কালাওমেহ

একবার এক পাড়ায় বেশ কয়েকদিন আমরা অন্তরীণ অবস্থায় ছিলাম। অনেকটা হাউজ এরেস্টের মত। খাও দাও ঘুরো ফিরো মাগার দৃষ্টিসীমার বাইরে যেতে পারবা না টাইপ একটা অবস্থা। মনে মনে ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে কিছুটা উদ্বিগ্ন হলেও, বাইরে দিয়ে হাসি খুশি ব্যবস্থা টা সাময়িক ভেবে মেনে নিয়েছিলাম।

আমাদের দলের এমন একটা অবস্থা সবাই সব সময় যার যার মত সময় কাটাতে পারদর্শী। একসাথে শুধুমাত্র টুয়েন্টি নাইন খেলাটাই জমত। সারাদিন যে যার মত থাকলেও আমাদের আড্ডা জমত রাতের খাবারের পর, ঘুমানোর আগ পর্যন্ত। এই সময় টা আমরা খুব উপভোগ করতাম।

তাছাড়া দিনের বেলা একজন চলে যেত পাড়া বেড়াতে, যদি নতুন কোন তথ্য পাওয়া যায়। আরেকজন বিড়ির প্যাকেট আর জলরং হাতে নিয়ে জঙলের মাঝে হারিয়ে যেত। আরেকজন হেডফোনে কান্ট্রি সং শুনতে শুনতে র‍্যান্ডম কারো সাথে আলাপ জমিয়ে বসত, দুপুরের সূর্য মাঝ গগনে আসলেই ঘটা করে গা ডলে গোসল করত আর কাপড় ধুতে বসত।

আমি বসে যেতাম বই নিয়ে। সবাই বইয়ের পাতা পালটায়। আর আমি আমার কাত হওয়ার পজিশন পাল্টাতাম। একবার ডান কাতের পেইজ পড়া শেষ হয়ে গেলে আবার বাম কাত। যেহেতু আনসার্টেনিটি আছে, তাই বই যেন লং লাস্টিং থাকে সেটা নিশ্চিত করতে ফাঁকে ফাঁকে ঘুমিয়েও নিতাম। আর সেই সাথে চলত অল্প বিস্তর লেখালেখি।

এভাবে চলে গেল বেশ কিছুদিন। বাকিদের কোন সমস্যা হয়নি কিন্তু একদিন আমার বই শেষ হয়ে গেল। হাবিজাবি লিখে নোট বইয়ের পাতাও শেষ হয়ে গেল। কি যে মুসিবত। এখন কি করি।

এরপর আমার চোখে পড়ে গেল রুং রাং এর ঠোটের পাশে রাখা ২১ ইঞ্চির টিভি পর্দাটার দিকে। এতদিন ধরে এখানে এই এক ঘরে পড়ে আছি এতদিন কেন নজরে পড়ল না বুঝে উঠতে পারলাম না। টিভিতে কি দেখে জিজ্ঞেস করতেই ওয়ার্ডড্রব খুলে আমাকে ডিভিডি কালেকশন বের করে দিল।

কালেকশন ভালো হলে যা হয় আর কি। সবই তার উপর মিজো ঘরনার জিনিস। কয়েকবার হাতড়ানোর পরও সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় অবু দশ বিশ এর আশ্রয় নিলাম। বেড়িয়ে এল এক ব্রিটিশ টিভি সিরিজ, ‘মার্লিন’।

এরপর আমি ডুবে গেলাম জাদু টোনার দেশে, কিং আর্থারের সাথে। এক মগ চা নিয়ে প্রতিদিন সকালে বসে পড়তাম। মিজো ভাষায় ডাব করা তাতে কি, বেশ উত্তেজনাপূর্ণ এক সিরিজ। ভাষা না বুঝে অভিনয় দেখে ঘটনা আঁচ করা বেশ মজাদার একটা খেলা। এক ঘটনাপ্রবাহের পর অনুমান মিলে গেলে কি যে খুশি লাগে তা বলে বুঝানো যাবে না। অনেকদিন পর মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে টিভি দেখেছি। টানা দুই সিজন দেখে তার পর থেমে ছিলাম।

মানব মস্তিষ্কের কোঠরে জমে থাকা স্মৃতি নাকি হুটহাট করেই মনে পড়ে। হঠাৎ কিছু স্মৃতি হামলে পড়েছে আর বলছে,

‘কালাওমেহ’ !

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!