রডোডেনড্রন

পৃথিবীর সবচাইতে বিস্তৃত উপনিবেশিক ফুল বোধ হয় এই রডোডেনড্রন। নাম শুনলে মনে হবে ইউরোপীয় কোনও ফুল। কিন্তু জাতে এটি একেবারেই আমাদের উপমহাদেশীয়। আরো ভালোভাবে বললে, রডোডেনড্রন পূর্ব হিমালয়ের অখ্যাত একটি পার্বত্য ফুল যা এক তরুণ ব্রিটিশ অভিযাত্রীর হাত ধরে পৌঁছে গিয়েছিল ইউরোপের ঘরে ঘরে, এমনকি মহারাণীর রাজকীয় বাগানে।

আমি যেই সময়কার কথা বলছি তখনও লেখাপড়া, গবেষণা করা এখনকার মত বানিজ্যমুখীই ছিল। আগেই দেখে নেয়া হত এই গবেষণার রিটার্ন অন ইনভেস্টমেন্ট কত? কমার্সিয়াল এসপেক্ট না থাকলে সেই গবেষণার তখনও কোন ভ্যালু ছিল না। সবাই চেষ্টা করত কিভাবে সমাজের উঁচুস্তরের পয়সাওয়ালা কারও পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া যায়।

জায়গামত ইনভেস্ট করে পয়সাওয়ালা লর্ড-ব্যারন-প্রিন্সরাও ক্লাব, সোসাইটিগুলোতে স্ট্যাটাস বজায় রাখতে পারত। যারা পৃষ্ঠপোষকতা পেত না তারা নানা দেশ থেকে জিনিসপাতি চুরি করে মিউজিউয়ামে এসে বেঁচে দিত ইন্ডিয়ানা জোন্সের মত! এখনো এই অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি! কনটেক্সট চেইঞ্জ হলেও ঘুরে ফিরে সব সিস্টেম একই রকম আছে!

ডারউইন আর হুকার ছিল দুই বন্ধু। এই রকমই একটি গ্র্যান্ট পেয়ে ডারউইন এইচএমএস বিগল’ নামক জাহাজে করে পৌঁছে যায় গালাপাগোস দ্বীপপুঞ্জে। এই পুরো অভিযাত্রায় তার অনুসন্ধান ও পর্যবেক্ষণগুলো উঠে আসে তার লেখা অন ‘দ্যা অরিজিন অফ স্পিসিস’ নামক বইয়ে, যা আমাদের জানার বিস্তার চিরদিনের মত পালটে দেয়।

হুকারও এই রকম একটা গ্রান্টের জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছিল। রয়েল জিওগ্রাফিকাল সোসাইটির গ্র্যান্ট ফ্রেশফিন্ডকে দিয়ে দেয়ায় (এরাউন্ড কাঞ্চজঙ্ঘা) হুকারের মন প্রচন্ড খারাপ হয়। এই নিয়ে এই দুই অভিযাত্রীর মধ্যে বেশ মনকষাকষিও হয়। যাই হোক, হুকার তার অনুসন্ধানী প্রজেক্টের কমার্সিয়াল এসপেক্ট আছে তা বুঝাতে সক্ষম হন ও অবশেষে ১৮৪৭ সালের এক দিন তরুণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী জাহাজে উঠে রওনা হয়ে গেলেন ইন্ডিয়ার উদ্দেশে। সেই সময় জোসেফ ডালটন হুকারের বয়স মাত্র ত্রিশ।

প্রাণোচ্ছল এই তরুণের স্বপ্ন ভারতের পাহাড়-পর্বত ঘুরে ঘুরে জীববৈচিত্রের সন্ধান করবে। এত সম্পদ, এত অন্য রকম সৌন্দর্য ছড়িয়ে ভারতে, জানতে হবে তাকে। দেখতে হবে প্রাণ ভরে।

সেই সময়, কলকাতা থেকে দার্জিলিং যাওয়াটাই ছিল এক রকম অ্যাডভেঞ্চার। কলকাতা থেকে চুনারের কাছে মির্জাপুর অবধি গেলেন হাতির পিঠে, সেখান থেকে জলপথে শিলিগুড়ি। বাকি রাস্তা ঘোড়ায়। ১৮৪৮ সালের ১৬ এপ্রিল যখন দার্জিলিং পৌঁছলেন, ঝুপঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। পাহাড় ঢেকে আছে ঘন সাদা কুয়াশায়, কয়েক হাত দূরের কিছুও দেখা যাচ্ছে না।

কিন্তু পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে বাইরে তাকাতেই ম্যাজিক! ঝকঝক করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। মুগ্ধ হলেন হুকার। ডায়েরিতে লিখলেন, ‘‘হিমালয়ের অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে কত কিছুই না শুনেছি আর পড়েছি। কিন্তু সামনে থেকে দেখা এই অভিজ্ঞতা আমার সমস্ত প্রত্যাশাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে!’’

দার্জিলিঙ ও সিকিম হিমালয়, রোদ, কুয়াশা আর রডোডেনড্রন অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে হুকারের লেখায়। এক জায়গায় লিখছেন: ‘‘নীচের পাহাড়ের জায়গায় জায়গায় আটকে থাকা বাতাস দ্রুত গরম হয়ে উঠল। ঘন, ভারী, সাদা বাষ্প এখান-ওখানকার ফাঁকা জায়গা থেকে বেরিয়ে এসে ক্রমে উঠে পড়ল পাহাড়ের চুড়োয়; আটকে রইল চুড়োর ওপরে বনের মাথায়; পুরু হয়ে ছড়িয়ে পড়ে উঠল আরও, আরও ওপরে। এমনই আকস্মিক এই ঘটনা, এমনই অবিস্মরণীয় সেই নিসর্গ, যা দেখে কেউই চোখ সরিয়ে নিতে পারে না, মনে হয় যেন জাদু। এ-ই হল ভারতীয় রডোডেনড্রনের বাসভূমি।’

উনিশ শতকের ইউরোপীয়রা রডোডেনড্রনের হাতে-গোনা কয়েকটা প্রজাতি সম্পর্কেই জানতেন। হুকার যোগ করলেন আরও ২৫ রকমের প্রজাতি। তিনি তাদের আবিষ্কার করলেন, শ্রেণিবিভাগ করলেন, করলেন নামকরণও। অনেকগুলোর নাম রেখেছিলেন নিজের বন্ধুদের নামে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ডালহৌসির নামে একটা রডোডেনড্রনের নাম রেখেছিলেন।

হুকারের রডোডেনড্রন-নোটে লেখা আছে: ‘‘তার চিরসবুজ পাতার কথাই বলি, বা তার থোকায় থোকায় ফুটে-থাকা ফুলের বাহারের কথাই, প্রাচ্যের এই প্রজাতিটির মতো আর কোনও ফুলের গাছই এত বিস্তৃত, ব্যাপক ভাবে জন্মায় না।’’ সমগ্র দার্জিলিং, সিকিম ও ভুটান ঘুরে হুকার রডোডেনড্রনের নানান প্রজাতি সংগ্রহ করতেন। শুধু সংগ্রহই করতেন না, তাদের পাঠাতেন খোদ ব্রিটেনে। পরে ইংল্যান্ডের ‘কিউ গার্ডেনস’-এর উদ্ভিদ-সংগ্রহালয়েও সেগুলি অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। আজ যে ইংল্যান্ড জুড়ে রডোডেনড্রনের শোভা, তার কারণ হুকার আর তাঁর হিমালয়-ভ্রমণ।

কাজ করতে গিয়ে হুকারকে ঝামেলাও পোহাতে হয়েছে বিস্তর। দার্জিলিং থেকে আনা চমৎকার কিছু প্রজাতির রডোডেনড্রন এক বার নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, পথে কুলিদের শরীর অসুস্থ হওয়ার কারণে রাস্তাতেই অনেক সময় নষ্ট হয়েছিল বলে। হুকার লিখে গিয়েছেন, সেই সব রডোডেনড্রন তাঁকে ফের অনেক কষ্টে সংগ্রহ করতে হয়েছিল। ডায়েরিতে লিখেছেন, ১০০০০-১৩০০০ ফুট উচ্চতায় জন্মানো রডোডেনড্রন ঝোপ থেকে নমুনা সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁর পা আর হাঁটু কেটেছড়ে গিয়ে কী ভয়ানক ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল।

উনিশ শতকের দুর্গম হিমালয়ে কাজ করার পরিবেশও আদৌ সুবিধের ছিল না। হুকার লিখছেন, ‘‘গাছের ডাল থেকে ঝুলিয়ে দেওয়া একটা কম্বল দিয়েই আমার তাঁবুটা তৈরি। সেটার সঙ্গে আবার অন্য একটা কম্বল সাঁটা, আর এ ভাবেই কোনও মতে একটা ঘরের মতো ঠেকনা দেওয়ার চেষ্টা। তাঁবুর অর্ধেকটা জুড়ে আমার খাট, তার তলায় আমার জামাকাপড়ের বাক্স। আর আমার বইপত্র, লেখালিখির সরঞ্জাম— সব রাখা টেবিলের তলায়। বাইরের দিকে এক কোনায় ব্যারোমিটারটা ঝোলানো থাকত, অন্য সব যন্ত্রপাতি চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো।’’

চার বছর ধরে হুকার নিরলসভাবে ঘুরে বেড়িয়েছেন হিমালয়ের বিপদসংকুল পথ। অনুসন্ধান করেছেন হিমালয়ের উদ্ভিদরাজি। এই করতে গিয়ে সিকিমে বন্দি হয়েছিলেন রাজার হাতে, জেলেও থাকতে হয়েছিল অনেকদিন। কারণ তিনি সিকিম থেকে তিব্বতে ঢুকতে চেয়েছিলেন। একে দম খাস এক্সপ্লোরার এর মত!

এই নিয়ে যুদ্ধের দামামা বেজে গিয়েছিল আরেকটু হলেই। না ছাড়লে পরিণাম ভয়ংকর হবে, ব্রিটিশ সেনাদের হুমকিতে রাজা শেষমেশ তাঁকে মুক্তি দেন। এক সিকিম থেকেই হুকার সংগ্রহ করেছিলেন রডোডেনড্রনের ২৫টি প্রজাতি।

হুকারের আঁকা এই সব রডোডেনড্রনের অজস্র ‘ফিল্ড স্কেচ’-এর লিথোগ্রাফ-কপি নিয়ে পরে প্রকাশিত হয়েছিল ওয়াল্টার হুড ফিচ-এর বিখ্যাত বই ‘দ্য রডোডেনড্রনস অব সিকিম-হিমালায়াজ’।

১৮৫১ সালে হুকার ভারত থেকে ফিরে যান স্বদেশে— রডোডেনড্রনের প্রায় ৭০০০ প্রজাতির নমুনা সঙ্গে নিয়ে। চার বছর পর, ১৮৫৫ সালে প্রকাশিত হয় ভারতীয় গাছপালা নিয়ে লেখা তাঁর বই ‘ফ্লোরা ইন্ডিকা’।

কিন্তু তাঁর সবচেয়ে চমকপ্রদ কাজ বোধ হয় দ্যা হিমালায়ান ডায়রিজ। তাঁর এই অনুসন্ধানী অভিযানের টুকরো কিছু গল্প নিয়ে দ্বিজেন শর্মা লিখেছিলেন হিমালয়ের উদ্ভিদরাজ্যে: ডাল্টন হুকার। এই লিখাটি সেই বই থেকেই অনেকখানি উদ্ধৃত। পাহাড় প্রেমীদের বইটি অবশ্যই পড়া উচিত।

ছবিতে রোলওয়ালিং খোলা নদীর উপর ঝুলে থাকা এই রডোডেনড্রন গাছটি দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েছিলাম। তখনই মাথায় ঢুকে গিয়েছিল হুকার আর মহীনের ঘোড়াগুলি। হুকারের চিন্তা পাশে রেখে গুনগুন করে উঠেছিলাম:

‘…সুতো বাঁধা যত লাল আর সাদা
ওড়াই আমার থতমত এই শহরে
রডোডেনড্রন
তোমায় দিলাম আজ…’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!