অনেক অনেককাল আগের কথা। পৃথিবীতে একাধারে ছিল সূর্য ও চন্দ্রবংশের রাজত্ব। সূর্যদেবের একমাত্র ছেলের নাম ছিল ভাগা। আর চন্দ্রদেবের কন্যার নাম ছিল চন্দ্র। পুরো ভূলোকে চন্দ্রর মত সুন্দরী আর কেউ ছিল না। তাঁকে যেই দেখত সেই ভুবনভোলানো সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে পড়ত। একবার দেবভূমি লাহুল থেকে লাদাখ যাচ্ছিলো সূর্যপুত্র ভাগা। যাবার পথে বারালাচা গিরিবর্ত্মের উপর ভাগা দেখে অতীব সুন্দর একটি মেয়ে গিরিবর্ত্মের উপর আপনমনে খেলছে। এই বারালাচার উপরেই ভাগা ও চন্দ্রর চোখাচোখি হয়। প্রথম দেখাতেই তাঁরা একে অপরের প্রেমে পড়ে যায়। তাঁরা অবিলম্বে বিয়ে করে চিরদিন একসাথে থাকার প্রতিজ্ঞা করে সেদিনের মত যার যার বাসায় ফিরে যায়। এদিকে ছেলে -মেয়ের মুখে এমন অসম্ভব প্রস্তাব শুনে সূর্যদেব ও চন্দ্রদেব রেগে আগুন। সূর্য আর চন্দ্র কিভাবে এক হতে পারে? ভাগার দায়িত্ব দিনের পৃথিবীকে আলোকিত করা আর অন্যদিকে চন্দ্রর কাজ রাতের পৃথিবীকে মোহিত করা। দুজনের মিলন তো অসম্ভব। চন্দ্র ও ভাগাকে শাস্তিস্বরুপ বন্দি করে রাখা হয়। তাঁদের সমস্ত স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া হয়।
দুই প্রেমিক হৃদয় ভেঙে গেলেও একে অপরকে ছেড়ে থাকার কথা তাঁরা ভাবতেও পারেনা। প্রাসাদের দাসীদের সাহায্যে চন্দ্র ভাগার কাছে পালিয়ে যাবার আর্জি জানায়। ভাগাও উত্তরে জানায় দুজন এক হয়ে যাবার এটাই একমাত্র পথ। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেয় আবার বারালাচা গিরিবর্ত্মেই তাঁরা দেখা করবে। প্রথম যেখানে তাঁদের দেখা হয়েছিল সেখানেই তাঁরা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে। পালিয়ে যাবার দিন তারিখও ঠিক হয়ে গেল। দেখতে দেখতে বহু কাঙ্খিত দিনটি চলে এল। চন্দ্র আর অপেক্ষায় থাকতে না পেরে অনেক আগেই বারালাচায় নেমে এল। এদিকে ভাগা তখনও এসে পৌঁছাতে পারেনি। ভাগাকে দেখতে না পেয়ে চন্দ্র অস্থির হয়ে উঠল। এদিক সেদিক ছুটোছুটি করে সর্বত্র ভাগাকে খুঁজতে লাগল। ভাগাকে খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্র কুনজুম লা’র দিকে চলে গেল। একসময় খেয়াল হল সে অনেকদূর চলে এসেছে। ভাগা হয়ত এখনও বারালাচার উপরেই তাঁর জন্য অপেক্ষা করছে। কিন্তু সে কোন পথে এসেছিল তা আর মনে করতে পারেনা। পথ হাঁরিয়ে আরও দক্ষিণে নেমে যেতে থাকে। অন্যদিকে ভাগাও তখন হন্য হয়ে চন্দ্রকে খুঁজে যাচ্ছে। হাজারো প্রশ্ন তখন তাঁর মাথায়। চন্দ্র কি তবে পালিয়ে যেতে পারেনি? খারাপ কিছু হয়নি তো?
একে অপরকে খুঁজতে খুঁজতে চন্দ্র ও ভাগা ক্লান্ত হয়ে যায়। তাঁরা স্রষ্টার কাছে প্রার্থনায় বসে, একে অপরকে মিলিয়ে দেবার আকুতি জানায়। এরপর আবার তাঁরা খুঁজতে থাকে। একসময় স্রষ্টার দয়া হয়। কেলং এর কাছে তান্ডি নামক জায়গায় এসে চন্দ্রা দেখে অন্যদিক দিয়ে ভাগাও নেমে আসছে। তাঁরা দ্রুত একে অপরের দিকে ছুটে যায় ও তাঁদের ঐশ্বরিক মিলনে জন্ম নেয় চন্দ্র-ভাগা। এই চন্দ্র-ভাগাই ‘চেনাব’ নাম নিয়ে লাহুল পেরিয়ে জম্মু-কাশ্মীর হয়ে পাঞ্জাবের সমতলে প্রবেশ করে ও অবশেষে সিন্ধুতে গিয়ে মিশে যায়।
আমাদের এই উপমহাদেশের প্রতিটি নদীর সাথেই এমন গল্প আছে। চেনাবের সাথে সম্ভবত একটু বেশীই আছে। এই নদী নিয়ে লেখা হয়েছে সব প্রেম, বিরহ ও বিচ্ছেদের উপাখ্যান। শসি-পুন্নু, মির্জা-সাহিবা, সোনি-মাহিওয়াল, হীর-রাঁঞ্ঝার মত অমর আখ্যানগুলোতে চেনাবওফয়ে গেছে জলজ্ব্যান্ত এক চরিত্র। চন্দ্র-ভাগা-চেনাব-সিন্ধু অববাহিকা জুড়ে বহু গান, কবিতা ও চিত্রকর্মে এই নদী অমর হয়ে আছে। অন্য সবগুলো চরিত্র কালের গর্ভে হারিয়ে গেলেও শতাব্দী ধরে এই তাঁদের গাঁথা এই চেনাবের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।
আমি শুধু চিন্তা করি আগেকার দিনের এক্সপ্লোরাররা কিভাবে এতটা নিঁখুতভাবে তাঁদের অনুসন্ধানগুলো করতেন। শুধু অনুসন্ধান করেই তাঁরা ক্ষান্ত থাকতেন না। কত সুন্দর করে কাব্যিকভাবে সেই তথ্যগুলো নিয়ে গল্প বানাতেন। সেই সব লোককাহিনী, পৌরাণিক গল্প পড়ে, এই আধুনিক যুগে এসে যখন দেখি আসলেই বারালাচা লা’র কাছে সুরায তাল আছে। পান্না রঙের তাঁর জল। আবার কুনজুম লা’র কাছে চাঁদের আকারেই আরেকটি হ্রদ আছে যেটার নাম চন্দ্র তাল। এই দুটি হ্রদ থেকেই নেমে এসেছে চন্দ্র আর ভাগা নদী। আবার এই দুটি হ্রদকেই ফিড করছে মুলকিলা নামের একটি পর্বত। এই পর্বতের দুই পাশের দুটি হিমবাহ থেকেই প্রাথমিকভাবে জল এই দুটি হ্রদে প্রবাহিত হয়। এই পুরো প্রবাহকে চিহ্নিত করলে আমরা একটি হার্ট শেইপ পাই। এটাকে বালখিল্য, জোর করে রোমান্টিসাইজ করার অপচেষ্টা মনে হতেই পারে। কিন্তু আর কি কারণে থাকতে পারে চেনাবকে দ্যা রিভার অফ লাভ, প্রেম-বিরহ-ভালোবাসার নদী বলার? শতাব্দী প্রাচীন সেই এক্সপ্লোরারদের মাঠ পর্যায়ের তথ্যের সাথে কল্পনার এত সুন্দর মিশেলের কথা ভাবতে নিলেই বিহ্বল হয়ে পড়ি।
2 Responses
এরকম অজস্র নদনদী আমাদের দেশে ও আছে যাদের নামের সাথে রয়েছে প্রাচীন কোনো উপাখ্যান যা আমরা জানিনা। কিন্তুু যেসব কাহিনী তুলে আনতে হবে অক্ষরে ,যাতে নতুন প্রজন্ম নতুন করে জানবে পৌরাণিক গল্পকথা যা যুগের পর যুগ ধরে চাপা পড়ে আছে।
নদীর গল্পগুলো জানতে পারলে খুব চমৎকার হবে।