আজকে বিশ্ব ধরণী দিবস। এই দিন উপলক্ষ্যে গুগল দেখলাম বিশেষ ডুডল বের করেছে। ক্লাইমেট চেইঞ্জের টাইমলাইন দেখাচ্ছে। তবে আমাদের জন্য আর্থ ডে’র সবচেয়ে এপ্রোপ্রিয়েট ছবি বোধ হয় এটাই। বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার এক পাহাড়ি গ্রামে এভাবেই খাবার পানি সংগ্রহের জন্য রাত থেকে কলসের সিরিয়াল দেয়া হয়েছে। পাড়ার পাশ দিয়ে যেই ঝিড়ি বয়ে যেত সেটি মরে গেছে। সেখানে এখন একটি গর্ত করা হয়েছে। অল্প অল্প করে চুইয়ে আসা পানি গর্তে জমা হলে সিরিয়াল দেয়া কলসগুলো ভরার সুযোগ পায় পাড়াবাসি। একুয়াফিয়ার খালি হয়ে গেলে এই পানিটুকুও আর মিলবে না। তখন এই পাড়ার স্থান পরিবর্তন করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকবে না।
আমাদের পাহাড়গুলো কিভাবে পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে সেটি বোঝার জন্য একটু সচেতনতাই যথেষ্ট। সেদিন বলেছিলাম, আমাদের ইকো সিস্টেম অনেক জটিল একটি প্রক্রিয়া, যার কোন একটি এলিমেন্ট এদিক সেদিক হলেই পুরো সিস্টেমের উপর তার প্রভাব পড়ে। ঝিড়িগুলো থেকে রিসেন্টলি কয়েক বছর ধরে ব্যাপকহারে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। সেই পাথর দিয়ে পুরো বান্দরবান জুড়েই রোডনেটওয়ার্ক বানানো হচ্ছে। এখন ঝিরিতে নিশ্চল পাথরগুলো আজাইড়া পড়ে নাই। এই পাথরেরও একটা ভূমিকা আছে। ঝিরিগুলোতে এরা ন্যাচারাল ড্যাম হিসেবে কাজ করে। পানির গতি কমিয়ে দেয়। পানি তখন রিভার বেড দিয়ে মাটি চুইয়ে নিচের একুয়াফিয়ারে জমা হবার পর্যাপ্ত সময় পায়। ঝিরিতে যদি পাথর না থাকে তাহলে বৃষ্টির পানি দ্রুত গড়িয়ে ঢলের মত নেমে যায়, মাটির নিচে আর পানি যেতে পারে না।
এরপর ধরি নির্বিচারে বনভূমির গাছকাটা, বনায়নের নামে বানিজ্যিক গাছ লাগানো, কিটনাশক মেরে রাস্তার দুপাশের সব ভেজিটেশন মেরে ফেলা, জুম চাষ, বানিজ্যিক ফল বাগান সবই এই পানি নাই হয়ে যাওয়ার জন্য দায়ী।
নিজের একটা গল্প বলি, মদকের রিজ লাইন ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছি। মাথার উপর চড়া রোদ। রিজের উপর বড় গাছপালা ঘনত্ব স্বভাবতই কম থাকে। এদিকটা খুব খাড়া বলে স্বাভাবিকের চাইতেও গাছপালা একটু কম। শুধু একটু পর পর বাঁশঝাড় আছে বলেই যা রক্ষা। এদিকে প্রচন্ড গরম আর আদ্রর্তার কারণে আমাদের সাথে থাকা পানিও প্রায় শেষ। এক পর্যায়ে গলা ভেজানোর জন্য এক ফোঁটা পানির জন্যই শুধু একটা খাঁজ ধরে আমরা নীচে নেমে যেতে থাকি।
আমাদের ভাগ্য সেদিন খুবই ভাল ছিল তা না হলে মাত্র পঞ্চাশ ফিটের মত নামতেই দেখি ছোট একটি ঝর্ণা, মাটি চুইয়ে চুইয়ে সেখান থেকে পানি বের হচ্ছে। কিন্তু ঠিক ঝর্ণা থেকে পানি খাবার কোন উপায় নেই, জায়গাটি পানির স্পর্শ পেয়ে কাদা কাদা হয়ে আছে।
পানির ফ্লো ধরে আরেকটু নীচে নেমে দেখা গেল দুই ফিট ব্যাসের একটি গর্ত মত জায়গায় পানি জমে আছে, সেই গর্ত ওভার ফ্লো করে পানি আবার নিচের দিকে চলে যাচ্ছে। অবাক করা বিষয় হল গর্তের পানি একেবারে টলটল করছে। তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হল, গর্তের মধ্যে বেশ বড়সর, কালো রঙা একদাঁড় ওয়ালা একটি চিংড়িংও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিন পাহাড়ের এত উপরে এই চিংড়িকে দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার মাথায় প্রথমেই যেই প্রশ্নটা জেগেছিল সেটা হল, এমন একটা জায়গায় কই থেকে আসলো এটি?
সেই নিঃসঙ্গ চিংড়িকে দেখে প্রথমবারের মত আমি ঝিরিতে বাস করা প্রাণীগুলোর প্রতি সত্যিকারভাবে আকৃষ্ট হয়ে গেলাম। আমাদের ঝিরিগুলোয় কত ধরণের যে প্রাণী বাস করে তার বুঝি কোন লেখাঝোকা নেই এখনো। আমি নিজেই চার ধরণের চিংড়ি দেখেছি। সাদা রঙা, কালো, কোনটার এক দাঁড়, কোনটার দুই। সেই সাথে আছে ছোট বড় কাঁকড়া, শামুক, কচ্ছপ সহ আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব প্রানী।
এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো বিশেষ করে চিংড়ি আর কাঁকড়াগুলো ঝিরির পুরো ইকো সিস্টেমের জন্য যে কতটা অপরিহার্য সে কথা কিন্তু আমরা একবারও গভীরভাবে ভেবে দেখি না। এরা আমাদের ঝিরির ক্লিনিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। দিন রাত ২৪ ঘন্টা, সারা বছর জুড়ে। এরা কোন রেস্ট নেয় না, ছুটি নেয় না, ঝিরির পানি সুপেয় রাখার জন্য আমরা তাদের কোন পেমেন্ট দেই না। তারা নিরলসভাবে পানিতে থাকা অর্গানিক পার্টিকেল, ময়লা আবর্জনা, বিশেষ করে পঁচা পাতা পরিষ্কার করে পানিকে সুপেয় করে। একই সাথে অন্যান্য মাছ ও প্রানীদের খাবার যোগান দেয়। এইভাবে তারা স্ট্রিম বেড, অর্থাৎ ঝিরির নিচের জমিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে পানির গুনগতমান বৃদ্ধি করে। অনেকেই দেখবেন একুরিয়ামে ফ্রেশ ওয়াটার স্রিম্প রাখেন ঠিক এই কাজের জন্য। পুরো ইকো সিস্টেমের সবচেয়ে ভাইটাল যেই পানি, সেটিকে যারা ঠিকঠাক রাখে তারাই সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত থাকে।
বাঘ ভাল্লুক বড় প্রাণি, সেই সাথে অনেক ইলিউসিভ। এদের নিয়ে তাও কিছুটা কথাবার্তা হয় কিন্তু আমাদের পাহাড়ের এই একুয়াটিক ইকো সিস্টেম নিয়ে আমার মনে হয় না কারও কোন মাথাব্যথা আছে। এটলিস্ট এদের গুরুত্বটা বুঝবার মত এওয়ারনেসও আমাদের মধ্যে নেই। আর আমার মতে আমাদের এই একুয়াটিক ইকোসিস্টেম সবচেয়ে বড় রকমের হুমকির মধ্যে আছে।
বান্দরবানের চারিদিকে এখন গাড়ির রাস্তা বানানো হচ্ছে। প্রাথমিক অবস্থায় সেখানে তো মাটিই থাকে। সেই মাটিতে ঘাস আর অন্যান্য গাছপালা যেন আর জন্মাতে না পারে তাই প্রাথমিক অবস্থায় সেখানে হাই পটেন্সি আগাছা নাশক বিষ প্রয়োগ করা হয়। সরকারীভাবেই রাস্তার দুই পাশে এই বিষ ছিটানো হয়। আর বিশ্বাস করুন এই বিষ স্প্রে করার কিছুক্ষণের মধ্যে ঘাস টাস, লতা পাতা সব কিছু এসিডের মত ঝলসে যায়। পরিকল্পনাহীন স্প্রে করা এই বিষ মাটির সাথে মিশে, বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে ঝিরিগুলোতে পৌঁছে যায় আর ঘাসের মত ঝিরিতে বসবাসকারী প্রানীদেরও মেরে ফেলে। এই ঘাতক দেখা যায় না, অনুভব ও করা যায় না, কাউকে বলবে তারা পাত্তাই দেবে না। বাট দ্যাটস এলার্মিং!
আমি রাস্তার কথা এই কারণে বললাম যে আর কিছুদিনের মধ্যেই বান্দরবানের দূর্গম থেকে দূর্গম জায়গায় রাস্তা চলে যাবে। আর ভঊগলিক কারণে রাস্তা গুলো রিজক্লাইনের উপর দিয়েই করতে হবে। আর রিজলাইনের উপর এভাবে বিষ প্রয়োগ করলে সেটি ধুয়ে দুই সাইডের ঝিরিগুলোতেই ছড়িয়ে পড়বে। সাঙ্গু মাতামুহুরির লাইফ লাইনগুলো, ট্রিবিউটারিগুলো একেবারে ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিছুদিন আগে থানচি থেকে বান্দরবস্ন শহরে ফেরার পথে খেয়াল করে দেখলাম পুরো চিম্বুকজুড়ে কাজু বাদামের গাছ লাগানো হয়েছে। তিন বছর পর গিয়ে দেখি পুরো ল্যান্ডস্কেপই পরিবর্তন হয়ে গেছে। আগে চিম্বুকের এই জমিগুলোতে মিশ্রফল, বিশেষ করে আম গাছই লাগানো ছিল। কিছুদিন আগেও বান্দরবানে আম্রপালির চাষ বেশ লাভজনক হিসেবে দেখা হয়। এসব জেনেটিক্যালি মডিফায়েড স্পিসিসের সবসচেয়ে বড় ড্রব্যাক হচ্ছে এর লাইফস্প্যান। কমবেশী পনের বছরের এদের লাইফস্প্যান শেষ হয়ে যায়, আর ফল দেয় না। আমের বদলে কর্পোরেশনগুলোর নতুন মুলা হচ্ছে- কাজু বাদাম।
শহরে ঢুকতে এখন চোখে পড়ে বিশাল বিশাল কাজু গাছের নার্সারি। বিশাল বিশাল জায়গা লিজ নিয়ে স্থানীয় সব গাছপাল উপড়ে ফেলে লাগানো হচ্ছে সারি সারি কাজু বাদামের গাছ। বলাই বাহুল্য অর্থনৈতিকভাবে বেশ লাভজনক এই কাজু চাষ। তিন চার বছরের মধ্যেই ফলন দেয়া শুরু করে, বাজারে এর ভালো দামও পাওয়া যায়। তেমন একটা দেখভালও করতে হয় না। কষ্ট কম, লাভ বেশী। সরকারীভাবেও কাজুচাষের জন্য স্থানীয়দের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। কৃষিব্যাঙ্ক থেকে ভালো লোন টোনও পাওয়া যায়। অনেককেই দেখলাম ট্রেডিশনাল জুমচাষের জমির পুরোটাতেই কাজু লাগাচ্ছে।
জুম চাষের অল্টারনেটিভ হিসেবে কাজু বাদামের মনোকালচার আমার কাছে কোনভাবেই ভালো কিছু মনে হয় না। উল্টো এর ক্ষতির দিকটাই বেশী। কাজু গাছ একপ্রকার বায়োক্যামিকেল উৎপাদন করে। এদেরকে বলে এলেলোক্যামিকেলস। এই রাসায়নিকের কাজ হল নিজেদের গ্রোথ ঠিক রাখতে আশেপাশে অন্যকোন কম্পেটিটরকে টিকতে না দেয়া। এই ফেনোমেননকে বলে এলেলোপ্যাথি। এত এত কাজু গাছের মনোকালচার এলেলোপ্যাথির কারণে আশেপাশে আর কোন গাছকে জন্মই নিতে দেয় না। ফলে পুরো এলাকা আস্তে আস্তে করে তার বৈচিত্র্য হারাতে থাকে। এর ফলে ডিসরাপ্ট হয় ঐ এলাকার পুরো পলিনেশন নেটওয়ার্ক। আশেপাশে অন্যকোন ফুল না থাকলে শুধুমাত্র কাজু ফুলের উপর ঐ রিজিওনের মৌমাছি, প্রজাপতি ও অন্যান্য পোকামাকড় পাখি নির্ভর করতে পারে না। তখন তারা খাবারের খোঁজে অন্য এলাকায় চলে যায়। পলিনেটর না থাকলে এলাকা্র পরাগায়ন প্রক্রিয়া সাংঘাতিকভাবে ডিস্রাপ্ট হয়। এভাবে পুরো এলাকাটাই প্রাণবৈচিত্র হারিয়ে ফেলে। এর ফলে পাঁচ সাত দশ বছর পর কাজুর ফলন ও কমতে কমতে একসময় নাই হয়ে যাবে। এরমধ্যে ক্ষতি যা হবার তাতো হয়েই গেছে।
আমরা সবাই একটু সচেতন হই। সামনে অনেক খারাপ দিন আসছে।