চৈত্রের খা খা গরমে পানি শূন্য ঝিরি ধরে হাঁটতে হাঁটতে একসময় পৌঁছে গেলাম জলপ্রপাতটির ঠিক মাথায়। মুহূর্তের মধ্যেই শরীরের সব পেশীগুলো শক্ত হয়ে গেল। বিপদের আশঙ্কায় মস্তিষ্ক অতিরিক্ত সচেতন হয়ে গেল। তবুও রোমাঞ্চের নেশা সকল ভয়কে ঠেলে সরিয়ে দিল। পা টিপে টিপে সবুজ পিচ্ছিল শ্যাওলা জমে থাকা পাথরের মধ্য দিয়ে পা টিপে টিপে এগুতে লাগলাম। খাদের একেবারে কিনারে এসে পা দুটো আপনা আপনি থমকে দাঁড়াল। পুরো আকাশ যেন আমার সামনে নিচে নেমে এল। বুকের ভিতর তখন ধড়াস ধড়াস করে আদিম উত্তেজনা লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
খাদের নিচে কি আছে তা দেখার জন্য শরীর ব্যালেন্সটা ঠিক রেখে একটু ঝুঁকে দাঁড়ালাম। অতল শূন্যতা পেড়িয়ে চোখ আটকে গেল নানা আকারের পাথরের চাঁইগুলোর দিকে। বিশাল বিশাল পাথরের বোল্ডারগুলোকে উপর থেকে কতইনা অকিঞ্চিৎকর লাগছে। তখন সাঁই সাঁই করে ঝাঁকে ঝাঁকে নাকুটি পাখি যুদ্ধ বিমানের মত আমাকে পাশ কাটিয়ে উড়ে গেল। হঠাৎ বাতাসের ঝাপটায় গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে উঠল। কি সুন্দর!
কি ভয়ানক সুন্দর সব কিছু। আমার চোখের সামনে থমকে থাকা এই বিশাল শূন্যতায় তখন হাজারও ছোট ছোট পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। মনে হলো কেউ যেন আমাকে হাজার হাজার আলোকবর্ষ দূরের রাজ্য প্যান্ডোরায় পৌঁছে দিয়েছে। এখনই আমাকে সেই কঠিন পরীক্ষাটি দিতে হবে। নিজের জন্য পছন্দ করতে হবে একটি ইকরান। যার আত্মার সাথে মিশে গিয়ে আমিও উড়ে বেড়াতে পারব এই অসীম আকাশে। এর আগে কখনোই এমন মনে হয়নি। আমার ভিতরে কেউ খুব করে চাচ্ছিল দু হাত শুন্যে মেলে দিয়ে শুন্যতায় ঝাঁপিয়ে পড়তে। পরক্ষণেই বুঝলাম এখনো আমি ঠিক স্বাধীন হইনি। অনেক কাজ করতে হবে এখন। কল্পনায় হারিয়ে যাবার একদম সময় নেই।
‘ট্র্যাভেলার্স অফ বাংলাদেশ’ তার জন্মলগ্ন থেকেই দেশের পাহাড়ি অঞ্চলগুলোতে অনুসন্ধানী অভিযান পরিচালনা করে আসছে। এই বছর টিওবির এক্সপ্লোরেশন প্রজেক্ট থেকে বাংলাদেশের জলপ্রপাতগুলোর একটি তথ্যভিত্তিক ডাটাবেজ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এই প্রজেক্টের আওতায় থানচি উপজেলার একটি জলপ্রপাতের উচ্চতা, আকার, আকৃতি, উৎস, পানির নিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ এই জলপ্রপাত সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করতে আমাদের বান্দরবান আগমন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়েতে প্রচণ্ড জ্যাম দেখে প্রথমে একটু দমে গেলেও আমরা সকালের মধ্যেই আলীকদম পৌঁছে গেলাম। পূর্বে এই পথে ভ্রমণ করা কয়েকজন অগ্রজ জানিয়েছিলেন, জলপ্রপাতটি থানচির তিন্দু ইউনিয়নে অবস্থিত হলেও আলীকদম উপজেলা দিয়ে কম সময়ের মধ্যে এ জায়গায় পৌঁছানো সম্ভব। স্থানীয় হোটেলে নাস্তা করেই ঐতিহ্যবাহী চান্দের গাড়িতে রওনা হয়ে পড়লাম।
আলীকদম ও থানচি উপজেলার সংযোগ সড়ক দিয়ে আমাদের চান্দের গাড়ি ছুটে চলেছে। চৈত্রের উত্তাপে চারপাশের সব পাহাড় বাদামী হয়ে আছে। আকাশও কেমন যেন অস্পস্ট, ধূসর এবং ঘোলাটে। এই সময়ে পাহাড়ে এলে মনে হয় সবকিছু যেন মন খারাপ করে মুষড়ে পড়েছে। প্রকৃতির পোড় খাওয়া ক্যানভাসে হঠাৎ হঠাৎ উজ্জ্বল লাল পলাশ ঝিলিক দিয়ে উঠে। প্রখর খড়তাপে সদ্য পিচ ঢালাই করা রাস্তা থেকে উড়ে যাওয়া বাষ্পের মরিচিকা দেখতে দেখতে তন্দ্রার মত চলে এসেছিল। তখনই গাড়ি থেমে গেল। আমরা থিনকু ক্যাম্প চেক পোস্টে পৌঁছে গেছি। এখানে আমাদের অনুমতিপত্র চেক করা হবে।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে অনুমতি নিয়ে আবারও পথচলা শুরু হল। এবার পথ একটানা চড়াই হয়ে উপরে উঠে গেছে। বহুদিন আগেই মেয়াদ ফুরিয়ে যাওয়া গাড়িটি বেশ কয়েকবার কর্কশ আপত্তি জানালেও চালকের দক্ষতায় আমরা সহিসালামত গন্তব্যে পৌঁছে গেলাম।
ধুলায় ধুসরিত মাটির রাস্তা ধরে আমরা এগিয়ে চলেছি। এই পথে একটিও পানির উৎস খুঁজে পেলাম না। কিছুক্ষণের মধ্যেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল। মাথার উপরে প্রচণ্ড তাপের সাথে মাটিও সমানতালে তেতে উঠেছে। একদণ্ড বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটি গাছের ছায়াও এখন অপ্রতুল হয়ে গেছে।
তিন ঘণ্টা ট্রেক করে যখন তিন্দু ঝিরিতে এসে পৌঁছেছি তখনও সূর্যের তাপ একটুও কমেনি। তিন্দু ঝিরিতে পানি একেবারে নেই বললেই চলে। সেইসাথে অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম রুমা খালের মত এই ঝিরি থেকেও নির্বিচারে পাথর তুলে নেওয়া হচ্ছে। এই পাথর দিয়ে তৈরি হচ্ছে অপরিকল্পিত রাস্তা। আসছে বর্ষায় এই পথের অনেকখানি যে ধ্বসে যাবে এই কথা নিশ্চিতভাবে বলে দেওয়া যায়।
তিন্দু ঝিরিতে বিশ্রাম নিয়ে শেষ বিকেলে আবার রওনা হয়ে পড়লাম পাও-অ পাড়ার পথে, ছোট্ট এই খুমি পাড়াটিই আমাদের আজকের গন্তব্য। এ পাড়া থেকেই জলপ্রপাতে যাবার রাস্তা চলে গেছে। উজ্জ্বল চাঁদের আলোয় পথ চলে পাড়ায় গিয়ে যখন পৌঁছালাম ঘড়িতে তখন রাত আটটা বেজে গেছে।
পাড়া থেকে জলপ্রপাতটি সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেল। যেই ঝিরিটি প্রপাত হয়ে নিচে পড়েছে সেখানে ছোট একটি বাদুড় গুহা আছে। মারমা ভাষায় বাদুরের নাম অনুসারে এই ঝিরিটিকে লাংলোক নামেই ডাকা হয়। ঝিরির নামানুসারে মারমা ভাষায় প্রপাতটিও লাংলোক নামেই পরিচিত।
পরদিন সকাল থেকেই আমাদের কাজ শুরু হলো। উচ্চতা মাপার জন্য আমাদের প্রপাতের পতন স্থলে যেতে হবে। পাড়া থেকে সব সাজসরঞ্জাম নিয়ে আমরা ঝিরিতে নেমে পড়লাম। দুটি ছোট ঝিরি পেড়িয়ে আমরা মূল ঝিড়িতে গিয়ে নামলাম। বড় বড় সমান পাথরগুলো পানির অভাবে জেগে উঠেছে। দুইদিকের পাহাড় খাড়া হয়ে উপরে উঠে গেছে। পুরো ঝিরিপথটুকু বিশাল বিশাল বৃক্ষ দিয়ে ছেয়ে আছে তাই সূর্যের আলো এখানে প্রবেশ করে না। খুব সাবধানে এগুতে এগুতে একসময় আমরা জলপ্রপাতের ঠিক মুখে এসে থমকে দাঁড়াই।
ঘোর ভাঙতেই সবাই কাজে নেমে পড়লাম। জলপ্রপাতটি পানির অভাবে একদম খটমট হয়ে আছে। প্রথমের উচ্চতার প্রাথমিক ধারণা পাওয়ার জন্য উপর থেকে বড় একটি পাথর ফেলে দিলাম। ১২ সেকেন্ড পর পতনের শব্দ পাওয়া গেল। অভিকর্ষ ও পতনকাল থেকে উচ্চতার মোটামুটি একটা ধারণা পেলাম। এরপর আমরা ব্রুট ফোর্স মেথডে এর উচ্চতা পরিমাপ করলাম। লম্বা একটি রশিতে ওজন বেধে প্রপাতের উপর থেকে ধীরে ধীরে নিচে নামিয়ে দিলাম। ফল লাইন যেন সমান থাকে ও দড়ি যেন কোথাও আটকে না যায় এবং পানি ঠিক যেখানে স্পর্শ করে সেখান পর্যন্তই যেন দড়িটি পৌঁছায় তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা পাশ দিয়ে একটি র্যাপেল লাইন সেট করে ফেলি।
প্রপাতের উপর থেকে নিচ পর্যন্ত র্যাপেল করে নামার আরেকটি উদ্দেশ্য হলো তার আকার ও আকৃতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া। এখান থেকে শুরু হল আমাদের অভিযানের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং ও বিপদজনক অংশ। অ্যাংকর সেট করে, সব সাজসরঞ্জাম পড়ে ইন্তিয়াজ যখন সবার প্রথমে নামা শুরু করল তখন পর্যন্ত আমরা সবাই এক ধরনের অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিলাম। সব কিছু ঠিক আছে তো, কোথাও কোন ভুল হয়ে যায়নি তো? এই ধরনের খেয়ালগুলো মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। বেশ অনেকক্ষণ পর কমলা একটি অবয়বকে যখন নিরাপদে নিচে নেমে যেতে দেখলাম তখন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলাম। এরপর একে একে মুনীম, অনিক, সন্দীপ, শামীম, আমি ও শুভ র্যাপেল করে নিচে নেমে গেলাম। বড় কোনও সমস্যা ছাড়াই সফলভাবে শেষ হলো আমাদের অনুসন্ধানী অভিযান।
এই অভিযান থেকে লাংলোক জলপ্রপাতটির উচ্চতা পাওয়া গেল ৩৯৩ ফিট যা আমাদের প্রাথমিক ধারণা থেকে অনেক উঁচু। জলপ্রপাতটি একেবারে খাড়া হয়ে নিচে নামেনি। ২০ ফিটের মত খাড়া নামার পর জলপ্রপাতটির দেয়াল ভিতর দিকে অবতল আকার নিয়েছে। মাঝামাঝি স্থানে পানি প্রবাহের ফল লাইন থেকে দেয়ালের দূরত্ব প্রায় ৪০ ফিটের মত। এই খাঁজে বাসা বেঁধে বাস করে নেপালি ঘরনাকুটি/ Nepali house Martin প্রজাতির হাজারো পাখি। জলপ্রপাতের দেয়ালে পানির আড়ালে মাটি দিয়ে তারা অর্ধবৃত্তাকার বাসা তৈরি করে। এত কাছ থেকে পাখির বাসাগুলোকে মনে হয় মৌমাছি ছোট ছোট চাক তৈরি করে রেখেছে। এই পাখিগুলো নাম দিয়ে স্থানীয় খুমিরা এই জলপ্রপাতটিকে ডাকে ‘ফি ফি ক্লে’।
প্রপাতটির পতনের স্থানে কোন ধরনের পুল বা জলাশয় তৈরি করেনি। পুরো জায়গাটি অবতল বলে পানি গড়িয়ে নিচে নেমে যায়। নিচে বিশাল পাথরের বোল্ডারের মধ্য দিয়ে লাংলোক ঝিরি দেড় কিলোমিটার দূরের সাঙ্গুতে গিয়ে মিশে তার যাত্রা শেষ করে।
*পরবর্তীতে পাখি বিশারদ ইনাম আল হক এবং তারেক অনু, এক অভিযানে লাংলোকের দেয়ালে বাসা বাঁধা পাখির কলোনিটিকে নেপালি হাউজ মার্টিন বা নেপালি ঘরনাকুটির বলে নিশ্চিত করেন। তাঁদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের অনেক জায়গায় এই পাখিকে নাককাটি বা নাকুটি নানে ডাকা হয়। উড়ার সময় অনেকেই একে চামচিকা বলে ভুল করেন। চিম্বুকের সর্বোচ্চ চূড়া কির্স তংয়ের দেয়ালেও এই হাউজ মার্টিন পাখির কলোনি দেখা যায়।
4 Responses
Thanks for sharing the stories
My pleasure
When i read your story. I just feel i am their.
thank you very much.