মে, ১৯৯২।

প্রচন্ড ঝড়ো বাতাস আর অস্থিমজ্জা জমাট করে দেয়া ঠান্ডার মধ্যে এভারেস্টের ক্যাম্প থ্রি থেকে ক্যাম্প ফোর-এর দিকে যাচ্ছে চার ভারতীয় পর্বতারোহী দল। কিন্তু প্রকৃতির সাথে লড়াই করে ক্যাম্প ফোর-এ আর যাওয়া হলনা তাদের। এগিয়ে যাওয়া আর সম্ভব নয় বুঝতে পেরে নিচের ক্যাম্প থ্রি-তে নেমে আসতে শুরু করে তারা। চারজনের মধ্যে দুইজন রাত গভীর হওয়ার আগেই নিরাপদে ক্যাম্প থ্রি-তে নেমে আসে। কিন্তু দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পরেও বাকি দুই আরোহীর দেখা পাওয়া যায় না। তারা যেন একেবারে উধাও হয়ে গিয়েছে!

ঐদিন সাউথ কোল-এ আরও দুইটি দল ক্যাম্প সেট করেছিল। দলদুটির একটি ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের এবং অন্যটি ডাচদের। ডাচদের দলনেতা ছিলেন রোনাল্ড নার নামের একজন পর্বতারোহী। সে রাতে সাউথ কোল-এ কি ঘটেছিল তার বর্ণনা দিয়েছেন তিনি তার লেখা “অনলি দ্য সামিট কাউন্টস” বইতে।

তিনি লিখেছেন,

“ভয়ংকর বাতাসের গর্জনকে ছাপিয়ে হঠাৎ একটি ভীতিকর, রক্ত হিম করা আর্তচিৎকার শুনলাম…”

দলের একজন শেরপা বেরও হয়েছিল সেই চিৎকারের উৎস খুঁজে দেখতে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি করেও কিছু না পেয়ে আবার সে তাঁবুতে ফিরে আসে। ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের দলটিও এই চিৎকার শুনতে পেয়েছিল। তারাও খুঁজে দেখতে বের হয়েছিল। কিন্তু কিছু না পেয়ে পুনরায় যার যার তাঁবুতে ফিরে আসে সবাই।

ভোরের প্রথম আলোতে, ঘড়িতে বাজে তখন প্রায় ছয়টা, এমন সময় বর্ডার পুলিশের সেই দলটির একজন নারী সদস্য ডাচ দলের তাঁবুতে আসে এবং জানায় যে তারা একজন আহত লোককে খুঁজে পেয়েছে। লোকটির দ্রুত সাহায্য প্রয়োজন। কি ধরনের সাহায্য প্রয়োজন জিজ্ঞেস করা হলে সে কোন উত্তর দিতে পারে না। তাকে কেমন যেন বিহ্বল দেখাচ্ছিল তখন। এরই মধ্যে ইন্ডিয়ান দলের আরেক সদস্য এসে জানায় সাহায্যের আর কোন দরকার নেই। আহত লোকটি মারা গিয়েছে।

-“আমরা তাকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সে এখন এসব কিছুর উর্ধ্বে।“, জানালো মেয়েটি।
-“ঠিক কি হয়েছিল, জানো কিছু?”, নার জিজ্ঞাসা করে মেয়েটিকে।
-“আমার কোন ধারণাই নেই। কিন্তু আমার দলের কেউই এখানে আর থাকতে চাচ্ছেনা, নিচে নেমে যেতে চাচ্ছে সবাই।”

এই কথা বলার অল্প কিছুক্ষণ পরেই ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের দলটি তাদের শেরপাসহ নিচে নেমে গেল।
ক্যাম্প ফোর থেকে ক্যাম্প থ্রি-তে নেমে আসার সময় আগের রাতে যে দু’জন আরোহী হারিয়ে গিয়েছিল, আহত ব্যক্তিটি ঐ দু’জনের একজনই ছিল। ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের দলটি অল্প কিছুদূর গিয়েই হারিয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজে পায়। ফিক্সড রোপে তার দেহটি তখনও ঝুলছিল। প্রচন্ড ক্লান্তি আর ঠান্ডায় হাইপোথারমিয়ায় রাতের কোন এক সময় সম্ভবত সে মারা যায় এবং তার সঙ্গীরা তাকে এভাবে রেখেই চলে যায়। সাউথ কোলে থাকা সবাই রাতে যে চিৎকারটি শুনেছিল, তা সম্ভবত এই হতভাগ্য লোকটিরই ছিল।

ইন্ডিয়ান বর্ডার পুলিশের দলটি যখন নেমে যাচ্ছিল, সে সময় ডাচ দলের সদস্যরা ব্যস্ত ছিল এই অবস্থায় তাদের কি করণীয় তা ঠিক করতে। এভারেস্টের ঐ উচ্চতায় প্রচন্ড ঠান্ডা আর ঝড়ো আবহাওয়ায় সামিট চেষ্টা করা মৃত্যুরই নামান্তর। আবার এখানে থাকলে এই আবহাওয়া তাদের শরীরের সমস্ত শক্তি নিংড়ে নিবে। সবদিক বিবেচনা করলে ক্যাম্প টু-তে নেমে যাওয়াই হবে তাদের জন্য সবথেকে ভাল। কিন্তু তা সত্বেও তারা ওখানেই থেকে গেল। যার যার স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে চার ঘন্টার মত সময় কাটিয়ে দিল একেকজন। ঘন্টা চারেক পর একজন শেরপা উঠে বের হল প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে। সাথে সাথেই সে কাঁপতে কাঁপতে ছুটে আসল তাঁবুর মধ্যে। মুখটি তার আক্ষরিক অর্থেই রক্তশুণ্য হয়ে গিয়েছিল ভয়ে। কাঁপতে কাঁপতে সে হড়বড় করে বলতে লাগল,
“লাশটি এদিকে চেয়ে হাত নাড়ছে !”

হতভম্ব রোনাল্ড নার শেরপার কথা শুনে কি হয়েছে দেখার জন্য তাঁবু থেকে মাথা বের করে দূরে তাকিয়ে যা দেখল তাতে সে নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছিল না। ফিক্সড রোপে আটকে রয়েছে মানুষটির দেহ। এতক্ষণ ওদিকে চোখ পড়েনি বলে দেহটি দেখতে পায়নি ওরা কেউই। ফিক্সড রোপে আটকে দেহটি পড়ে রয়েছে তুষার ঢাকা পাথরের মাঝে। নার অবাক চোখে দেখতে পেল লোকটির এক হাত খুব ধীরে ধীরে উপরে উঠছে আবার নেমে আসছে দেহের পাশে বরফের উপর। তাঁবু থেকে ভেসে আসা মানুষের কণ্ঠস্বর মৃতপ্রায় লোকটির মধ্যে এক অতিমানবীয় শক্তি এনে দিয়েছিল হয়তো। শরীর ও মনের জোর সব একত্র করে সেই শেষ শক্তিটুকু দিয়ে হাতটি উঠিয়েছিল লোকটি। যদি কেউ তাকে দেখতে পায় এবং নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় সেই আশায়।

ডাচ দলটিতে ছিল পাঁচজন ক্লাইম্বার এবং দুইজন শেরপা গাইড। পড়ে থাকা লোকটিকে উদ্ধার করে আনার জন্য এতগুলো মানুষ যথেষ্ট ছিল। খুব বেশি হলে মানুষটি হয়তো তাদের থেকে ২০-৩০ মিটার দূরে রয়েছে। সাতজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের পক্ষে এটুকু দূরত্বে গিয়ে একজন আহত লোককে উদ্ধার করা খুব বেশি অসম্ভব কোন কাজ ছিল না।

এদিকে তখন দলনেতা রোনাল্ড নার আর বেইজক্যাম্পে থাকা ডাক্তারের মধ্যে এক অদ্ভুত কথোপকথন চলছিল রেডিওতে।

মৃত মানুষ যে কোনমতেই নড়াচড়া করতে পারবে না এটা নিশ্চিত হয়ে নার ডাক্তারকে আহত লোকটির শারীরিক অবস্থা কি হতে পারে সে সম্পর্কে তখন জিজ্ঞাস করছিল। বেইজক্যাম্পে থাকা ডাক্তার নারকে জানালো যে, লোকটি যেহেতু অনেক লম্বা একটা সময় ঐ বৈরী আবহাওয়ায় কোনরকম আশ্রয় ছাড়া পড়ে ছিল, তাই এই মুহুর্তে তার জন্য কিছু করা বা তাকে বাঁচানো একপ্রকার অসম্ভবই বলা যায়।

কথাগুলি যে একেবারেই অমূলক, তা না। কিন্তু তারপরেও হতভাগ্য লোকটির প্রকৃত অবস্থা জানা সম্ভব ছিল একমাত্র তার শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে। কিন্তু এই কাজটুকুও কেউ সেদিন করতে যায়নি।

দলনেতা নার পাশের তাঁবুতে গেল কি করা যায় তা নিয়ে দলের বাকি সবার সাথে আলোচনা করতে। শেরপা দুইজন প্রচন্ড ভয় পেয়ে গিয়েছিল পুরো ঘটনাটায়। তারা ঘন ঘন বলছিল নিচে নেমে যাওয়ার জন্য। মৃত মানুষের জেগে ওঠার ব্যাপারটি ছিল তাদের জন্য অত্যন্ত অশুভ কিছুর সংকেত। হ্যান্স এন্টারবশ নামে দলের আরেকজন সদস্যও চাচ্ছিল শেরপাদের সাথে নিচে নেমে যেতে।
দলের সবার সাথে আলোচনার পর শেরপা দুইজন এবং হ্যান্স নিচে রওনা হয়ে যায়।

এদিকে তাঁবুর আশ্রয়ে থাকা রোনাল্ড সিদ্ধান্ত নিল যে হতভাগ্য লোকটির জন্য তারা আর কিছুই করতে পারবে না। নার তার বইয়ে লিখেছিল,

‘’লোকটি নিজেই তার মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছে। আমি চাইনা তাকে সাহায্যের চেষ্টা করতে গিয়ে আমার দলের কেউ কোন আঘাত পাক বা আহত হোক। লোকটির এই অবস্থায় তাকে সাহায্যের চেষ্টার কোন অর্থই হয়না।“

“কিন্তু সে একজন মানুষ! সে এখনও বেঁচে থাকতে পারে। তার জন্য আমাদের সত্যিই কিছু করা উচিত, তাইনা?!”- হতাশার সুরে বলে উঠল দলের আরেক সদস্য হ্যান্স ভ্যান মুলেন। কিন্তু দলনেতা নার কোনকিছুই সাহায্য করতে রাজি হল না।

লোকটি খুব সম্ভবত রাত দেড়টা থেকে এখানে পড়ে রয়েছে। তার আগের সারাদিন সে ক্লাইম্ব করেছে। কম করে হলেও নয়ঘন্টা লোকটি কোনরকম আশ্রয় ছাড়া খোলা জায়গায় প্রচন্ড ঠান্ডা ও ঝড়ো বাতাসের মধ্যে পড়ে আছে। তার শরীরের তাপমাত্রা এতটাই কম হবে যে তাকে যদি সামান্যতম নড়াচড়াও করা হয়, কিংবা অক্সিজেনও দেয়া হয়, তাও তার জন্য উলটো হয়তো খারাপ হয়ে দেখা দিতে পারে। বলাই বাহুল্য যে সেখানে এমন কেউ ছিল না যে গিয়ে বরফের মধ্যে পড়ে থাকা লোকটিকে নিরীক্ষা করবে।

নার যদিও আর সবার হতাশা খুব ভাল করেই বুঝতে পারছিল, কিন্তু তারপরেও সে ঐ হতভাগ্য লোকটির জন্য সেদিন কিছু করেনি আর কাউকে কিছু করতেও দেয়নি।

[১৯৯৮ সালের দ্যা অ্যাল্পাইন জার্নালে জো সিম্পসন এর লিখা আর্টিকেল ‘ডেডম্যান ওয়েভিং’ অবলম্বনে ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!