চলচ্চিত্র আলোচনা: সেরো টরে

ডেভিড লামা- পৃথিবীর অন্যতম সেরা এই তরুন এল্পাইনিস্ট ২০১৯ সালে এক এভালাঞ্জ দুর্ঘটনায় মারা যান। এই ফিল্মটি তাঁর একটি মাউন্টেনিয়ারিং প্রজেক্টের উপর নির্মিত হয়েছে। এই অভিযানে পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ পর্বতশ্রেণী আন্দিজের প্যাতাগোনিয়া অঞ্চলের সবচেয়ে আকর্ষনীয় ও দূরহ পর্বত সেরো টরেতে প্রথমবারের মত “ফ্রি ক্লাইম্ব” আরোহণ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন।

ফিল্মটি দেখার আগে কিছু ডিসক্লেইমার পড়ে নিন-

[এক] এই মুভিটি তাঁদেরই ভাল লাগবে যারা মাউন্টেনিয়ারিং এর ব্যাপারে কিছুটা নলেজ রাখেন। এটলিস্ট নানা রকম মাউন্টেনিয়ারিং স্টাইল আর টার্মিনোলজি সম্পর্কে জানেন। এল্পাইনিজম, রক ক্লাইম্বিং, এইড ক্লাইম্বিং, ফ্রি ক্লাইম্বিং, বোল্ট, ফ্রি সলো ইত্যাদি টার্মসগুলো সম্পর্কে ভালো ধারণা থাকলেই কেবল ফিল্মটা পরিপূর্ণভাবে এনজয় করবেন। অন্যরাও থ্রিলিং এক্সপেরিয়েন্সের জন্য দেখতে পারেন তবে আমার মতে ১৫-২০ মিনিট দেখার পর বেশীরভাগই আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন।

[দুই] এই ফিল্মটি পুরোপুরি উপভোগ করতে মাউন্টেনিয়ারিং টার্মের সাথে কিছু জিওগ্রাফিকাল নলেজও আগে থেকে থাকা দরকার। এই এক্সপিডিশনগুলো হয়েছে সাউথ আমেরিকার আন্দিজ পর্বতমালা প্যাতাগোনিয়াতে। এই রিজিওনের বৈশিষ্ট্য ও ওয়েদার প্যাটার্ন সম্পর্কে আগে থেকে জানা না থাকলে ফিল্মের অনেক কিছুই বুঝতে কষ্ট হবে। এর সাথে ফিটজ রয়, সেরো টরে এর মত পর্বতগুলো কেন এত স্পেশাল এই বিষয়ে ধারনা থাকতে হবে।

[তিন] এটা খুবই ইন ডেপথ একটা ফিল্ম। যেখানে এডভেঞ্চার নিয়ে কথাবার্থা খুবই কম। মূল ফোকাস দেয়া হয়েছে ফিলোসফির উপর। এখানে মাউন্টেন এথিক্স, এপ্রোচ স্টাইল, সাকসেস, ফেইলিওর, ফেয়ার মিনস, আইডিওলজির মধ্যকার ক্ল্যাশ, কন্ট্রোভার্সি… একই ফিল্মে একসাথে এত কিছু চলে আসছে যে এই ব্যাপারগুলোর বিষয়ে ধারণা না থাকলে ফিল্মটা খুব বোরিং লাগবে।

এখন বলি এই ফিল্মটা কেন দেখবেন-

[এক] মাউন্টেনিয়ারিং মানে কি শুধুই কোনভাবে সামিটে পৌঁছানো? বেশীরভাগের হয়ত ধারনা এমনই, মাউন্টেনিয়ারিং এর জন্য সামিট জরুরী। কিন্তু প্রকৃত মাউন্টেনিয়ারদের কাছে সামিট করার চাইতেও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল কিভাবে সামিটে যাচ্ছি বা কোন স্টাইলে যাচ্ছি। এই ফিল্মে এই বিষয়গুলা উঠে আসছে।

[দুই] নামি দামি এল্পাইনিস্টদের নাম বা তাদের এচিভমেন্টের খবর যখন আমরা পাই তখন খতিয়ে দেখিনা এর পিছনের ইতিহাস। অনেকের ধারনা এলিট এল্পাইনিস্টরা বোধ হয় কোন অভিযানে গেলে এমনি সামিট হয়ে যায়। এই ফিল্ম দেখলেই বুঝা যাবে এল্পাইন ক্লাইম্বিং কতটা দূরহ আর হতাশাজনক। ফিল্মের এই অভিযান স্যাটিসফ্যাকশনের সাথে শেষ করতে একবার দুবার নয়, পর পর তিনবার এটেমপ্ট নিতে হয়েছে।

এত এত ফ্যাসিলিটি, টপ ক্লাস লজিস্টিকাল সাপোর্ট, বিশ্বের সেরা ওয়েদার ফোরকাস্ট সিস্টেম, ডেডিকেটেড ফিল্ম ক্রু, ২৪x৭ হেলি সাপোর্ট আর রেডবুলের মত স্পন্সরের আশির্বাদ থাকা সত্ত্বেও পৃথিবীর সেরা দুজন এল্পাইনিস্ট প্রথম চেষ্টাতে সামিট করতে পারেনি। এর জন্য তাঁদের বারবার চেষ্টা করে যেতে হয়েছে। তবুও তারা সামিটের জন্য তাঁদের স্টাইল কম্প্রোমাইজ করেনি।

[তিন] এই ফিল্মের আরেকটি ইন্টারেস্টিং বিষয় হল মাউন্টেনিয়ারিং কন্ট্রোভার্সি। ষাটের দশকে ইটালির এল্পাইনিস্ট যুগলের সেরো টরে তে প্রথম অভিযান থেকে এই বিতর্ক শুরু হয়। এই অভিযানে একজন অভিযাত্রী দুর্ঘটনায় মারা যান। আরেকজন দেশে ফিরে সামিটের দাবি করেন, কিন্তু প্রমান দেখাতে না পারায় তাকে মিথ্যাবাদী আখ্যা দেয়া হয়। নিজেকে প্রমান করতে তিনি আবার ফিরে যান চিলি। পাথুরে দেয়ালে ইচ্ছামত ড্রিল করেন, বোল্ট ফিক্স করে পৌঁছে যান সামিটে। প্রমাণ স্বরুপ সামিটের ঠিক নিচেই রেখে আসেন সাথে করে নিয়ে যাওয়া বিশাল এক কম্প্রেসর। আজও সেই কম্পেসরটি সেই জায়গায় রয়ে গেছে। প্যাতাগোনিয়ার বিখ্যাত এই পর্বতটির আরোহণের এই রুটটির নামই হয়ে গেছে কম্প্রেসর রুট।

এরপর আসে ডেভিড লামার পালা। প্রথম অভিযানে ফিল্ম ক্রুদের জন্য অপ্রয়োজনীয় বোল্ট লাগানো ও অভিযান পরিত্যক্ত হবার পর তাঁদের গিয়ার, রোপ, বোল্ট সব সেখানেই তারা ফেলে চলে আসে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ার পর সবাই ডেভিড লামাকে ছি ছি করতে থাকে। দেশ বিদেশের পত্র পত্রিকায় তাঁর মাউন্টেনিয়ারিং এথিক্স নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়। পরবর্তীতে লামা নিজের ভুল বুঝতে পেরে সকলের কাছে ক্ষমা চান।

এর মধ্যে কাহিনীতে প্রবেশ করে কানাডার দুই এল্পাইনিস্ট। তারা ডেভিড লামার জাস্ট কয়েকদিন আগে অভিযানে গিয়ে, পর্বতের শুদ্ধতার জন্য এই রুটে লাগানো সব বোল্ট খুলে নিয়ে চলে আসে। আবার শুরু হয় বিতর্ক। পুলিশ তাদের ধরে নিয়ে যায়।

এরপর ডেভিড লামা ও তার পার্টনার পিটার ওর্টনার অবশেষে সেরো টরে ফ্রি ক্লাইম্ব করতে সক্ষম হয়। আর মিডিয়ার কল্যানে সে রাতারাতি মাউন্টেনিয়ারিং সেনসেশনে পরিনত হয়। অন্যদিকে কানাডিয়ান ক্লাইম্বাদের কথা সবাই বেমালুম ভুলেই যায়। এটা নিয়েও পরবর্তীতে বেশ বিতর্ক হয়।

[চার] এই ফিল্মের সবচেয়ে চমৎকার ব্যাপার হল এর ভিজুয়ালস। গল্পটা সবার কাছে উত্তেজনাকর না লাগলেও প্যাতাগোনিয়ার ভূপ্রকৃতি, দুর্দান্ত সিনেম্যাটোগ্রাফি, আন্দিজের মনমুগ্ধকর সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত, সামিটের দম আটকানো মাশরুমগুলো চাইলেও মাথা থেকে বের করা যাবে না। ইউ উইল বি হুকড।

Enjoy and learn

মুভি দেখার লিংক:

https://www.redbull.com/int-en/films/cerro-torre

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!