সুজন মিয়ার অ্যাডভেঞ্চার

গতকাল ঢাকা মহানগরীতে অভূতপূর্ব একটি ঘটনা ঘটেছে। ২৫ বছর বয়সের একজন তরুণ সোহ্‌রাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা স্তম্ভের উপরে উঠে গেছে। তরুণের নাম সুজন মিয়া। ১৫০ ফিট উঁচু এই গ্লাস টাওয়ারের স্টিলের স্ট্রাকচারটি তিনি পুরোটা ক্লাইম্ব করে উঠেছেন।

জাস্ট কল্পনা করুন, কম বেশী দুই কোটি মানুষের ভিড়ে একজন মানুষ যিনি ১৫০ ফিট উপর থেকে পুরো শহরটি দেখেছেন।

এরপর নিচ থেকে কেউ তাঁর এই কীর্তি দেখে ফেলেন ও ক্লাসের সেই ভালো বাচ্চাটার মত, যে টিচারের কাছে ক্লাসমেটদের চুগলি করে- ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেন। ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা ক্রেন-ট্রেন নিয়ে তাঁর সাথে কথা বলার সময় সুজন মিয়া খুব নিরীহভাবে তাঁদের কাছে একটি সিগারেট চান। বেচার বোধ হয় উত্তেজনায় সিগারেট না নিয়েই উপরে উঠে গিয়েছিল। টপে উঠে তাঁর চিরচেনা ঢাকাকে অন্যভাবে আবিষ্কারের পর সুজন মিয়ার সেই সময়কার নিকোটিনের আর্জটি শুধু অনুভব করার একবার চেষ্টা করুন।

এই সেন্স অফ অ্যাডভেঞ্চার খুব মজার জিনিস। ঐ কাজ বা অভিজ্ঞতাগুলোই আসলে অ্যাডভেঞ্চার যা করতে গেলে আমাদের একটু সাহস লাগে। যেই কাজে কিছুটা ঝুঁকিও আছে। যেই কাজে ফলাফল আগে থেকে প্রেডিক্ট করা যায় না। যেই কাজগুলোতে পদে পদে অনিশ্চয়তা থাকে। আর সবশেষে যেই কাজগুলো করার সময় উত্তেজনায় বুক দুরুদুরু করে- নিজের কমফোর্ট জোন থেকে বের হয়ে নতুন কিছু করাই অ্যাডভেঞ্চার।

আর অ্যাডভেঞ্চার মানুষের ইন্ট্রিনসিক নীড, আদিমতম প্রবৃত্তি। সমাজের চাপে ভোঁতা হয়ে যাওয়া ‘নরমাল’ দৃষ্টিকোণ থেকে যতই এই কাজগুলোকে আমরা পাগলামি/মাথা খারাপ/অপরাধের তকমা দিয়ে ভ্যানিস করে দিতে চাইনা কেন- বারে বারে নানারুপে এটা মানুষের মাঝে আসবেই। এই সেন্স অফ অ্যাডভেঞ্চার থেকে কোন মুক্তি নেই।

আমি অনেক ভাগ্যবান যে আমার মধ্যে জন্ম নেয়া অ্যাডভেঞ্চারের এই খুদা নিবারণ করার জন্য আমার কাছে অনেক উপায় আছে। কিন্তু সেই তরুণ তরুণীদের কথা একবার ভাবুন যারা অ্যাডভেঞ্চারের অব্যক্ত তাড়নাগুলো নিয়ে শুধু ছটফট করতে বাধ্য হয়। এই তাড়নাগুলোকে ব্যক্ত করার, তাঁদের প্রতিভা, স্কিল, প্যাশন আর কৌতূহলগুলোকে জায়গামত হারনেস করতে পারেনা। নিজের মধ্যেই নিজেকে গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

এভাবেই আমাদের নগরীতে অ্যাডভেঞ্চারগুলো প্রতিদিন খুন হতে থাকে। এর কোন বিচারও হয় না, হবেও না। বরং উল্টোটাই সত্যি। সুজন মিয়াকে পুলিশে সোর্পদ করা হয়েছে। শাহবাগ থানায় নিয়ে গেছে তাঁকে। কি আছে তাঁর কপালে কে জানে। পুলিশ ইন্টারোগেশনে রাতের অন্ধকারে কেন সে চেতনার স্তম্ভে ঝুঁকি নিয়ে উঠেছিল এর কোন সদুত্তর সে দিতে পারবে বলে মনে হয় না। সে তাঁর কৌতূহলের কথা, তাঁর স্পার্কলিং অনুভূতির কথা, এড্রিনালিন রাশের কথা, নিকোটিন আর্জের কথা বুঝাতে পারবে না। আর পারলেও, পুলিশ কিছুই বুঝবে না।

জাস্ট কল্পনা করুন, আমাদের নগরে সুজন মিয়ার মত অ্যাডভেঞ্চার সিকারদের জ্ন্য একটা ক্লাইম্বিং ওয়াল থাকত। সবুজ মিয়া যদি সেখানে প্রতিদিন ক্লাইম্বিং প্র্যাক্টিশ করতে পারত, হয়ত একদিন এই সবুজ মিয়া অলিম্পিকে বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করতে পারত।

সুজন মিয়া, আপনার কিউরিওসিটি ও সেন্স অফ অ্যাডভেঞ্চারকে স্যালুট জানাই। আমাদের সকলের মনে সুজন মিয়ার মত কৌতূহলী ও অ্যাডভেঞ্চারাস যেই আত্মাটি ঘুমিয়ে আছে তা জেগে উঠুক, নিজেকে ব্যক্ত করার সুযোগ পাক।

ছবি: পিনু রহমান/ উইকিমিডিয়া কমন্স।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!