ পর্যন্ত সম্পূর্ণ একা হিমালয়ে আসতে পারলাম। একা একা হিমালয়ের দূর্গম গিরি ঘুরে বেড়াব ভাবতে যতটা রোমান্টিক লাগে এক্সিকিউশনের সময় ততটা লাগে না। সব বাদ দিলাম, মনমত একটা অব্জেক্টিভ খুঁজে বের করাই বেদম ঝামেলা। এতদিন পর্যন্ত প্রতিবার শক্তিশালী একটা দলের সদস্য হয়েই এসেছি। দলের কারনেই অনেক চিন্তা ভাবনা মাথাতেই আসে নাই। বাট সম্পূর্ণ একা থাকলে পুরো সিনারিও পালটে যায়। যেই বিষয়কে একসময় পাত্তাই দেইনি এখন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। আমি তিনটা অব্জেক্টিভের একটা সংক্ষিপ্ত তালিকা করেছিলাম। সেখান থেকে প্রথম দুটা বাদ দিয়ে তৃতীয়টাই শেষ পর্যন্ত এক্সিকিউট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমার প্রথম সোলো প্রজেক্ট হিসেবে আমি সম্পূর্ণ একা ৫১৮৩ মিটার উচ্চতার গাঞ্জা লা পাস অতিক্রম করার চেষ্টা করব। এই হাই পাসটি লাংতাং ও হেলামবু উপত্যকাকে কানেক্ট করে। বছরের মাত্র দুই মাস সেপ্টেম্বর অক্টোবর মাসেই শুধু এই পাস এক্সিসেবল থাকে। এই সিজনে আমি পাসে প্রচুর বরফ এক্সপেক্ট করছি যেটা আমার চ্যালেঞ্জকে আরও বাড়িয়ে দেবে। আমি দক্ষিন দিক অর্থাৎ হেলামবু উপত্যকা থেকে গাঞ্জা লা পাসের দিকে এপ্রোচ করে এর উত্তর দিক অর্থাৎ লাংতাং উপত্যকা দিয়ে বের হওয়ার চেষ্টা করব। রুটটিকে আরও ইন্টারেস্টিং করার জন্য আমি এর সাথে গোসাইকুন্ডকেও যোগ করে দিয়েছি। দুই হাজার মিটার থেকে শুরু করে চার হাজার সাতশ এরপর আবার তিন হাজারে নেমে গিয়ে আবার পাঁচ হাজারের উপর হাইট গেইন করতে হবে। এই রুটে আমাকে গাঞ্জা লা ছাড়াও লরেবিনা পাস (৪৭০০) ও আমা ইয়াংরি (৪২০০) পাস অতিক্রম করতে হবে। এক্লিমাটাইজেশনের জন্য আমি পাঁচ হাজার মিটারের সুরয়া পিক, চার হাজার আটশ মিটারের চোলাংপাতি ডান্ডা আরোহণ করার পরিকল্পনা করছি। রুট টা স্বাভাবিকভাবেই অনেক লম্বা হয়ে গেছে। ১৭ কেজির ব্যাকপ্যাক নিয়ে এত দীর্ঘদিন ধরে চড়াই উৎড়াই পেড়িয়ে আদৌ গাঞ্জা লা পাস অতিক্রম করতে পারব কিনা এখনো জানি না। আমা ইয়াংরি পাসে পর প্রায় ৬ দিনের জন্য আমি লোকালয় থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। ট্রেইলে কোথাও প্রয়োজনীয় কিছু যে পাব তার কোন গ্যারান্টি নেই। আর তাই এই ছয় দিনের জন্য আমাকে পুরো পথটাই সমস্ত রেশন ক্যারি করতে হচ্ছে। আমা ইয়াংরি পাস থেকে গাঞ্জা লা পাস পৌঁছানোর আগে আমাকে কমপক্ষে চারটা ক্যাম্প করতে হবে। এর মধ্যে একটা ক্যাম্পে আবার পানি নেই। এর মানে আমাকে ক্যাম্পের জন্য প্রয়োজনীয় পানিও এই সময় ক্যারি করতে হবে। সব কিছু যদি ঠিক থাকে, আমার যদি তেল অবশিষ্ট থাকে সাথে আবহাওয়া যদি ফেভার করে আর আমি যদি ঠিকঠাক ভাবে গাঞ্জা লা অতিক্রম করে ফেলতে পারি আমার প্রাইমারি অবজেক্টিভ ফুলফিল হয়ে যাবে। এরপরও যদি তেল অবশিষ্ট থাকে আর কাঁধে পায়ে জোর থাকে তাহলে হয়ত পাশের নায়া কাংগার দিকে একটু তাকিয়ে দেখব। আর নইলে কায়াঞ্জিন গোম্বা নেমে দুইদিন শুধু খাব আর ঘুমাব। ইয়াক চিজ খেয়ে গতরে আরেকটু শক্তি ঢুকিয়ে দেখব আশেপাশে কি কি আছে। আমার ম্যাপ বলছে এখানে পটেনশিয়াল সেকেন্ডারি অবজেক্টিভ হিসেবে আছে ইয়ালা, ব্যাডেন পাওয়েল, সেরগো রি, কিয়াঞ্জিন রি…

—-অভিযান থেকে ফিরে——-

শেষ পর্যন্ত আমার ২৩ দিন ব্যাপী হিমালয় পদযাত্রা শেষ হল। গত ২৪ তারিখে আমি গাঞ্জা লা পাস ক্রস করে ২৫ তারিখে কিয়াঞ্জিন গোম্বা গিয়ে পৌঁছাই। সেখানে ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক থাকলেও ৫০০ টাকা দিয়ে ওয়াইফাই খরিদ করে দিন দুনিয়ার খবর নেয়া বা দুনিয়াকে আমার খবর দেয়ার কোনটারই ইচ্ছা করে নাই। আমি যতটা ভেবে গিয়েছিলাম এই অভিযান তার চেয়েও কয়েকগুন কঠিন ছিল। আবহাওয়া, টেরেইন, পথ, স্নো কন্ডিশন একেক সময় একেকরকম খেল দেখিয়েছে। প্রচন্ড গরম যেমন পেয়েছি তেমনি আমার দেখা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে প্রলয়ঙ্করী ঝড়ও চাক্ষুষ করেছি। এতদিন পর্যন্ত বইপত্রে শুধু ‘ডিপ স্নো’ টার্মটা পড়েছি। এবার কোমর সমান তুষারে কদম ফেলতে কেমন লাগে তার স্বাদ পেলাম। পুরো ৬ দিন কয়েকটি কমলা ঠুটি কাক ছাড়া জীবিত কিছুর সাথে দেখা হয়নি। সব মিলিয়ে বড় কোন দূর্ঘটনা ছাড়াই শেষ হল আমার ‘লাংতাং ট্রায়াঙ্গল’ এর ট্রিনিটি প্রজেক্ট। গাঞ্জা লা পাসের অবস্থা কেমন ছিল সেটা বর্ণনা করতে আমার শব্দ ভান্ডারের সাহায্য নিতে হবে। আপাতত শুধু এতটুকু বলি আমার সলভ করা এখন পর্যন্ত এটা শ্রেষ্ঠ ধাঁধা ছিল। এই সিজনে আর কেউই গাঞ্জা লা ক্রস করে হেলামবু থেকে লাংতাং উপত্যকা যায়নি। একা একা গাঞ্জা লা অতিক্রম করেছি বলে ফেরার পথে পুরো লাংতাং জুড়ে ভালই খাতির জুটেছে কপালে। গত ২৩ দিনে আমি ৩ টি চূড়ায় আরোহণ করেছি আর ৩ টি পাস ক্রস করেছি। পিক গুলো হল গোসাইকুন্ড এরিয়ার চোলাংপাতি ডান্ডা (৪৮৭০ মিটার), চিয়ারকুং চুলি ( ৪৮৩০ মিটার) আর অনামী চূড়া (৫০৭০ মিটার)। আর পাস তিনটি হল লরেবিনা ( ৪৬১০ মিটার), আমা ইয়াংরি ( ৩৫৩৬ মিটার) ও গাঞ্জা লা (৫১৮২ মিটার)। এইবারের সব কিছু ‘তিন’ ময় ছিল। পিক ছিল ৩ টা, পাস ৩ টা, ফেইজ ছিল ৩ টা। এই ‘ট্রিনিটি’ যেন বজায় থাকে তাই কিয়াঞ্জিন রিন, সেরগো রি যাইনি (আসল কথা পাম্পে আর তেল ছিল না)। সেই সাথে সায়েব্রুবেসী দিয়ে না ফিরে থুলো সায়াব্রু আর থুলো বারখু হয়ে আবার ধুনচে তে ফিরে আসলাম। হিসেবমত একদিন বেশী হাঁটতে হলেও ত্রিভূজটা সম্পূর্ণ করতে পারলাম এতেই খুশি। এমন লাইন মিলাতে কেন যেন অসম্ভব ভাললাগে। গত ৩ সপ্তাহ অনেক চড়াই উৎড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। যারা এই কঠিন যাত্রাটিতে আমাকে সাহায্য করে গেছেন তাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা জানানোর ভাষা নেই। বিশেষ করে আমার স্প্যানিশ বন্ধু জেভিয়ারের প্রতি আমি অশেষ কৃতজ্ঞ। সেই সাথে মেলামচি গাঁওয়ের পেম্বা বেহনি ও তারকে ঘিয়াংয়ের লাকপা শেরপার পুরো পরিবারের কাছে ঋণী থাকব চিরকাল। সোহেল স্পিনিং ও জুমঘর ইকো রিসোর্টকে ধন্যবাদ এই অভিযানে সাথে থাকার জন্য। সেই সাথে ধন্যবাদ অদ্রি আর দ্যা কোয়েস্টকে অভিযানের সকল লজিস্টিকাল সাপোর্ট দেয়ার জন্য। এছাড়া মুসা, সাব্বির, সজীব, সায়মনকে বিশেষ ধন্যবাদ আমার জন্য এতবার প্যারা নেবার জন্য। এই অভিযান আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। ভবিষ্যতের জন্য বেশ ভাল রকম একটা কর্মশালা হয়ে গেল। এতটুকু বুঝতে পারছি, এখনো অনেক কিছু করার বাকি। এখন আমি আরেকটু বড়রকমের চ্যালেঞ্জের জন্য শারীরিক, মানসিক আর দক্ষতার দিক থেকে আরেকটু ভালভাবে প্রস্তুত। খুব তাড়াতাড়ি নতুন কোন ইন্টারেস্টিং প্রজেক্ট নিয়ে আবারও পথে নেমে পড়ব। আশা করি খুব তাড়াতাড়ি আমার অভিজ্ঞতাগুলো সবার সাথে শেয়ার করতে পারব। সাথে থাকুন… ধুনচে, ২৮ মে ২০১৮

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!