‘ওজারতির দুই বছর’ বইটিতে বাংলাদেশের এক গুরুত্বপূর্ণ সময়ের ইতিহাস তুলে ধরেছেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান। এতে লেখক হিউমেরাসলি তাঁর পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময়ের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। আমাদের স্বাধীনতাপূর্ব ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় সম্পর্কে জানার জন্য এটি একটি অপরিহার্য বই। তবে বইটি আমার কাছে বেশী ইন্টারেস্টিং মনে হয়েছে কারণ এতে একজন মুখ্যমন্ত্রীর দৃষ্টিতে আমলাতন্ত্রর বিষয়ে খোলামেলাভাবে লেখা হয়েছে।
স্বাধীনতার আগের আর স্বাধীনতার ৫০ বছর পরের আমলাতন্ত্রের সাথে কতটা পার্থক্য আছে সেটার একটি তুলনামূলক চিত্র পেতে অনেক হ্যান্ডি একটি রেফারেন্স !
আমলা ও আমলাতন্ত্র সম্পর্কে আতাউর রহমান কি লিখেছেন তার থেকে কয়েকটি লাইন কোট করার লোভ সামলানো যাচ্ছে না-
‘আমলাতন্ত্রের ইতিহাস সকরুণ। তিক্ত, বিষাদময়। মাঝে মাঝে বেশ গ্লানিজনক। … ব্রিটিশ চলে গেছে, কিন্তু তার প্রবর্তিত আমলাতন্ত্র ভূত হয়ে আছে এদের ঘাড়ের ওপর। আমলাতন্ত্রের ঘাঁটি সেক্রেটারিয়েট। এখান থেকে বোতাম টিপলেই শাসনযন্ত্র চালু হয়। অবশ্য শাখা দপ্তরও আছে। বেচারারা ওখান থেকেই কেন্দ্রের অনুকরণ করার চেষ্টা করে।’
‘আমলাতন্ত্রের জীবন আত্মকেন্দ্রিক। জীবনদর্শন অত্যন্ত সংকীর্ণ। দৃষ্টি অপরিচ্ছন্ন। নিজেদের মান-মর্যাদা সম্বন্ধে ভয়ংকর সচেতন। কিসে মানের হানি হলো, মর্যাদা কমে গেল, সেদিকে দৃষ্টি অতিশয় প্রখর। তোমরা ঠিকমতো কাজ করতে পার না, যোগ্যতা নাই- এ কথা বললে রাগে ফুলে যায়। কী, এতবড় বেইজ্জতি?’
‘রাজনীতিকের দেশপ্রেম আর সরকারি কর্মচারীর দেশপ্রেমের সংজ্ঞায় পার্থক্য আছে অনেকখানি। যে কর্মচারী কর্তব্যে শিথিল, তার দেশপ্রেম কতটুকু হতে পারে। দেশকে ভালোবাসা মানেই তো দেশের সার্বিক কল্যাণ বিধানে সাহায্য করা। আমলাতন্ত্রের চিন্তাধারা অস্বচ্ছ। কোনো গভীর ব্যাপারে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে তারা পারে না। অথচ বিশেষজ্ঞ বলে দম্ভ আছে।’
‘ব্রিটিশ শাসনের আমলে দেশ শাসনের জন্য কতিপয় উচ্চপদস্থ কর্মচারী প্রধানত বিদেশি শাসকের উপদেষ্টা হিসাবে কাজ আরম্ভ করেছিলেন, কালক্রমে তারাই আমলাতন্ত্রের ভিত্তিপত্তন করেন। এরা ছিলেন সেক্রেটারি অব স্টেটের এজেন্ট। আমলাতন্ত্র আজব বস্তু। উপরের স্তরে সিভিলিয়ান-ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিস, ইন্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিস ইত্যাকার বড় বড় হোমরাচোমরা, নিচের দিকে নেমে কেরানি পর্যন্ত। এ বিরাট প্রতিষ্ঠানে শ্রেণিভেদ ছিল। এরা বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী। নিম্নবর্ণের সঙ্গে উচ্চবর্ণের জলচল, এমনকি ওঠাবসাও নেই। বড় ছোটকে ঘৃণা বা করুণার চোখে দেখে। সমানে সমানেও দ্বন্দ্ববিরোধ। অভ্যন্তরীণ বিরোধ সত্ত্বেও গোটা শ্রেণি একটা বিশেষ মনোবৃত্তি সম্পন্ন। সমাজে বাস করেও সাধারণ মনুষ্য-সমাজের বাইরে।’
‘আমলাতন্ত্রের জীবন একমুখী। একগুঁয়েমি স্বভাবের জন্য অনেক কাজের ক্ষতি হয়। দেশের উন্নয়ন কাজে সাধারণত আমলাতন্ত্র পক্ষপাতী নন। উন্নয়ন মানেই কাজ বৃদ্ধি। তাহলেই খাটুনি বাড়ে। দৃষ্টি অতি সংকীর্ণ। নাকের ডগার বাইরেই দিকচক্রবাল। তার বাইরে অন্ধকার। আমলাতন্ত্র রক্ষণশীল। প্রাচীনকে আঁকড়ে ধরে তার রসাস্বাদন করে এরা আনন্দ পায়। নতুন কিছু প্রস্তাব করলেই তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।’
‘একটা ব্যাপারে আমলাতন্ত্র খুব নিপুণ। রুল দিয়ে দেশকে রুল করা। প্রায় পঞ্চাশ বছর আগের গোলামি যুগের কতকগুলো জরাজীর্ণ নিয়মাবলির বস্তা এখনো কাঁধে নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে। … এ রুলই নাকি আসল বস্তু। আর বাকি সব জড়পদার্থ। … কোনো কাজ করতে গেলে করার চেয়ে না করার পক্ষে যত নিয়ম, উপনিয়ম, ধারা, উপধারা, প্রকরণ সব মুখস্থ। উদ্বৃত করে দেবে আমলাতন্ত্র। এক পা এগোবার উপায় নেই।’
বই: ওজারতির দুই বছর
লেখক: আতাউর রহমান খান
প্রকাশনী: নওরোজ কিতাবিস্থান