২৫ অগাস্ট ২০১৭

এক.

আমার ছোটবেলা কেটেছে খুব পুরনো জমিদার স্টাইলে বানানো দূর্গের মত একটা বাড়িতে। আমাদের বাসার খোলা উঠান আর ছাদ ছাড়া আমার ঘুরাঘুরি করার অন্য কোন জায়গা ছিল না। আমি এমন একটা পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম যেখানে বাবারা তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে মাঝে মাঝে পার্কে টার্কে এদিক সেদিক বেড়াতে বের হয় না। হয়ত একবার দু’বার সেগুলোই চিরদিনের স্মৃতি। এখানে বাবারা অন্য জগতের মানুষ। আমাদের কাজ ছিল শুধু তাদের কাছ থেকে দূরে দূরে থাকা। তখন আমি ছিলাম বংশের সবচেয়ে ছোট ছেলে। তাও আবার পপুলার বিলিফ ছিল আমি দাদার রিইনকারনেশন ফর্ম। তাই আমাকে একদিকে সবাই যেমন পাগলের মত ভালবাসত অন্যদিকে আমার উপর নজরদারিও চলত কড়া রকমের। আমি চুলার আগুন নিয়ে খেলছি কিনা, সিঁড়ির রেলিং এর উপর বসে স্লাইড করে নামছি কিনা, দরজা খোলা পেয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছি কিনা, ঢাকনা খোলা টাংকিতে উঁকি দিচ্ছি কিনা; আমার বিশাল পরিবারের কেউ না কেউ আমার জন্য ওঁত পেতেই থাকত। আম্মু সবচেয়ে বেশী ভয় পেত পানিকে। কখনো বোধ হয় আম্মু এই বিষয়ে কোন রকম প্রফেসি শুনেছিল। এখন পর্যন্ত সে আমাকে নিয়ে নাকি প্রায় সময়ই পানি রিলেটেড বাজে স্বপ্ন দেখে। আমি কোথাও যেতে নিলে সে প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, ‘ঐখানে পানিতে নামবি নাতো?’ এই করে করে আমাকে ছোটবেলায় সাঁতার টা শিখালো না। অন্যদিকে নিজে আবার শীতলক্ষ্যায় সাঁতরানো মেয়ে। কেমন লাগে। তো আমি যেন অক্ষত থাকি তাই সবার চেষ্টা ছিল আমাকে কম্বলে পেঁচিয়ে পুঁটলি বানিয়ে তাকের উপর তুলে রাখবে। তখন এরা যদি বুঝত যে শুকনো বালি কখনো মুঠ করে ধরতে হয় না। আঙুলের ফাঁক দিয়ে সব বেড়িয়ে যায়। তাহলে আমার ভাগ্যের হিসাব একটু অন্যভাবে লিখা হত।

দুই.

আমার দাদা বাড়ি যদি দূর্গ হয়ে থাকে তাহলে আমার নানা বাড়ি হল স্বাধীনতা চর্চার তীর্থস্থান। হয়ত এমন একটি বাড়িতে ভূমিষ্ঠ হয়েছিলাম বলেই জন্মলগ্ন থেকেই একটি বিদ্রোহী স্বত্বা আমার মধ্যে ঢুকে গেছে। খুব ছোটবেলায় মাঝে মাঝে আমরা নানু বাসায় বেড়াতে যেতাম। বিশেষ করে শীতকালে কয়েকদিন গিয়ে থাকা হত। সেইদিন গুলোর জন্যই বোধ হয় সাড়া বছর ধরে অপেক্ষায় থাকতাম। আমার নানুবাসা ছিল অনেক খোলামেলা। বাসার নীচে লম্বা উঠান। পিছনে এক চিলতে খোলা জায়গা। সেখানে কয়েকটি ডাব গাছ, কচুর জঙল আর পেয়ারা গাছ। কচুর জঙলের পরেই বিশাল একটি পুকুর। বাসার সামনের অংশে লাগোয়া একটা টিনশেডের ঘর। তার পাশেই ছিল আরেকটা পেয়ারা গাছ। আর ছিল আমার দুই মামা, যারা আমাকে হাতে ধরে নানা রকম দুষ্টামি শিখিয়েছে। দু’তলার বারান্দার রেলিং থেকে ঝুলে নিচের কার্নিসে পিঠ ঠেকিয়ে কিছু দূর এগিয়ে টিন শেডের উপর লাফ দেয়া। টিন শেডে উলটা পালটা পা দেয়ায় টিন দেবে মড় মড় করে উঠত। তখন মামারাই শিখেছিল টিনের চালে গিঁট ধরে হাঁটার নিয়ম। এরপর ডালে ডালে বেয়ে গাছ থেকে পেরে গয়া খাওয়ার আনন্দ। পেয়ারা কে আমরা বলি গয়া। কেন গয়া বলি সেটা আমি জানিনা। গয়া খেতে গিয়ে কতদিন যে ডাইয়ার কামড় খেয়েছি তার কোন হিসাব নেই।

কখনো বা বড় মামা বলত,’কাল্লু বাথরুমের উপরের শেলফে তোর নানার টুল বক্স টা নিয়া আয়, তোরে একটা মজার জিনিস দেখাই। রান্না ঘরে আমার জন্য পোলাও রন্ধনরত নানির চোখকে ফাঁকি দিয়ে জানালা বেয়ে তর তর করে উপরে উঠে যেতাম। নামিয়ে আনতাম সেই জাদুর বাক্স। স্ক্রু ড্রাইভার, প্লাস, ড্রিল মেশিন, তারকাটা সহ চেনা অচেনা আজব সব বস্তুতে বোঝাই সেই বাক্স। বড় মামা তখন রুপালি রাংতা দিয়ে তারের সাথে তার জোড়া লাগানোর জাদু দেখাত। এই জিনিস শেখার পর আমাকে কিনে দেয়া কোন গাড়ি আর আস্ত ছিল না। সব ক’টির মোটর খুলে সায়েন্টেফিক এক্সপেরিমেন্ট করতাম। রেডিও ভেঙে পাওয়ারের লাল লাইট, টেবিল ফ্যানের প্লাগ কেটে প্রয়োজনীয় তারের সংস্থান করতাম। কিসের সাথে কি জোড়া দিয়ে যে কি বানাতাম তখন নিজেও কি বুঝতাম তখন। বড় হয়ে দেখি ছোটবেলার এই দুষ্টামি গুলাই পরে সার্কিট আর সিরিজের পড়ালেখার বিষয়। খামোখাই আব্বু-আম্মুর হাতে মার খেয়ে গেছি। আগে জানলে তো একচোট ভাষন কপচে দেয়া যেত।

তিন.

আমার জীবনের প্রথম বন্ধু হল জ্যোতি। জ্যোতির সাথে আমার সম্পর্ক খুব জটিল। জ্যোতি আমার মায়ের আপন ফুপুর ছোট ছেলের ছোট ছেলে। ও আমার মা’কে ডাকে ফুপু আমি তার বাবাকে ডাকি মামা। কিন্তু আমাদের মধ্যকার সম্পর্কের জটিল সমীকরণ কখনোই আমি বুঝার চেষ্টাও করিনি। সম্পর্ক যাই হোক, জ্যোতি তখন একমাত্র সমবয়সী ছেলে আমার জীবনে যার অস্তিত্ব আছে। নানু বাসায় গেলেই আমরা সারাদিন একসাথে থাকতাম। কখনো ও চলে আসতো নানু বাসায়। কখনো আমি তাদের বাসায় চলে যেতাম। একসাথে খেতাম, খেলতাম আর রোমাঞ্চের খোঁজে এদিক সেদিক ঘুরে বেড়াতাম। ছোটবেলার সেই বন্ধুত্ব বড় হতে হতে কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। স্কুলে পড়ার সময়েও মাঝে মাঝে দেখা সাক্ষাৎ হত। কিন্তু এখন সেটাও আর হয়ে উঠে না। অনেকদিন পর আজ জ্যোতির সাথে দেখা। দুজনেই চুপচাপ পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলাম। সে শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘আজান দিয়ে দিসে। এখন আমাদের রওনা দেয়া উচিৎ না।’ আমি শুধু বললাম ‘হুম’। এরপর পুরটা সময় আমরা কেউ কারো সাথে কথা বলিনি।

চার.

  • আশিক তোর ছোটবেলার কথা মনে পড়ে? নানা যে আমাদের নিয়ে ভোরবেলা হাঁটতে বের হত?
    -হ্যাঁ। রেললাইন ধরে ধরে একেবারে চানমারির টিলা পর্যন্ত। একবার তো আমি টিলার উপর থেকে পড়েও গিয়েছিলাম।

আমার খুব মনে আছে। পাহাড়, ট্রেকিংয়ের সাথে পরিচয় তো আমার সেই ছটবেলা থেকেই। ফজরের নামাজ পড়েই নানা আমাকে আর জ্যোতিকে নিয়ে হাঁটতে বেড়িয়ে পড়ত। ছোট ছোট পায়ে রেললাইনের স্লিপারের উপর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করতাম। মাঝে মাঝেই ফাঁক গুলো বড় হয়ে যেত। পা দিয়ে নাগাল পেতাম না। আকসির চাচার বাসার সামনে দিয়ে একটা নালার উপর দিয়ে লাইন চলে গিয়েছিল। ওই ফাঁকা জায়গা টুকু পার হবার সময় খুব ভয় লাগত। এরপর একসময় আশিক হল। আশিক একটু বড় হবার পর আমার আরেকটি সঙ্গী জুটল। নানা আমাকে আর আশিককে নিয়ে ভোরে বেড়িয়ে যেত। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকাল গুলোতে আমরা চলে যেতাম চানমারি।

জায়গা টার নাম আসলে চাঁদমারি টিলা। মুখে মুখেই সেটি চানমারি হয়ে গেছে। অনেক বড় হয়ে জেনেছি এটি আসলে আর্মিদের ফায়ারিং প্র্যাকটিস গ্রাউন্ড। এই টিলার আড়ালে তারা বন্দুক দিয়ে সই সই খেলে। কিন্তু তখন তো এটিই আমাদের জন্য মস্ত একটি পাহাড়। কত খাড়া আর উঁচু। টিলার উপরে বিশাল বিশাল গাছ। অনেক কষ্ট করে হাঁফাতে হাঁফাতে উপরে উঠতে পারলে অনেক নীচে শহর দেখা যায়। কি অদ্ভুত। কি সুন্দর। আমার খুব মনে আছে এই টিলার উপর থেকেই আমার চোখের সামনে বিস্তৃর্ন কুয়াশার চাদর দেখেছিলাম। এই কিছুদিন আগেও টিলাটির অস্তিত্ব ছিল। এখন মাটি কাঁটতে কাঁটতে ওই জায়গায় বিশাল পুকুর হয়ে গেছে।

আবার রেল লাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে চলে আসতাম আকসির চাচাদের বাড়ি। আকসির চাচার বড় ভাই জালাল নানার বাসায় আড্ডা দেয়া আমার নানার প্রত্যহ একটা রুটিন ছিল বোধ হয়। এখানে খুব মজার একটা বিষয় আছে। জালাল নানা হল আমার নানার বন্ধু তাই উনিও সম্পর্কে আমার নানা হন। আর উনার ছোট ভাই আকসির চাচা আমার বড় চাচার বন্ধু তাই উনি সম্পর্কে আমার চাচা হন। খুবই জটিল সমীকরণ। এই জালাল নানা হলেন নারায়নগঞ্জের অর্ধেক শিশু-কিশোরের বড় টিচার ওরফে ত্রাস আয়েশা জালালের হাজব্যান্ড। এই এক মহিলা যাকে আমি এককালে যমের মত ভয় পেতাম। অবশ্য উনাকে ভয় পেত না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া বিরল। বোধ হবার পর আমার জালাল নানার জন্য একপ্রকার মায়াই হত।

মাঝে মাঝেই যাওয়া হত আকসির চাচার ককশিট ফ্যাক্টরিতে। সাদা সাদা ককশিট সেখানে তৈরী করা হত। ককশিটের গুঁড়া স্তুপ করে রাখা থাকত। আমরা উড়ে গিয়ে সেখানে ডাইভ দিতাম। উপরে ছুঁড়ে দিয়ে স্নোফল স্নোফল খেলা খুবই উপভোগ করতাম সেসময়। কত ছেলেমানুষই না ছিলাম আমরা।

পাঁচ.

আজকে নানা মারা গেল। ভোরবেলা খবরটি শোনার পর কেন জানি একপ্রকার স্বস্তি অনুভব করলাম। অনেক বয়স হয়েছিল নানার। তারপরেও এই কিছুদিন আগ পর্যন্ত উনি হাঁটতে চলতে পারতেন। নানী মারা যাবার পরেও তিনি সব বিষয়ে স্বাবলম্বী ছিলেন। নিজের সব কাজ নিজে করতেন। প্রতিদিন জামাতে ফজরের নামাজ পড়তেন। হুট করেই কয়েকবার স্ট্রোক করে শেষদিকে একেবারেই প্যারালাইজড হয়ে যান। কোনদিন কারো মুখাপেক্ষী না থাকা নানা অন্যের ভরসায় চলে যান। তার খাওয়া-দাওয়া, পায়খানা-প্রশাব সব অন্যের ভরসায় চলে যায়। এখনকার গতিশীল পারিবারিক ব্যবস্থায় অচল বৃদ্ধের আনকিউরেবল রোগ যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তাহলে সেটার প্রভাব অনেক জটিল আর ধোঁয়াশাপূর্ণ হয়। কার জীবনে এখন এত সময় আছে এমন অচল বৃদ্ধের দিকে দিন-রাত ২৪ ঘন্টা নজর রাখা। সবারই তো নিজ নিজ ব্যক্তিগত সংসার আছে। মামাদের চাকরি-বাকরি, তাদের সন্তানদের লেখাপড়া, মামিদের নিজ নিজ সংসার। অন্যদের তার মেয়েদের আলাদা সাংসারিক ঝামেলা। মুখে কেউ স্বীকার না করলেও একটা সময়ে এমন রোগী অতি আপনজন হলেও একটা বোঝা মনে হতে থাকে। তাই সব কিছু মিলিয়ে মন হল- নানা আজ মুক্তি পেয়ে গেল।

এরপরের গল্প খুবই স্ট্রেট ফরওয়ার্ড একটা রিচুয়াল বা এস.ও.পি, স্যান্ডার্ড অপরেশনাল প্রসেডিউর। প্রথম কাজ ডেথ সার্টিফিকেট বের করা। এটা খুবই জরুরি একটা কাজ। এই সার্টিফিকেট ছাড়া মৃত মানুষের কোন দাম নাই। তাকে কবর দিতে এই কাগজ লাগবে, তার ব্যাংক একাউন্টে একসেস করতে লাগবে এই কাগজের টুকরো, তার সম্পত্তি ভাগবাটোয়ারা করতেও লাগবে এই সার্টিফিকেট। মহল্লায় যারা লাশ গোসল করায় তাদের খবর দাও, মসজিদ থেকে খাটিয়া নিয়ে আসো, কাফনের কাপড়, বাঁশ, চাটাইয়ের ব্যবস্থা কর। যার যার আত্মীয়-বান্দব-মহল্লাবাসীকে খবর দাও। একফাঁকে কবরস্থানে গিয়ে গোরখোরদের কাজে লাগিয়ে আসো। ডেকোরেটর থেকে কিছু চেয়ার, সামিয়ানা নিয়ে আসো। এরপর লোকজন এসে লাশের মুখ দেখবে। জানাজার সময় হলে মসজিদে নিয়ে যাও। জানাজার আগে উপস্থিত জনগনের কাছে মৃত বাবার জন্য মাফ চাওয়া, দেনা-পাওনার হিসাব চুকিয়ে নিতে বলা সাথে চেহলামে মিষ্টি নিমকি খাওয়ার দাওয়াত দেয়া। চেহারা টা পশ্চিম মুখো করে বাঁশ চাটাই দিয়ে ঢেকে একমুঠ মাটি ছুঁড়ে দেয়া। এরপরের কাজ সেই গোরখোরদের। কোদাল দিয়ে মাটি ফেলতে ফেলতে এক সময় পুরো গর্ত টা ঢেকে যাবে। উপরে বাড়তি মাটি ফেলে কোদালের উলতো পিঠ দিয়ে চাপ দিয়ে কবরটাকে সুন্দর একটা শেইপে নিয়ে আসবে।

গোরখোরদের দলে একটা পিচ্চির কাজ আমি মুগ্ধ হয়ে দেখতে লাগলাম। পিচ্চি টা কত এফিশিয়েন্টলি কোদল দিয়ে মাটি কাটছে। হাত ঘুরিয়ে সেই কোদালে থাকা মাটি কবরে ফেলছে। ঠিক যেন একটি রোবট, ঠিক একই পরিমাণ মাটি প্রতিবার। কাজ শেষ সবাই যে যার পথে বেড়িয়ে গেল। গোরখোরদের পিছে পিছে আমি সবার পরেই বের হলাম। পকেটে থাকা একটা প্রাণ হজমি পিচ্চি টাকে দিতে হবে।

২৫ অগাস্ট ২০১৭

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!