সারামাতি চূড়ায়

পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ তিনপাশ দিয়ে  প্রাকৃতিকভাবে দূর্গের মত দেয়াল দিয়ে সুরক্ষিত। তিনকোনা এই উপমহাদেশ উত্তরে হিমালয়, পশ্চিমে ওয়েস্টার্ন ঘাটস আর পূর্বে আরাকান ইয়োমা’র দেয়াল দিয়ে ঘেরা। ভূ-ভাগ দিয়ে এই সুবিশাল ভূখন্ডে প্রবেশের জন্য প্রধানতম দুইটা প্রবেশদ্বার আছে। একটা পশ্চিমে আরেকটা পূর্বে। পশ্চিমের দরজার নাম খাইবার আর পূর্বের নাম পাটকাই। এই বিশাল ভূখন্ডে মানুষের মাইগ্রেশনের প্যাটার্নটা খুব মজার। পশ্চিম দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে আর্যরা, দারিয়ুসের হাত ধরে পারশিয়ানরা, আলেক্সান্ডারের হাত ধরে গ্রীকরা, তৈমুরের হাত ধরে মঙ্গোল, ভাগ্য সন্ধানে বের হওয়া একের পর এক মুসলিম যোদ্ধা- শতাব্দীর পর শতাব্দী জুড়ে এরা সবাই এই উপমহাদেশে প্রবেশ করে এর পুরো খোলনলচেই পালটে দিয়েছে।

পশ্চিমের প্রবেশদ্বার নিয়ে আমরা যতটা জানি বা আলোচনা করি ঠিক ততটাই কম জানি আমাদের পূর্বের প্রবেশদ্বার পাটকাই সম্পর্কে। এই পথ দিয়েই ব্রক্ষ্মপুত্র আর বরাক উপত্যকায় প্রবেশ করেছে অহম জাতি, বার্মিজ আর্মি আর সেই সাথে এই পূর্ব ভূখন্ডে প্রবেশ করেছে অসংখ্য তিব্বত-চায়না-মংগলয়েড ক্ল্যান। এই পাটকাই গিরিবর্ত্মটি আবার গ্রেট আরাকান ইয়োমার একটি অংশ। অনেকেই বলেন আরাকান ইয়োমা হিমালয়ের বর্ধিত অংশ। অনেকেই বলেন এই পর্বতশ্রেণী সম্পূর্ণ আলাদা। ধনুকের মত বাঁকানো এই বিশাল পর্বতশ্রেণী উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী হয়ে পূর্ব থেকে পশ্চিমে অনেকগুলো শ্রেণীতে ভাঁজ হয়ে বঙ্গোপসাগরে আন্দামান ও নিকোবার দ্বীপপুঞ্জ হয়ে জেগে উঠেছে। এই ভাঁজগুলোর মধ্যে আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম, নাগা হিলস, লুসাই হিলস, ত্রিপুরা হিলস অন্যতম।

দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর থেকে শুরু করে উত্তরে ভারতের অরুনাচল প্রদেশের ব্রক্ষ্মপূত্র উপত্যকা পর্যন্ত পুরো এলাকাকে মায়ানমারের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে প্রাকৃতিক প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে আরাকান পর্বতমালা। এই পর্বতমালা আরাকান সমুদ্র উপকূলকে মিয়ানমারের বাকি তটরেখা থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। বস্তুত আরাকান পর্বতমালাই হচ্ছে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাকৃতিক, রাজনৈতিক  ও সাংস্কৃতিক সীমান্তরেখা। 

এই সীমান্তরেখা দুই অংশের ইতিহাসকেও বিভাজিত করেছে। ব্রিটিশ দখলদারিত্বের আগ পর্যন্ত দুই অংশের রাজনৈতিক ইতিহাস দুই ধারায় প্রবাহিত হয়েছে। আরাকান পর্বতমালার কারণেই চীনা-বার্মিজ যোদ্ধা ও রাজারা কখনও আরাকানে আগ্রাসন চালাতে পারেনি এবং এখানে স্বতন্ত্র সভ্যতা গড়ে উঠতে পেরেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চীন ও মিয়ানমারসহ গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অক্ষশক্তি জাপানের জয়রথ এই আরাকান পর্বতমালায় এসেই থেমে গিয়েছিল। 

এই পুরো অঞ্চলটি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অদ্ভুত রকমের এক মুগ্ধতা জন্মেছে। বিশেষ করে বান্দরবানের আনাচে কানাচে ঘুরতে গিয়েই আমি জেনেছি পৃথিবীতে যেই অল্প কিছু অঞ্চল এখনো আদিম ও বুনো অবস্থায় রয়ে গেছে এই আরাকান পর্বতশ্রেণী সেই রহস্যময় জায়গাগুলোরই একটি। বিশাল এই পর্বতশ্রেণীর খুবই ছোট একটি অংশ বাংলাদেশে পড়েছে। বিগত একযুগ ধরে বাংলাদেশের পর্বতশ্রেণীগুলোতে একের পর এক অনুসন্ধানী অভিযান শেষে সর্বোচ্চ পর্বত চূড়াগুলোর তালিকা প্রণয়নের কাজ শেষ করার পর নতুন বছরের শুরুতেই সিদ্ধান্ত নিলাম আরাকান ইয়োমার উত্তরাংশের রহস্য এবার একে একে ভেদ করব। এই সিদ্ধান্ত থেকেই গতমাসে চলে গিয়েছিলাম নাগাল্যান্ড। 

উত্তপ্ত রাজনৈতিক ইতিহাসের কারণে নাগাল্যান্ডে প্রবেশ করা সবসময়ই কঠিন ছিল। এমনকি নাগাল্যান্ডের বাইরে থেকে কোন ভারতীয় আসতে চাইলেও তাঁকে স্পেশাল ইনার লাইন পারমিট নিতে হত। আর বিদেশীদের জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশীদের জন্য নাগাল্যান্ডে প্রবেশ কয়েকবছর আগেও নিষিদ্ধ ছিল। ১৯৪৭ সালে বৃটিশরা ভারতীয় উপমহাদেশ ছেড়ে চলে যাবার মুহুর্ত থেকেই নাগা অঞ্চলের বাসিন্দারা প্রস্তাবিত ভারত রাস্ট্র থেকে আলাদা হবার দাবিতে বিদ্রোহ ও সংগ্রাম করে আসছে। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হবার এই দাবী ভারতীয় সরকার ভালোভাবে নেয়নি, বরং কঠোর শক্তি প্রয়োগ করে নাগাদের দাবীকে দমন করে এসেছে। 

বিদ্রোহীদের সশস্ত্র সংগ্রাম ও দীর্ঘ সহিংসতার পর ভারত সরকার ১৯৬০ সালে নাগাল্যান্ডের বৃহত্তর স্বায়ত্ত্বশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়। কিন্তু বিদ্রোহী নাগাদের একাংশ স্বায়ত্ত্বশাসন মেনে না নিয়ে পূর্ণ স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের দাবিতে সংগ্রাম বজায় রাখে। সরকারী বাহিনীর সাথে তাঁদের গেরিলা যুদ্ধ চলতে থাকে। নিরাপত্তার স্বার্থে তাই ভারতীয় সরকার থেকে এই অঞ্চলে ভ্রমণের অনুমতি মিলত না। কিছুদিন আগে ভারতীয় সরকার বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সাক্ষর করতে সক্ষম হয়েছে। পরিস্থিতি তুলনামূলক শান্ত হয়ে উঠায় ও উত্তর-পূর্ব ভারতে্র অর্থনৈতিক উন্নয়নে পর্যটনকে গুরুত্ব দেয়ার ফলে বাংলাদেশীরা এখন নাগাল্যান্ডের কিছু অঞ্চলে ভ্রমণের বিশেষ অনুমতি পাচ্ছেন। কিন্তু অভিযানের জন্য আমাদের এমন এক অঞ্চলে যেতে হবে যেটা পড়েছে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে, আর তারচেয়েও বড় কথা আমরা যেদিকটায় যেতে চাচ্ছি সেখানেই বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে। তাই আমরা শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত এই অভিযানের অনুমতি পাবো কিনা তা নিশ্চিত ছিলাম না। শতশত অনিশ্চয়তা নিয়েই জানুয়ারির ২১ তারিখে আমরা পা রাখি নাগাল্যান্ডের প্রবেশপথ ডিমাপুর। স্থানীয়দের সহায়তায় সেখান থেকে আমরা একটি সুমো নিয়ে রওনা হয়ে পড়ি আমাদের পরবর্তী গন্তব্য পুঙরোর দিকে।

পাহাড়ি আঁকাবাঁকা পথে ধুলো দিয়ে গোসল সেরে প্রায় সাড়ে তিনশ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে আমরা যখন পুঙরো পৌঁছাই তখন বেশ রাত হয়ে গেছে। পাহাড়ে সেখানে সূর্য ডুবে গেলেই রাত নেমে সব স্তব্ধ হয়ে যায় সেখানে তখন রীতিমত মধ্যরাত। এখানে থাকার কোন লজ বা হোটেলের ব্যবস্থা না থাকায় গাড়ির ড্রাইভার আমাদের নিয়ে গেল সরকারী ডাকবাংলোর সামনে। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনে বাংলোর কেয়ারটেকার বললেন, এখানে থাকতে হলে এডিসির অনুমতি লাগবে। এই পুরো পথ পাড়ি দেয়ার সময় আমরা ৬টি আর্মি চেকপোস্টের মুখোমুখি হয়েছি। তাঁরা কেউ আমাদের ফিরিয়ে দেয়নি। বরং বেশ হাসিখুশিভাবেই আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু এখন যদি টিপিক্যাল সরকারী কর্তার মত এডিসি সাহেব এত রাত করে বিরক্ত করার অপরাধে আমাদের ফিরিয়ে দেন? দুরুদুরু বুকে কেয়ারটেকারের পিছন পিছন পাশের পাহাড়ে উঠতে লাগলাম। এই পাহাড়ের উপরের এডিসি সাহেবের বাংলো। কেয়ারটেকারের কাছে তিন বাংলাদেশী আসার বৃত্তান্ত শুনে এডিসি আমাকে ডেকে পাঠালেন। হাসিখুশি মুখে আমাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেন। কেন এখানে এসেছি এমন প্রশ্নের জবাবে যেই বলেছি আমরা নাগাল্যান্ডের সর্বোচ্চ চূড়া মাউন্ট সারামাতি আরোহণের উদ্দেশে এসেছি, সাথে সাথেই উনি বললেন, রিয়েলি? দ্যাটস গ্রেট। এরপর তো আমাদের সরকারী ডাকবাংলোতে থাকার অনুমতি মিললোই সেই সাথে সকল পুলিশি কার্যক্রম সকালের জন্য মুলতবিও করে দিলেন। আমাদের ধুলোমাখা ক্লান্ত চেহারা দেখে উনি বললেন, এত রাতে না দৌঁড়ে আগামীকাল সকালে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে সকল ফর্মালিটি সেরে ফেললেই হবে। 

পরের দিনটি পুঙরোতে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। এত লম্বা আর বাম্পি ড্রাইভের পর শরীর একটু বিশ্রাম চাচ্ছিলো। সেই ফাঁকে পরের গন্তব্য থানামির যাবার জন্য একটি গাড়িরও ব্যবস্থা করে ফেললাম। পরেরদিন আমাদের জন্য অনেক বড় একটি চমক অপেক্ষা করছিল। থানামির যাবার পথে অনুমতির জন্য আমরা পুলিশ স্টেশনে গেলাম। সেখানে যাবার পর যেটার ভয় করছিলাম তাই হল। মায়ানমার সীমান্তে আমরা যেতে পারব কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ দেখা দিল। সেইসাথে ঐ অঞ্চলে বিদ্রোহী নাগা আর্মিদের একটি ক্যাম্পও আছে। নাগাল্যান্ড বড়ই অদ্ভুত জায়গা, আমরা এসেছি শুনে সাথে সাথে পুলিশের বড় কর্তা চলে এলেন। নিজ উদ্যোগে আমাদের সবার পাসপোর্ট ভিসার কপি করালেন। জায়গায় জায়গায় ফোন দিয়ে আমাদের জন্য অফিশিয়াল আন-অফিশিয়াল সকল ধরণের ক্লিয়ারেন্স নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। পৃথিবীর কোথাও এমন পুলিশ কর্মকর্তা থাকতে পারেন এমনটা আমার কল্পনাতেও ছিল না। পুলিশের বড় কর্তার আশির্বাদ পাবার পর আর কোন অনিশ্চয়তাই রইল না। আমরা রাতের মধ্যে পৌঁছে গেলাম ভারতের পূর্ব সীমান্তের শেষ গ্রাম থানামির। 

থানামির নাগাল্যান্ডের আপেল গ্রাম হিসেবে বিগত বছরগুলোতে বেশ খ্যাতি লাভ করেছে। আগেই ভেবে রেখেছিলাম থানামির গিয়েও আমরা একদিন বিশ্রাম নিব। নাগামিজ রীতিনীতি ও তাঁদের ভূমি ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে জানার চেষ্টা করব। নাগাল্যান্ডের জমির মালিকানা আমাদের থেকে অন্যরকম। ইন্ডিয়ার অন্যান্য প্রদেশ থেকেও জমির মালিকানা আইন ভিন্ন। নাগাল্যান্ডের বেশীরভাগ জমির মালিকানা স্ব স্ব গ্রামগুলোর অধীনে, অল্প কিছু জায়গা সরকারি যার অধিকাংশই রিজার্ভ ফরেস্ট। নাগাল্যান্ডের গ্রামগুলোর অধীনে যেই জমিগুলো আছে সেগুলোও আবার দুইভাগে ভাগ করা যায়। একটি বড় অংশ বন ও আরেকটি অংশ চাষাবাদের জন্য বরাদ্ধ করা থাকে। নাগাল্যান্ডের বাসিন্দারাও কিন্তু জুম পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে। তাই তাদের জুম সাইকেলের জন্য বেশ বড়সড় জায়গা লাগে। একেকটি পাহাড়ের ঢালে তিন চার বছর চাষাবাদের পর পরবর্তীতে পাঁচ থেকে ছয় বছর পর আবারো একই জমি জুমের জন্য ব্যবহার করা হয়। ধান ও অন্যান্য ফসলের সাথে সাথে নাইট্রোজেন রিস্টোরিং গাছের বীজও বপন করা হয়। পাঁচ ছয় বছরের বিরতিতে সেই জমির গুনাগুন আবার রিস্টোর হয়ে যায়।

নাগামিজ ট্রাইবগুলো এখন আর মাইগ্রেটরি নেই। ভালো জুমের জমির সন্ধানে এখন আর তাঁদের নতুন বন কাটতে হয় না। সবচেয়ে ভালো যেটা লেগেছে জুমের জমির মাঝ দিয়ে যেখানেই ঝিরি নেমে গেছে, তার দুই পাড় জুড়েই রিপারিয়ান ফরেস্টকে তারা টাচ করেনি। এতে ঝিরিগুলোও শুকিয়ে যায়নি। এছাড়া প্রতিটি গ্রামেই দেখলাম রেইন ওয়াটার হারভেস্টিংয়ের উপর জোড় দেয়া হয়েছে। প্রতিটি জুমেই ছোট পুকুরের মত খনন করে কালো পলি দিয়ে মুড়িয়ে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। আর মাস দুয়েক পরেই ঝিরিগুলোর পানি কমে গেলে ধরে রাখা এই পানি দিয়ে শুকনো সময়গুলো ভালোভাবে কেটে যাবে। থানামির গ্রামে জুম চাষ এখন অনেকটাই কমে এসেছে। চাষ উপযোগী প্রায় সমস্ত জমিতেই ধীরে ধীরে আপেল বাগান করা হচ্ছে। 

মাউন্ট সারামাতি নাগাল্যান্ডের সর্বোচ্চ চূড়া। সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ৩৮৪০ মিটার। আরাকান ইয়োমা পর্বতশ্রেণীর এটি অত্যন্ত প্রমিনেন্ট একটি চূড়া। এর ভারতীয় অংশটি থানামির গ্রামের মালিকানায় পড়েছে। থানামির গ্রাম থেকে সারামাতি চূড়া পর্যন্ত ট্রেকটি সেখানকার ছাত্র সংগঠনের মাত্র তাঁরা গুছিয়ে পরিচালিত করে থাকে। এই সংগঠন থেকে ট্রেকের জন্য নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে প্রয়োজনীয় গাইড ও পোর্টারের ব্যবস্থা করে দেয়া হয়। এই ট্রেকটি করতে ইচ্ছুক সবাইকে অর্থ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। নাগাল্যান্ডের স্থানীয়দের জন্য ১০০ রুপি ও অন্যদের জন্য ২০০ রুপির বিনিময়ে বেইজক্যাম্পের ঘরটি থাকার জন্য ব্যবহার করা যায় ও রান্নাঘরের যাবতীয়প সুবিধা গ্রহণ করা যায়। সফলভাবে চূড়ায় সামিট করতে পারলে সংগঠনটি থেকে আবার একটি সার্টিফিকেটও দেয়া হয়। এই ট্রেক থেকে পাওয়া সমস্ত অর্থ ছাত্র ছাত্রীদের লেখাপড়া্র উন্নয়নে ব্যয় করা হয়। এই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ডিমাপুর ল’স্কুলে অধ্যারণরত ‘আসো’কে আমাদের পথ দেখানোর পেয়ে গেলাম। 

পরদিন সকালে থানামির থেকে আমরা বেইজক্যাম্পের উদ্দেশে রওণা হলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই গ্রাম ছেড়ে আমরা অরণ্যের মাঝে প্রবেশ করলাম। বিশালাকার সব গাছের মধ্য দিয়ে ট্রেইল চলে গেছে সারামাতির দিকে। একসময় শুরু হল চড়াই। আমাদের ধারণা ছিল এখানকার ট্রেইলগুলো আমাদের বান্দরবানের মতই হবে। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের ধারণা পালটে যায়। এত ঘনঘন চড়াই উৎড়াই বান্দরবানের কোন ট্রেইলে নেই। কয়েকশ্ত ফিট চড়াই উঠে একটি চূড়ায় আরোহণের পর আবারো কয়েকশত ফিট উৎড়াই, এরপর আবারো কয়েকশত ফিট চড়াই। এভাবে হার্টবিটের মত উঠানামা করতে হয় পুরো ট্রেইল জুড়ে। সেইসাথে পুরো ট্রেইলজুড়ে কোন পানির সোর্স না থাকা, গরম ও আর্দ্র আবহাওয়ার কাঠিন্য তো আছেই। থানামির গ্রাম থেকে বেইজক্যাম্পে পৌঁছাতে তাই  আমাদের লেগে গিয়েছিল প্রায় ৭ ঘন্টা। 

বেইজক্যাম্পে দুটি কাঠের ঘর বানানো আছে। ছোট ঘরটি রান্না ঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সেখানেই গাইড ও পোর্টাররা থাকে। আর নিচের বড় বড়টিতে টড়েকারড়া রাতে কিছুক্ষণের জন্য শুয়ে নিতে পারেন। খুব বেশীক্ষণ ঘুমিয়ে নেয়ার উপায় নেই কারণ রাত দুইটা তিনটা বাজেই সামিটে উদ্দেশে আবার বেড়িয়ে পড়তে হয়। বেইজক্যাম্প পৌঁছে আগে থেকে রান্না করে রাখা ভাত ডসাল ও ঝাল ঝাল টুনা দিয়ে আমরা রাতের খাবার সেরে নিলাম। 

সামিটপুশে বের হতে আমাদের রাত তিনটা বেজে গেল। চারদিক থেকে হুহু হিম বাতাস বইছে তখন। এমন শীতল আবহাওয়া আমাদের বান্দরবানে কখনো দেখা যায় না। আরাকান ইয়োমার এই অংশটি অনেকটাই আল্পাইন রিজিওনের মত। তিনহাজার মিটারের পর এখানে বড় কোন গাছও জন্মায় না। এই পর্বতের উপরিভাগে কিছু গুল্ম ও ঘাস জন্মায় শুধু। রাতের অন্ধকারে তারাদের নজরদারিতে আমরা আরোহণ শুরু করলাম। কিছুক্ষণ পর শুরু হল রডোডেনড্রণ বন। পুরো বনজুড়ে ছোপ ছোপ তুষার জমে আছে। একসময় আমরা রিজলাইনের উপরে চলে এলাম। এরপর শুরু হল বাতাসের তান্ডব। বাতাসের এতই জোর ছিল যে মনে হচ্ছিল আমাদের উড়িয়ে মায়ানমারে নিয়ে ফেলবে। ঝড়ো বাতাসের কারণে রিজলাইনের কিছু কিছু জায়গা বেশ বিপদজনক ছিল। অতি সাবধানে সেই জায়গাগুলো অতিক্রম করে ২৭ জানুয়ারী স্থানীয় বসময় সকাল সাতটায় প্রথম বাংলাদেশী দল হিসেবে আমি সালেহীন আরশাদী ও আমার দুই সঙ্গী আব্দুল্লাহ আলামিন ও আশরাফুল হক নাগাল্যান্ডের সর্বোচ্চ চূড়া আরোহণ করতে সক্ষম হই। 

স্থানীয় নাগা ভাষায় চূড়াটির নাম সা’মাটি। মাটি অর্থ আসলে মাটিই, অর্থাৎ স্থান। আর সা অর্থ, সব দেখা, সামাতি অর্থ তাই যেই স্থান থেকে সব দেখা যায়। সামাতিই পরবর্তীতে বিকৃত হয়ে হয়ে গেছে সারামাতি। নাগা হিলস ও পাটকাই এখানেই মিলিত হয়েছে। এই রেঞ্জটাই মায়ানমারের সাথে সীমানা প্রাচীর হয়ে দক্ষিণে চলে গেছে। এই চূড়াতে দাঁড়িয়ে দেখা সারিবদ্ধ পাহাড় দেখে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই বছর এই পর্বতশ্রেণীর আরও কয়েকটি চূড়ায় আমরা অভিযানে যাব। এটি হবে আমাদের জন্য দ্যা গ্রেট আরাকান চ্যালেঞ্জ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!