মানুষকে কনট্রোল করার জন্য, মানুষের উপর ডমিনেট করার জন্য ধর্মের চাইতে শক্তিশালী আর কিছু আছে বলে মনে হয় না। এক সময় এই ধর্ম নিয়ে বেশ আগ্রহ সহকারে খোলামেলা আলোচনা করতাম, তর্ক বিতর্কও হত। এখন তো অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে এই বিষয়ে নিজস্ব কোন মতামত দিতেই আর ইচ্ছা করে না। এখন মনে হয় যেই জিনিস একান্তই ব্যক্তিগত বিশ্বাস আর অনুশীলন হওয়ার কথা সেটা নিয়ে এত আলোচনার কিছু নাই। কিন্তু আজকে বাংলাদেশের একটা বিজ্ঞাপন দেখে এত এত চিন্তার মাছি মাথায় ভিনভিন করছে যে না লিখলে কিছুতেই এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতাম না।
এক তরুন প্রতিভাবান ডিরেক্টর রোজার উপর বেইজ করে একটা মোবাইল হ্যান্ডসেটের বিজ্ঞাপন তৈরী করেছে। এই বিজ্ঞাপনের পটভূমির জন্য তিনি পছন্দ করে নিয়েছেন আমাদের পার্বত্য এলাকার কোন একটা গ্রাম। গল্পটা এতটাই লেইম, এতটাই হাস্যকর যে লিখতেও ইচ্ছা করছে না। ভাব ধরার জন্য আবার শুরুতেই লিখে দিয়েছে ট্রু স্টোরি। গল্প হল দূর্গম পাহাড়ের কোন একটা গ্রাম যেখানে কোন মসজিদ নাই, যেখানে রেডিও সিগন্যাল পৌঁছায় না। সময়মত আজান শুনতে না পেরে গ্রামের মুসলিমদের তাই সেহরি খাওয়া ও মাগরিবের সময় ইফতার করা নিয়ে অনেক সমস্যা হয়। তো এক পাহাড়ি তরুন দৌঁড়ায় দৌঁড়ায় ঘরে ঘরে গিয়ে সেহরি খাইতে বলে, ইফতার করে রোজা ভাঙতে বলে। সবাইকে ডাকতে গিয়ে একবার ভুল দরজায় টোকা দিয়ে ফেলে। অসময়ে ঘুম ভাঙানোয় ভিতর থেকে একজন বিরক্ত হয়ে বলে ‘আমি তো হিন্দু’।
যাই হোক, গল্পের আর কিছু বলার নাই। গ্রামের মধ্যে সমতলের বাঙালি চেহারার লোকজন যেমন আছে তেমনি পাহাড়ি চেহারার লোকজনও আছে। পরিচালক বোধ হয় এই বিজ্ঞাপন চিত্রের মাধ্যমে বাঙালি পাহাড়ি ভাতৃত্ববোধ, সুশীল ভাষায় যাকে বলে সেকুলারিজম তথা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি , তাই উপস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। আর এর জন্য তারা বেছে নিয়েছে আমাদের পাহাড়, কারণ ড্রোন ফ্রোন দিয়ে বেশ সিনেম্যাটিক কায়দায় আমাদের পাহাড়ের অনেক আকর্ষণীয় একটা ভিজুয়াল দেখিয়ে দর্শকদের থ বানানো যায়। কারণ সমতলের বেশীরভাগের জন্যই এটা একটা অজানা, অদেখা রহস্যময় জায়গা।
পুরো কনসেপ্টটা এতটাই অফেন্সিভ আর বিরক্তিকর যে যাদেরই আমাদের পার্বত্য অঞ্চলগুলোতে মোটামুটি যাওয়া আসা আছে তাদের কাছে বাজে লাগবে, কষ্ট দিবে আর অক্ষম লজ্জায় মাথা নুয়ে যাবে- কারণ আমাদের জন্যই তো এই বিজ্ঞাপনটি বানানো হয়েছে। সম্প্রীতির ঘোমটার আড়ালে তিনি যে খুব স্থুলভাবে ধর্মীয়-জাতীয়তাবাদি কর্পোরেট ডমিনেন্সের প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দিয়েছেন যার প্রভাব খুবই খারাপ হবে। এই বিজ্ঞাপন একটা প্যাথেটিক্যালি নুইসেন্স, কালচারাল আর রিলিজিয়াস ইনভেশন ছাড়া আর কিছুই না।
আমার সব সময় মনে হয় সমতলের সাথে পাহাড়ের যেই বিরোধআছে তার মূল কারণ হল আমরা কেউ কাউকে ভালভাবে জানি না। আমরা একে অপরের সংস্কৃত, জীবন, ভাষা, রিচুয়াল সম্পর্কে যত জানব ততই আমাদের মধ্যে একে অপরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়বে, বিশ্বাস পোক্ত হবে। আর এই বিষয়ে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে যারা ক্রিয়েটিভ কাজ করেন। যিনি খুব ভাল গল্প, উপন্যাস লিখেন, যিনি অসাধারণফিল্ম বানান, যিনি শক্তিশালী ছবি তুলতে পারেন, ছবি আঁকতে পারেন- এই মানুষগুলো তাদের প্রতিভার মাধ্যমে দুটি ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারেন। পাহাড়ের পটভূমিতে কোন বাঙালির লিখা অসাধারণ কোন উপন্যাস পড়লেই না সমতলের কোন তরুন তরুনীর মধ্যে পাহাড় সম্পর্কে সেই বোধ জন্মাবে। ভাল একটা সিনেমার মাধ্যমে পাহাড়ের মানুষদের জীবনযাত্রাকে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব যা দেখে সমতলের মানুষেরা অনুপ্রাণিত হবে, সরল জীবন সম্পর্কে ভাবতে শিখাবে।
কিন্তু আমাদের এখানে হয় উলটো। আমাদের পাহাড়ের উপর যত বই পড়েছি দূর্ভাগ্যবশত সেগুলোর বেশীর ভাগই পলিটিক্যালি বায়াসড আর ম্যানিপুলেটিং। সেখানকার ভাষা, বিচিত্র লাইফ স্টাইল, সরল ভাবনা, কঠোর জীবন, সাংস্কৃতিক বৈচিত্রতা, সামাজিক ও পারিবারিক কাঠামো, সেখানকার ফসল, অরণ্যভূমি, প্রকৃতি, পানির প্রভাব- এসবের কিছুই তাতে পাইনি। এসবই যদি না থাকে তাহলে আমাদের মধ্যকার এই অদৃশ্য আর চাপিয়ে দেয়া দূরত্ব কমবে কি করে আমার বুঝে আসে না।
আরও বেশী খারাপ লাগে যখন দেখি ক্রিয়েটিভ লোকজনও মেইনস্ট্রিম পথে হেঁটে যায়। যাদের প্রতিভা আছে তাদের উচিত এই ধরনের কাজগুলোকে খুব ভালবেসে ডেলিভার করা। শুধুমাত্র লোক মুখে না শুনে ফিল্ডে গিয়ে সেখানকার সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, নিয়ে এক্সটেন্সিভ রিসার্চ করে তবেই সেটা ক্রিয়েটিভলি উপস্থাপন করুন। যাই করবেন সবদিক দিয়ে সেটার ইম্প্যাক্ট অবশ্যই আগে খতিয়ে দেখবেন।
ধর্মের মত সৃজনশীলতাও ডমিনেন্সের অনেক বড় হাতিয়ার। এই দুটি যখন মিলে যায় তখন তার ফল ভাল হয় না। আমাদের পাহাড়গুলোতে ধর্মান্তরিত হওয়ার/করার বিষয়টি সম্পর্কে আমি খুব ভালভাবে অবহিত আছি। সত্য ঘটনা বলে মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে এমনভাবে সেটা পোট্রে করে ব্যাপারটাকে লেজিটামাইজ করার এটা জাস্ট একটা অপচেষ্টা।
যেই টুলস ব্যবহার করেই হোক, কোন ব্যক্তির তার নিজস্ব ভাষা, তার সংস্কৃতি, তার ধর্ম, তার বিশ্বাসের উপর আগ্রাসন আর চাপিয়ে দেয়া অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ।