সাকা হাফং

[এক]

আজও সকাল সকাল ঘুম ভেঙে গেল। যতই ভাবি আজ সারাদিন ঘুমাবো কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। পাহাড়ে আসলেই কিভাবে কিভাবে যেন বায়োলজিক্যাল ক্লকটি রিসেট হয়ে যায়। বাসায় থাকলে রাত তিনটা চারটা বাজেও যেখানে ঘুম আয় ঘুম বলে ভেড়া গুনতে হয় সেখানে পাহাড়ে দশটা এগারটা না বাজতেই চোখ ঢুলু ঢুলু হয়ে যায়। আরও কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে শুয়ে থাকার চেষ্টা করলাম। শেষ পর্যন্ত আর টিকতে না পেরে ধুর ছাই বলে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়তে হল।

ঘরের ভিতর অত্যাধিক গরম। খাতায় কলমে এখন শীতকাল চললেও দিনের বেলা সেটি বুঝার কোন উপায় নেই। ঠান্ডাটা পাহাড়ে কেবল রাতে টের পাওয়া যায়, দুই তিনটি কম্বল গায়ে দিতে হয়। মার্চ-এপ্রিলের তীব্র দাবদাহের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয় না।

আমাকে উঠে পড়তে দেখে ঘরের দক্ষিণ কোণের খুঁটিতে হেলান দিয়ে গ্রামের মহিলাদের মত পা ছড়িয়ে বসে চুলের জট ছাড়াতে ছাড়াতে চারী বলে উঠলেন, ‘চল আজকে আশপাশ থেকে ঘুরে আসি’।

আলস্য, অনীহা আর সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘ কই যাবেন আবার’।

গলার স্বর শুনে বোধ হয় বুঝে গেছেন যে আশেপাশের ঘুরাঘুরিতে আমার বিশেষে আগ্রহ নেই, তাই আশ্বস্ত করার জন্য বললেন, ‘আরে বেশী দূর যাব না। পাড়ার কাছেই, ভ্যালীটার একটা ছবি আঁকব’।

মনে মনে ভাবলাম, ‘যাক বাবা ছবি আঁকবে যখন তাহলে হাঁটাহাটি বেশী করা লাগবে না। আর এই গরমে ঘরে বসে থেকেই বা কি করব। তার চেয়ে ঝিরির পাড়ে কোন গাছের ছায়ায় শুয়ে বই পড়াই ভালো’।

কম্বলগুলো সব ভাঁজ করে ঘরের এক কোণায় রেখে ছোট ডে প্যাকে পানির বোতল, ডায়রি, কলম, চায়ের সরঞ্জাম আর এক সেট কাপড় নিয়ে নিলাম। একবারে গোসল করে ফিরব। মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে রান্না ঘরে উঁকি দিলাম। পাহাড়ের ঘরগুলোতে সাধারণত বড় ঘরের একপাশেই রান্নার ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু এখানে রান্নার জন্য আলাদা করে ছোট্ট একটি ঘর বানিয়েছে অংপ্রু দাদা। অংপ্রু দাদা আর দিদি বোধ হয় জুমে গেছেন। তাদের ফিরতে ফিরতে সেই দুপুর হয়ে যাবে।

রান্নাঘরে উঁকি দিতে দেখে চারী বললেন, ‘তাকে তরকারি আর ভাত রাখা আছে’।

তাকে রাখা হাড়ি তুলে দেখলাম নাপ্পি ভর্তা আর শীম চিংড়ির তরকারি রাখা আছে। এখন তেমন ক্ষিদেও পায়নি। আর ঘুম থেকে উঠার সাথে সাথে ভাত খাওয়া যায় নাকি। রান্নাঘর থেকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনি খেয়ে নিয়েছেন’?

‘দাদা-দাদি কখন জুমে গেছে তোমার আইডিয়া আছে কোন’?, চারী ভাই বললেন।

ঘরে ঢুকে ডে ব্যাকটা কাঁধে নিয়ে বললাম, ‘আল্লাহ’র রহমত, আইডিয়া দেয়ার জন্য যে ঘুম থেকে তোলেন নাই। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। চলেন এবার বের হই। একবারে দুপুরে এসে খাব’।

[দুই]

ঘর থেকে বেরুতেই ঝকঝকে নীল আকাশ আর উজ্জ্বল রোদ স্বাগত জানালো। সামনের ন্যাড়া মাঠের ঘাসগুলো সব ধুলোয় মিলিয়ে গেছে। চারপাশের পাহাড় ও গাছপালাগুলোও জীর্ন ও মলিন হয়ে গেছে। কেমন একটা বাদামী ধুলো রঙা ঘোলাটে বিষন্নতা ছড়িয়ে আছে চারিদিকে। বুঝা যায় প্রকৃতির শীতনিদ্রা এখনো শেষ হয়নি। কালবৈশাখীর তান্ডবের পরপরই সবকিছু আবার সজীব হয়ে উঠবে। পাহাড়ের প্রতিটি শিরা উপশিরা, নদীর প্রতিটি বাঁক, প্রতিটি গাছ, প্রতিটি প্রাণ সেই ঝড়ো উন্মাদনায় লন্ডভন্ড হয়ে যাবার জন্য অধীর অপেক্ষায় দিনযাপন করছে।

গত বছর ডিসেম্বরে ঘর থেকে বেড়িয়েছিলাম। এখন ফেব্রুয়ারি চলছে। দুই মাস ধরে আমরা ‘ডিওয়ে এক্সপেডিটর্সের’ সার্ভে প্রজেক্টে বান্দরবানের এমাথা থেকে ওমাথা ঘুরে বেড়াচ্ছি। সার্ভে প্রজেক্টের মূল উদ্দেশ্য হল বাংলাদেশের প্রধান সব পর্বতশ্রেণী প্রমিনেন্ট সব চূড়া চিহ্নিত করে সেগুলোর যাবতীয় তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা। রেংতল্যাং, লম্বক্রো, কেওক্রাডং হয়ে আমরা এখন মদক বেল্টে এসেছি। তিনদিন হল আমরা সাজাই পাড়ায় ঘাঁটি গেড়েছি ।

নাইক্ষিয়াং নদীর পাড়ের ছোট এই পাড়ায় কিছুদিন বিরতি দিয়ে আমাদের ক্লান্ত শরীর ও মনকে কিছুটা বিশ্রাম দেয়ার ইচ্ছা। অনেক প্রয়োজন রসদ ফুরিয়ে গেছে, সবচেয়ে কাছের বাজার থানচি থেকে সেগুলো সংগ্রহ করতে হবে। বাজার সদাই করতে দলের বাকি তিনজন সদস্য শুভ ভাই, আকাশ ভাই ও সামিউর গতকাল থানচি গিয়েছে। সবকিছু গুছিয়ে আগামীকাল বা পরশু তাদের ফেরার কথা রয়েছে।

তাদের কথা ভাবতেই মনে পড়ল আকাশ বলেছেন উনি তেহারি খাওয়াবেন। থানচি থেকে নিয়ে আসবেন পোলাওয়ের চাল আর গরুর মাংস। লালবাগের সন্তান আকাশ ভাই স্বয়ং পুরান ঢাকার স্পেশাল পাকওয়ান রাধবেন। মনে হল এখনই বাতাসে তেহারির ঘ্রাণ পাচ্ছি। সমস্ত শরীরে চনমনে ভাব চলে এল, দ্রুত পায়ে চারী ভাইকে মাঠের মাঝে ধরে ফেললাম।

পাড়ার বিশাল মাঠটি পেড়িয়ে এসে উত্তরের ছোট পাহাড়গুলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। গত বছর এই পাহাড়টায় জুম করেছিল। পথের মধ্যে ঝোপঝাড় দিয়ে জংলামত হয়ে আছে। শুকনো লতাগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে এগুতেই পুরনো জুমের রাস্তা পাওয়া গেল। মিনিট পনেরোর মধ্যেই আমরা বেশ অনেকটা উঠে গেলাম। এখানেএকটি ওয়াই জাংশনের মত তৈরী হয়েছে, একটি পথ পুবে চলে গেছে আরেকটি পশ্চিমে। এই জাংশনের পাশেই বিশাল একটি পাথর পড়ে রয়েছে।

এমন একটি পাথর রুমা খাল পাড়ের বগামুখ পাড়ার সামনেও একটি আছে। ঝিরিপথ দিয়ে যারাই একসময় বগালেক গিয়েছে তারা সবাই এই পাথরে বসে অবশ্যই কিছুক্ষণের জন্য হলেও জিরিয়ে নিয়েছেন। এখন তো এপথে আর যেতেই দেয়া হয় না। বগামুখ পাড়ার মত পাথরটা অত বড় না হলেও অনায়াসে পা টা ছড়িয়ে শুয়ে পড়া যায়। আর কি ভাগ্য, পাথরটির পাশে বিশাল একটি হরতকি গাছও আছে। বেলা বাড়লেও ছায়ার খোঁজে উঠে পড়তে হবে না। সবচেয়ে বড় কথা এখান থেকে উল্টোদিকের নাইক্ষ্যং উপত্যকার চমৎকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে; সোনায় সোহাগা অবস্থা যাকে বলে।

পাথরটায় হেলান দিয়ে চারী মাটিতেই বসে পড়লেন। আমি গিয়ে পাথরের উপর জাঁকিয়ে বসলাম। চারী ভাই ব্যাকপ্যাক থেকে তার স্কেচ বুক, পেন্সিল বক্স, জল রঙের বাক্স, মিক্সিং প্লেট, পানি রাখার জন্য মুখ কাটা মিরিন্ডার পেট বোতলের পসরা সাজিয়ে বসেছেন। মনে মনে কোন একটা কম্পোজিশন ঠিক করছেন। তাঁর দৃষ্টি অনুসরণ করে বুঝারm

ojo চেষ্টা করছি, ঠিক কোন ফ্রেমটা উনি ধরার চেষ্টা করছেন? সরাসরি তাকালে প্রথমেই চোখে পড়ে দেবতা পাহাড়। এই পাহাড়টা টপকালেই অপর পাশে থুইসা পাড়া, ওখান দিয়েই পর্যটকেরা আমিয়াকুম আসা যাওয়া করেন।

আর আমাদের বামে মদক শ্রেণী উত্তর থেকে ক্রমশ দক্ষিণে চলে গেছে। প্রথমেই সাদরা, হাজাছড়া চূড়া দুটি বেশ স্পষ্ট, এরপর একটু দূরে যোগী কামরাঙার মত চূড়াগুলোর অবয়ব অনেক কষ্টে বুঝা যাচ্ছে। এরপর থেকেই সব অস্পষ্ট, ঘোলাটে একটি পর্দা দিয়ে দিকচক্রবাল কেউ যেন ঢেকে রেখেছে। শীতকালে পাহাড়ের এমন ঘোলাটে ভাবটা ভালো লাগে না। এতে ভোরের কুয়াশর‍্য ঢেকে থাকা রহস্যময়তা থাকে না, না বর্ষার উজ্জ্বল সজীবতা থাকে, না থাকে গ্রীষ্মের রুক্ষ বাস্তবতা। কেবল ম্রিয়মাণ পাংশুটে বিষণ্ণতা ঝুলে থাকে দিনভর।

আশপাশের উচু পাহাড়ের দিকে তাঁর দৃষ্টি ছিল না। চারী নিচের উপত্যকার দিকে তাকিয়ে আছেন। দক্ষিণের যোগীর ঢাল থেকে নেমে আসা নাইক্ষ্যং লাউডগা সাপের মত একে বেকে আমাদের দিকে এগিয়ে এসে ঠিক যেখান থেকে উঠে এসেছি, সেই সাজাই পাড়ার কাছেই মোচড় কেটে পশ্চিমের পাহাড়ের ভিতর ঢুকে গেছে। সূর্য এখনো মাথার উপর চড়ে বসেনি তাই মদকের অরণ্য ভেদ করে চুইয়ে আসা আলো নাইক্ষ্যংয়ের কিছু কিছু অংশে এসে পড়ছে। আর কিছু অংশ এখনো অন্ধকার হয়ে আছে। গভীর জায়গাগুলো সবুজাভ পান্নার মত আলো ঠিকরাচ্ছে।

নদীর পাড়েই প্রথমে জ্যোতি পাড়া, তারপর ঠিক পাশেই সাজাই পাড়া। সাজাই পাড়ার পরে নদীর অপর পাড়ের ছোট একটি সমতল পাহাড়ের মাথায় মনখৈ পাড়া। প্রতিটি পাড়াই ছোট। কোন পাড়াতেই চার পাঁচটির বেশী ঘর নেই। নাইক্ষ্যং পাড়ের আর কোন কোন পাড়া এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। আলো আঁধারের মাঝে বয়ে চলা নাইক্ষ্যংয়ের বাঁক ও তার দুই পাড়ের এই তিনটি পাড়াই আজকের জলচিত্রের বিষয়বস্তু। চারী ভাই প্লেটে রঙ গোলা শুরু করল আর আমি পাথরের উপর বসে চায়ের আয়োজন করতে বসলাম।

[তিন]

চায়ের পাট চুকিয়ে হরিতকি গাছের ছায়ায় বসে সোভিয়েত টপো ম্যাপটা নিয়ে বসলাম। এমন বিশ্রামের সময়গুলোতে টপোম্যাপ দেখে আশপাশের সাথে মিলিয়ে দেখতে খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে মানুষের বুদ্ধির তারিফ না করে পারা যায় না, এত বিশাল বিশাল পাহাড়ের ত্রিমাত্রিক একটা চিত্র কার্টোগ্রাফাররা সামান্যকয়েকটা দাগ দিয়ে কি সুন্দর করে কাগজে তুলে ধরেন।

‘আচ্ছা, বলেন তো সোভিয়েতরা সাকা হাফং কে চুড়া হিসেবে চিহ্নিত করেনি কেন? ওরা নাম দিল, ঐ যুগে প্রায় একিউরেট উচ্চতা উল্লেখ করল, কিন্তু চূড়ার মর্যাদা দিলো না। এর কারণ কী মনে হয় আপনার কাছে?’, মানচিত্রে সাকা হাফং অংশটি দেখে জলিরঙ নিয়ে ব্যস্ত চারীকে প্রশ্নটি করেই ফেললাম।

তুলি দিয়ে আলতো আচড় দিতে দিতে চারী বলল, ‘ঠিকই তো আছে। সাকা হাফং পিক হলে না পিক হিসেবে মার্ক করবে।

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘আরে আজব তো! সাকা সবার চেয়ে উঁচু, প্রমিনেন্স ও সবচেয়ে বেশী। এস আর টি এম ডাটাতেও এটাকেই সবচেয়ে উঁচু দেখায়।’

‘তোমাদের এসব কিতাবি হিসাব আমি বুঝিনা। কিন্তু সাকাকে আমার পিক মনে হয় না।পাহাড়ের একটি চূড়াকে সবার আগে চূড়ার মত দেখতে লাগতে হবে তো।’, বিরক্ত হয়ে চারী বললেন।

আমি বললাম, ‘বুঝলাম না, পিকের সাথে দেখতে কেমন এর কি সম্পর্ক’?

‘বাচ্চাদের কখনো পাহাড়ের ছবি আঁকতে দেখেছো’, সরলভাবে চারী জিজ্ঞেস করলেন।

‘হ্যা, দেখেছি তো’, আমি জবাব দিলাম।

‘কেমন পাহাড় আঁকে তারা’?, পাল্টা প্রশ্ন করলেন চারী।

উনি কি বলতে চাচ্ছেন অবশেষে তা বুঝে গেলাম। আমাদের ইমাজিনেশন বলি বা পারসেপশন, পাহাড়-পর্বতের কথা চিন্তা করলে আমাদের মাথায় খুবই সাধারণ একটি চিত্র ভেসে উঠে। আমাদের কল্পনার পাহাড় বা পর্বতের আকার ত্রিভুজাকার, পিরামিডের মত। দুই বাহু দুইদিকে ঢাল তৈরি করবে আর তার মাথা চোখা হয়ে আকাশের দিকে উঠে যাবে। পাহাড় বা পর্বত হিসেবে আমাদের মস্তিষ্কে কখনো গুম্বুজের মত গোলাকার বা সমতল কোন পাহাড়ের চিত্র ভেসে উঠে না।

‘এর মানে হল, চূড়া হবার জন্য আপনার কাছে পাহাড়ের আকার বা সেটা দেখতে কেমন, সূঁচালো না ভোতা এটাও গুরুত্বপূর্ণ? কোন পাহাড়ের মাথা যদি সূঁচালো না হয় তাহলে কি সেটা চূড়া হবে না’?, আমি পাল্টা প্রশ্ন করলাম।

ছবি আঁকা রেখে একটি আকিজ বিড়ি ধরিয়ে চারী বললেন, ‘সাকা হাফংয়ের রিজ প্রায় সমতল একটা জায়গা। উত্তরের অংশটা মাত্র দুই থেকে তিন ফিট ঢালু হবে। এটাকে কিভাবে তুমি পিক বলবে’?

চারী আসলে ভুল বলছেন না। কোন পাহাড়ের চূড়ার একটি মাত্র সর্বোচ্চ বিন্দু থাকতে পারে। সেটাকেই সামিট বলা হয়। কিন্তু সাকা হাফংয়ের রিজ ধরে এগুলে একটা বড় অংশের উচ্চতা একই পাওয়া যাবে। এভাবে বলা যেতে পারে সাকা হাফংয়ের কোন একক সর্বোচ্চ বিন্দু নেই। এর রিজটা প্রায় সমতল হবার কারণে অনেক জায়গাজুড়ে সর্বোচ্চ উচ্চতা পাওয়া যায়।

এতদিন ধরে জেনে আসা এত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য আমূল পাল্টে যাওয়ার হতভম্ব ভাব নিয়েই বললাম, ‘আপনার এই থিওরি অনেককে হতাশ করবে’।

হে হে করে ফিচকে মার্কা একটি হাসি দিয়ে চারী বললেন, ‘সবচেয়ে বেশী হতাশ কে হবে বল তো’?

বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা করলাম। দুই একজনের চেহারা সামনেও আসলো কিন্তু কিছু না বলে তাকেই জিজ্ঞেস করলাম, ‘কে’?

ফিচেল মার্কা হাসিটা ধরে রেখে বললেন, ‘সাজ্জাদ’।

আমিও হা হা করে একচোট হেসে বললাম, ‘আসলেই। সাজ্জাদ ভাই আপনার তালিকা দেখলে অনেক বড় একটা ধাক্কা খাবে। এটা মানতেই পারবে না’।

নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের অন্যতম প্রতিষ্ঠা সদস্য সাজ্জাদ হোসেনের মত সাকা হাফংয়ের সাথে ইমোশনালি এটাচড বোধ হয় আর কেউ নেই। কেওক্রাডংয়ের বাইরে বাংলাদেশের অন্যান্য পর্বতশ্রেণী ও চূড়ার খোঁজে অনুসন্ধানী অভিযান পরিচালনা করায় নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের অগ্রগামী ভূমিকা এখনো তরুনদের জন্য অনুপ্রেরণা। তবে সাকা হাফং নিয়ে নেচার অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব ও মাউন্টেইন ট্রেকার্স গ্রুপের মধ্যকার অসুস্থ প্রতিযোগিতার কথা মনে পড়লে কেমন যেন অস্বস্তি লাগে।

একই সময়ে রওনা হয়েও খান ভাইয়ের নেতৃত্বে মাউন্টেইন ট্রেকার্স গ্রুপ সাজ্জাদ ভাইদের আগে দেশের সর্বোচ্চ বিন্দুতে পৌঁছে যান। দেশের নাগরিক হিসেবে উনারা প্রথম হতে পারেনি দেখে সাজ্জাদ ভাইদের মন ভেঙ্গে গিয়েছিল। তারপরেও দ্রুততম সময়ে ঢাকায় ফিরে সংবাদ সম্মেলন আয়োজন করে দেশের সর্বোচ্চ বিন্দুতে আরোহণের সমস্ত ক্রেডিট গ্র‍্যাব করার চেষ্টাকে আমার কাছে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা ভিন্ন অন্য কিছু মনে হয়নি। কে আগে গেছে, কে পড়ে গেছে এসব ছেলেমানুষি করে কেউ কি যে মজা পায় কে জানে? এমন সুপারফিশিয়াল গ্লোরিফিকেশনে পাওয়া আত্মসুখের জন্য কত কি তারা করতে পারে। হাস্যকরভাবে যখন তারা নিজেরাও জানে স্থানীয় মানুষজন এই পাহাড়ের ঢালেই বসবাস করে, এই পাহাড়ের ঢালেই জুম চাষ করে, এক বিদেশীও এসে রীতিমত এখান থেকে ঘুরে গেছে, এরপরও তাদের এসব অর্থহীন কর্মকান্ডের পিছনে কোন যুক্তি খুঁজে পাইনা।

তারপরেও ব্যক্তি সাজ্জাদ হোসেনের প্রতি আমাদের সবার কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। কারণ উনি সম্পূর্ণ একা ‘সাকা হাফং’ নামটি স্ট্যাবলিশ করেছেন। প্রথম আরোহী দলটি স্থানীয় নামকে উপেক্ষা করে বাংলা নাম প্রস্তাব করেছিল। সাজ্জাদ ভাই সোশ্যাল মিডিয়ায় এককভাবে লড়াই করে পাহাড়প্রেমী তরুন তরুনীদের মাঝে স্থানীয় নাম সাকা হাফংকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যেখানে এই পাহাড় নিয়ে আলোচনা হত সেখানেই তিনি এই নাম নিয়ে এডভোকেসি করতে হাজির হয়ে যেতেন। কেউ ভুল করলে তাকে সংশোধন করে দিতেন। অন্য কেউ ভিন্ন কোন নাম ব্যবহার করলে উনি তর্ক বিতর্ক করে সাকা হাফংকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করতেন।

যদিও এইদিক থেকে উনি সমসাময়িক বেশীরভাগ ট্রেকিং গ্রুপগুলোর কাছ থেকে নৈতিক সমর্থন পেয়েছিলেন বলে এই কাজটি তাঁর জন্য সহজ হয়েছিল। এক যুগ পর সাজ্জাদ ভাইয়ের চেষ্টায় সাকা হাফং নামটি এখন প্রতিষ্ঠিত। একযুগ ধরে নিরলসভাবে ভার্চুয়াল স্পেসে উনি লড়াই করে না গেলে অন্যান্য অনেক কিছুর মত দেশের সর্বোচ্চ বিন্দুর নাম নিয়েও বিতর্ক থেকে যেত। এরজন্য সাজ্জাদ ভাইকে ধন্যবাদ দিতেই হবে।

তপ্ত দুপুরে খামোখা খেয়াল হয়ে জেকে বসা সাকা হাফং কিছুতেই মাথা থেকে যাচ্ছেনা। এতদিন ধরে জেনে এসেছি সাকা হাফং সর্বোচ্চ চূড়া, আজ হঠাৎ করে একজন সেটা খারিজ করে দিল, এটা তো সহজে মেনে নেয়া যায় না। আবার ভালোমত চিন্তা করে দেখলে চারীর যুক্তিগুলো পুরোপুরি ফেলেও দেয়া যাচ্ছে না।

তাহলে আপনার তালিকায় সাকা হাফংকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন? আমি জানতে চাইলাম।

সাকা হাফং মদক বেল্টের একটা মাউন্টেইন ম্যাসিফ, যার হাই পয়েন্টের উচ্চতা ১০৫০মিটার, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বিন্দু- ব্যস। আমার তালিকায় সাকা হাফং চূড়া হিসেবে থাকবে না।

‘এর মানে হল হাইট, প্রমিনেন্স, আইসোলেশনের সাথে সাথে আপনার জন্য নান্দনিকতাও পিক হওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ক্রাইটেরিয়া?’, আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘অবশ্যই’, চারী তাঁর স্বভাবজাত ভাবমারা গলায় বলল।

‘কিন্তু নান্দনিকতা তো আপেক্ষিক একটা বিষয়। আপনার জন্য যেটা চোখা, দেখতে আকর্ষনীয়, যেটাকে চূড়া বলবেন, সাজ্জাদ ভাইয়ের কাছে সেটা চূড়া মনে নাও হতে পারে।’, আমি বললাম।

ভাবলেশহীনভাবে চারী উওত্তর দিলেন, ‘সাজ্জাদ মানলেই কি আর না মানলেই কি। তাতে কি আসবে যাবে বল? আর পৃথিবীতে সবই তো আপেক্ষিক। পরম বলে কিছু আছে নাকি? মৃত্যুর মত ব্যাপারও তো আপেক্ষিক। তুমি মরবা কিনা, তোমার অস্তিত্ব বিলীন হবে কিনা এটাও তো তোমার বিশ্বাসের উপর নির্ভর করে। তুমি বুদ্ধের ফর্মুলায় বিশ্বাস করলে নির্বাণ না পাওয়া পর্যন্ত জন্ম নিতে থাকবা। আর মোহাম্মদের অনুসারী হলে মরার পর আবার জীবিত হবা, এরপর কর্মফল বুঝে নিবা। পরম বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নাই এই দুনিয়ায়।’

[ এটি ২০১৫ সালের আজকের দিনে লিখেছিলাম। সার্ভে এক্সপেডিশন থেকে ফিরেই ভেবে নিয়েছিলাম এর রিপোর্ট যত তাড়াতাড়ি সম্ভব লিখে ফেলব। বাকিদের কথা বলতে পারছি না, তবে সত্যি বলছি আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করলাম আমার পক্ষে এটা সম্ভব না। এত বিশাল আর গভীর সাবজেক্টে হাপুস হুপুস করে এলোপাথাড়ি সাঁতার কেটে দুই দিনেই দম ফুরিয়ে গেছে। সাত বছর পরেও এখনো জানা শেষ হয় নি, শেখা ফুরায়নি।

এই লিখাটি একেবারেই প্রাথমিক ড্রাফট ছিল। মূল বইয়ের জন্য এই অধ্যায়টি অনেকটাই পরিবর্তন করা হয়েছে। ফেসবুকের জন্য আজকে প্রথম ড্রাফটটাই প্রকাশ করলাম। প্রকাশ করার মুখ্য উদ্দেশ্য হল, পাঠকদের কাছে আমাদের আলোচনার কী পয়েন্টগুলো ঠিকঠাকভাবে পৌঁছানো গেছে কিনা সেটা বোঝা, সেই সাথে আরও বিশদ আলোচনার একটা স্কোপ তৈরি করা, যেন জটিল বিষয়গুলো আরও ক্লারিটি পেতে পারে।

[ পাঠকদের কাছে সবিনয় নিবেদন, এই পোস্টে সংশ্লিষ্ট বিষয় সংক্রান্ত আপনার যেকোন আলোচনা, সমালোচনা, প্রশ্ন, জিজ্ঞাসা, ভুল সংশোধন , অন্যকোন থিওরি বা হাইপোথিসিস , কৌতুহল, এমনকি গালাগালিও যদি করার থাকে তাহলে প্লিজ সংকোচবোধ করবেন না। ]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!