এভারেস্ট আরোহণকে কেন্দ্র করে বানানো অন্যতম শক্তিশালী অ্যাডভেঞ্চার ফিল্মটি গতকাল আবার দেখেছি। আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার চলচ্চিত্র নির্মাতা রেনান অজটার্কের কাজ সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নাই। ‘ডাউন টু নাথিং’, ‘দ্যা লাস্ট হানি হান্টার’ এর মত আউটডোর অ্যাডভেঞ্চার চলচ্চিত্রের ডিরেকশন থেকে শুরু করে মেরুতে তার অনবদ্য হাই অল্টিটিউড সিনেম্যাটোগ্রাফি সবাইকে মুগ্ধ করেছে।
তার এইবারের নিবেদন ‘দ্যা গোস্টস অ্যাবোভ’ এর প্লট থেকে শুরু করে, ঘটনা প্রবাহ, পর্বতারোহণকে দর্শনগত দিক থেকে দেখার চেষ্টা করা, পর্বতারোহণে শেরপাদের অবদানকে তুলে ধরার চেষ্টা, মাথা নষ্ট করা কিছু ভিজুয়ালস, আর রেনানের ডেডিকেশন আর প্রফেশনালিজম- সব কিছু মিলিয়ে ফিল্মটি মুগ্ধ করতে বাধ্য।
‘দ্যা গোস্ট অ্যাবোভ’ ফিল্মটি এভারেস্টের উপর নির্মিত। ১৯২৪ সালে জর্জ ম্যালরী ও স্যান্ডি আরভিন এভারেস্টের সামিট রিজ থেকে হারিয়ে যান। শেষবার যখন তাঁদের দেখা যায় তখন তাঁরা সামিট থেকে খুব বেশী দূরে ছিলেন না। অনেকে এখনও বিশ্বাস করে ম্যালরি আর আরভিনই মানুষ্য প্রজাতির মধ্যে প্রথমবারের মত এভারেস্ট আরোহণ করেছিন। জিওগ্রাফিক্যাল এক্সপ্লোরেশনের দুনিয়ায় এখনো এটি আন-সলভড মিস্ট্রি হয়ে রয়ে গেছে। এই রহস্যের সমাধান হতে পারে যদি কেবল স্যান্ডি আরভিনের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ সবার বিশ্বাস আরভিনের পকেটে যেই ক্যামেরা ছিল তাতেই পাওয়া যাবে রহস্যের চাবিকাঠি।
ম্যালরী-আরভিন অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে বিস্তর বই লেখা হয়েছে। কিছুদিন আগে বাবর ও সুদীপ্ত অনুদিত এমনই একটি বই ‘ম্যালরী ও এভারেস্ট’ অদ্রি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই রহস্য সমাধান ও অভিযাত্রী দুজনের মৃতদেহ খুঁজে পেতে পৃথিবীর সর্বোচ্চ কবরস্থানে চালানো হয়েছে বিস্তর অভিযান। দ্যা গোস্টস অ্যাবোভ স্যান্ডি আরভিনের মৃতদেহ খুঁজে বের করার ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের সর্বশেষ অনুসন্ধানী অভিযানের প্লট নিয়েই নির্মিত।
১৯৯৯ সালে এই রকমই একটি অনুসন্ধানী অভিযানে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল জর্জ ম্যালরীর মৃতদেহ। তখন থেকেই স্যান্ডি আরভিনের মৃতদেহের অবস্থা নির্ণয়ের জন্য অনেক চেষ্টা চরিত্র করা হয়। বাতাসে অনেক থিওরি অনেক হাইপোথিসিস ভেসে বেড়াতে থাকে। এইরকমই একটি সূত্র থেকে এই অভিযানের সূত্রপাত। এতদিনের অমীমাংসিত একটি রহস্য সমাধান করার জন্য এগিয়ে আসে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক। এভারেস্টের ডেথজোনে আট হাজার তিনশ মিটার উচ্চতায় একটি মৃতদেহ অনুসন্ধানে বের হয় একদল অভিযাত্রী। এটাই হচ্ছে এই ফিল্মের প্লট।
এই ফিল্মটি রেনানের পারসোনাল ন্যারেটিভ। চলচ্চিত্রকার হিসেবে এই অভিযানের সাথে ও নিজে কিভাবে জড়িত ছিল সেটাই পুরো ফিল্ম জুড়ে দেখানো হয়েছে। এটাকে পুরো অভিযানের গল্প না বলে রেনানের পারসোনাল একাউন্ট ধরে নিলেই বুঝি বেশী এপ্রোপ্রিয়েট হয়।
চলচ্চিত্রটি সেখে বেশ কিছু বিষয় আমার মাথায় ঘুরঘুর করছে যাদের মধ্যে অন্যতম হল:
[১] মাউন্টেনিয়ারিং ও শেরপা গাইড এই শব্দ দুটি এখন সমার্থক হয়ে গেছে। শেরপারা না থাকলে ৯৯ শতাংশ মানুষ এভারেস্ট ও অন্যান্য আট হাজার মিটার উচ্চতার চূড়া ক্লাইম্ব করতে পারত না। আর ভবিষ্যতেও পারবে না। তারপরেও ক্লায়েন্টরা হয়ে যায় সেলিব্রেটি মাউন্টেনিয়ার আর শেরপারা থেকে যায় শেরপা- শেরপাদের মাউন্টেনিয়ার হিসেবে মেনে নিতে আমাদের খুব অনীহা হয়।
এভারেস্টের কথা বাদ দেই। আমরা যারা এখন বান্দরবানের বিভিন্ন চূড়া বা ট্রেইলে যাই, স্থানীয় যারাই আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান আমাদের গল্পে তাদের নাম ধাম ছবি টবি কিছুই থাকে না। যারা আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যান, যাদের জন্য আমরা আমাদের গন্তব্যে যেতে পারছি ফিরে আসার পর আমাদের গল্প থেকে তারা বেমালুম গায়েব হয়ে যান। কেন?
[২] ফিল্মে দেখানো হয়েছে এক্সপেডিশনের সদস্যরা স্থানীয় শেরপাদের যথেষ্ট রেসপেক্ট করে। তাদের কথা তুলে ধরতে চায়। কিন্তু ফিল্মেই দেখি তাদের নিজেদের সাথেই কন্ট্রাডিক্টরি কিছু স্ট্যান্ড। এত বড় বাজেটের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি অভিযান। এর জন্য অনেকদিন ধরে পরিকল্পনা করা হচ্ছে। তারা যে নিছক এভারেস্ট সামিট করতে আসেন নাই, একটা মৃতদেহ খুঁজতে আসছেন এত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য শেরপা গাইডদের জানানো হল একদম শেষ মুহুর্তে। রেনান নিজেদের মধ্যকার এই কন্ট্রাডিক্টরি দিকটিও অনেস্টলি ফিল্মে নিয়ে এসেছে।
[৩] শেরপা গাইডডের নিরাপত্তা। ডেথজোনে থাকা মানেই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়া। সেখানে মালামাল পৌঁছানো, ক্লায়েন্টকে (পর্বতারোহী) ধরে ধরে নিয়ে যাওয়া, টেন্ট পিচ, রান্না করার মত কাজগুলো করা হাজার হাজার গুন কঠিন হয়ে যায়। সেখানে পড়ে থাকা বিস্তর লাশের ভিড়ে প্রায় শত বছর আগেকার একটি মৃহদেহ খোঁজা সম্পূর্ণ ভিন্ন ব্যাপার। এতে এক্সপোজার থেকে শুরু করে কষ্ট আর রিস্ক কয়েকগুন বেশী। শেরপারা এই রকম একটি অনুসন্ধানে রাজি কিনা, তাদের আগ্রহ আছে কিনা, এক্সপেডিশন দল আগে থেকে এটা চিন্তাই করে নি। তাদের চিন্তা ভাবনাও ছিল ক্লিশে- আরে এরা শেরপা মানুষ, টাকা দিচ্ছি যেখানে বলব সেখানেই যাবে। তাদেরও যে মতামত থাকতে পারে, ইচ্ছা অনিচ্ছা থাকতে পারে এই এক্সপিডিশন টিমও সেটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে গেছে।
[৪] আরেকটা দিক হচ্ছে সাফল্য। সবার জন্য এখন সফলতার চাবিকাটি হচ্ছে এভারেস্ট সামিট করা। নবীন শেরপা গাইডদের ক্ষেত্রেও এটা ভিন্ন নয়। এভারেস্ট সামিট করতে পারলে পরবর্তীতে কাজ পেতে সুবিধা হবে, ক্লায়েন্ট পেতে সুবিধা হবে। তাই নবীন শেরপাদের জন্য সামিট করাটা খুব জরুরি হয়ে পড়ে। আবার একই সাথে এটাও নিশ্চিত করতে হয় যেন তার ক্লায়েন্ট সুস্থ স্বাভাবিক থাকে। এটা তার রেপুটেশনের ব্যাপার। সে যে ক্লায়েন্টদের ঠিকঠাকভাবে দেখভাল করতে পারে, নিরাপদ রাখতে পারে আবার সামিট ও করাতে পারে এটা প্রমাণ করতে পারলেই কেবল তার ইনকামটা নিশ্চিত হবে।
[৫] যারা আমার লেখা অনেক আগে থেকে পড়েন তারা হয়ত জানবেন, গত দুই তিন বছর ধরে সামিটে যাবার ব্যাপারে বড়ই অনিহা হয়। সামিটের একদম কাছাকাছি গিয়ে থেমে যাই। একদম মূল চূড়ায় আর উঠি না। আমি অনেকদিন ভেবেছি এর পিছনে কারণ কি? আমি নিজে এখনো জবাব পাইনি।
তবে ফিল্মে রেনানের এভারেস্ট সামিট না করা, ১০ ফিটে নিচে গিয়ে থেমে যাওয়া, পৃথিবীর সর্বোচ্চ চূড়ায় পা রাখার আর্জ দমন করতে পারা একটা বিশাল ব্যাপার- রিয়েলি ইন্সপায়ারিং। আমি তো এটা ভেবেই খুশি যে যাক আমি বা আমরা একা এমন না, এই রকম দ্বিধা আরও অনেকের মনে চলতে থাকে।
[৬] হাই অল্টিটিউদে ফটোগ্রাফি আর সিনেম্যাটোগ্রাফি করা আমার কাছে অতি আশ্চর্যের কাজ মনে হয়। যারা এই কাজ করে তাদের অতিমানব মনে হয়। যেখানে নিঃশ্বাস নেয়াই একটা চ্যালেঞ্জ সেখানে প্রতিক্ষণে ক্ষণে ফ্রেম ঠিক করে, ম্যানুয়ালি এডজাস্ট করে ছবি তোলা, ভিডিও করা – বাপ রে। যেই ঝড়ের মধ্যে বসে/দাঁড়িয়ে রেনান ফুটেজ নিয়েছে তা এক কথায় অসাধারণ। এমন একটি জায়গায় এই রকম বিরুপ আবহাওয়ায় নিজের নিরাপত্তার কথা ভুলে গিয়ে ফুটেজ নেয়ার মত মানসিকতা আর শক্তি সবার থাকে না। এই মানুষগুলোর এই স্কিল প্যাশন আর ডেডিকেশন আছে বলেই এত অসাধারণভাবে পাহাড়-পর্বতকে আমরা শুয়ে বসে ভিজুয়ালাইজ করতে পারি।
[৮] পৃথিবীতে সবার দৃষ্টিভঙ্গি একরকম হবে না। সবাই একই কারণে বা একইভাবে পর্বতারোহণও করবে না। এই চলচ্চিত্র যারা বানিয়েছে তারা খুব সুনির্দিষ্টভাবে কমার্সিয়াল মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ও যারা ক্লায়েন্ট হিসেবে হাই অল্টিটিউড ট্যুরিজমের প্যাকেজে আসেন তাদেরকে একটু নিচুভাবে দেখানোর প্রয়াশ করেছেন। এই ব্যাপারটি আমার কাছে নেগেটিভ লেগেছে।
[৭] লাস্ট বা নট লিস্ট, এই চলচ্চিত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী ডায়লগটি উল্লেখ না করলেই নয়;
“Climbing is also a form of greed”- Tengboche rinpoche
চলচ্চিত্রটি দেখে কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না।