অনেক

সেভেন সিস্টার্স, উত্তর-পূর্ব ভারতের অরুণাচল প্রদেশ, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড এবং ত্রিপুরা। আলাদা আলাদা জাতি, আলাদা ভাষা, আলাদা ধর্ম, আলাদা খাবার, আলাদা সংস্কৃতি। ব্রিটিশরা লেজ গুটিয়ে পালানোর সময় এই বিশাল অঞ্চলের লোকেদের ইচ্ছা অনিচ্ছাকে তুচ্ছ জ্ঞান করে ভারতের কাছে সোপর্দ করে চলে যায়। তখন থেকেই এই সাত রাজ্যজুড়ে চলছে আন্দোলন। কেউ চায় নিজেদের অধিকার, কেউ ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন থেকে নিজেদের আলাদা করতে, কেউ চায় স্বায়ত্বশাসন, কেউ চায় আলাদা রাজ্য। এইসব আন্দোলন আবার সবসময় শান্তিপূর্ণও ছিল না। অধিকার আদায়ের জন্য বেশীরভাগ দলই অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হয়। আর ইন্ডিয়াও নিজের অস্তিত্বকে অখন্ড রাখতে বিশেষ ক্ষমতা আইন দিয়ে নামিয়ে দেয় সেনাবাহিনী।

এরপরের গল্পটা রক্তাক্ত, জোর, জুলুম, অন্যায়, অত্যাচার আর বঞ্চনার। এত বছরের মধ্যে কেউ মূল সমস্যাটি কোনদিন বুঝতে চেষ্টা করেনি। কেন্দ্রীয় সরকারে যেই আসুক স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাতে অবস্থার কোনরকম পরিবর্তন হয়নি। এই অঞ্চলের বয়ষ্ক বাসিন্দারা এখনো নিজেদের ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দিতে কুন্ঠাবোধ করেন। যদিও বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম বুঝতে পারছে নিজেদের ভারতীয় হিসেবে পরিচয় দেয়াটাই রিয়েলিটি। কিন্তু এতেও আছে অনেক সমস্যা, মন থেকে চাইলেও ভারতের মেইনস্ট্রিমে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের মিশে যাওয়া মোটেও সহজ নয়। এই বিষয়টি বুঝানোর জন্য ছোট একটা গল্প বলি,

দিল্লিতে অবস্থিত ভারতের সেন্ট্রাল বক্সিং ট্রেনিং ফেসিলিটিতে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে অনেক তরুণী বক্সার এসেছে। আন্তর্জাতিক কোন টুর্নামেন্টের জন্য ন্যাশনাল টিম গঠন করা হবে। নর্থ-ইস্ট থেকে খুবই কম বয়ষ্ক এক তরুণীকে একবার সুযোগ দিয়ে দেখার জন্য জাতীয় কোচের কাছে তদবির করছেন একজন। সেই সময় জাতীয় দলে নর্থ ইস্ট থেকে আরেকজন নারী বক্সার ভারতের জাতীয় দলে ছিলেন, তাঁর নাম ম্যারি কম। বারবার অনুরোধ করার এক পর্যায়ে কোচ বলে বসেন, নর্থ ইস্ট থেকে আর কাউকে নেয়া সম্ভব না, দলের সবাই নর্থ ইস্ট থেকে আসলে বাইরের মানুষ তো বুঝতেই পারবে না, এটা ইন্ডিয়ান টিম নাকি চাইনিজ?

জাতীয় একজন কোচ শুধুমাত্র চেহারা, গায়ের রঙ দেখে নিজ দেশের একজন নাগরিককে চাইনিজ বানিয়ে দিতে পারলে, ভারতের মূল ভূখন্ডের মানুষজনের মনে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষদের সম্পর্কে কি ধারণা পোষণ করেন তা হয়ত ধারণাই করা যাবে না। বেশীরভাগই মনে করেন, এঁরা চিংকু চাংকু- চায়না থেকে পালিয়ে এসে ইন্ডিয়ায় শরনার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছে আর তাঁদের অন্ন ধ্বংস করছে। ভিন্ন ভাষার, ভিন্ন রকম দেখতে হলেও তাঁদের সাথে সবাই সেকেন্ড ক্লাস সিটিজেন হিসেবেই ট্রিট করে।

এবার ভারতের একজন দুর্ধর্ষ সিক্রেট সার্ভিস এজেন্টের গল্প বলি। ক্যারিয়ারের একদম প্রাইম পর্যায়ে তরুণ এই অফিসারকে আন্ডার কভার এজেন্ট হিসেবে নর্থ ইস্টে পাঠানো হয়। তাঁর মূল কাজ হল, অঞ্চলে চলমান বিদ্রোহীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করা ও বাই হুক ও বাই ক্রুক এই বিদ্রোহগুলোকে নিউট্রালাইজ করা। এই এজেন্ট এই অঞ্চলে এসে ছোট্ট একটি ক্যাফে শুরু করে। যেখানে স্থানীয় তরুণ তরুণীরা আড্ডা জমায়। ক্যাফে শপের আড়ালে সে টুকটাক করে আর্মস বেচতে থাকে, সশস্ত্র বিদ্রোহীদের কাছে যা আরাধ্য। এভাবে বিদ্রোহী দলগুলোর সাথে তাঁর যোগাযোগ হয়। এক পর্যায়ে এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় বিদ্রোহী গ্রুপকে শায়েস্তা করতে কেন্দ্রীয় সরকার ও সিক্রেট সার্ভিসের অর্থায়ণে নিজেরাই পালটা আরেকটি বিদ্রোহীগোষ্ঠী তৈরী করে। এই গোষ্ঠীর সাথে নিজেরাই আবার বিপুল অস্ত্র তুলে দেয়। সরকারের লক্ষ্য কাটা দিয়ে কাটা তোলা- ভাবখান এমন, ওরা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরুক।
কিন্তু সরকারের এই আইডিয়াটি ব্যাক ফায়ার করে। সরকারের বানানো প্রতি বিপ্লবী দলটির মধ্যে একজন প্রকৃত নেতা দাঁড়িয়ে যায়। সরকারী ব্যাকআপের সুযোগে এদের মধ্যে থেকে একজন সাধারণ ব্যক্তি দুর্গম স্থানে স্কুল ও রিহাব সেন্টার খুলে বসেন। স্কুলের মাধ্যমে তিনি স্থানীয়দের বোঝান কিভাবে ভারত দ্বারা তারা বঞ্চনা ও অত্যাচারিত হচ্ছেন আর এর থেকে প্রতিকারের জন্য কিভাবে নিজেদের রুখে দাঁড়াতে হবে। ধীরে ধীরে সরকারের বানানো এক প্রতি বিপ্লবী দল তাদেরই গলার কাঁটা হয়ে যায়।

এই প্রতি বিপ্লবী দলের নেতাকে ধরতে গিয়ে সেই তরুণ অফিসার আসল নর্থ ইস্টের মানুষদের সংস্পর্শে আসতে পারে। কিভাবে তাঁরা অত্যাচারিত হচ্ছে, কি কারণে তাঁরা অস্ত্র তুলে নিতে বাধ্য হচ্ছে, কি কারণে বারবার শান্তি আলোচনা বানচাল হয়ে যায় এই সবকিছু তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে যায়। স্থানীয় সাধারণ মানুষদের মুখের ভাষার সে প্রথমবারের মত শুনতে পেয়ে হতচকিত হয়ে যায়।

এরপর গল্পে আসে আরেক চরিত্র। এই চরিত্রের নাম টাইগার সাংগা। ব্রিটিশরা চলে যাবার পরমুহুর্ত থেকে যে ভারতের অংশ হয়ে থাকতে অস্বীকৃতি জানায়। ভারতের পাঠানোর দুই লাখ সৈন্যকে মোকাবেলা করার জন্য নিজেরা অস্ত্র হাতে তুলে নিয়ে পাহাড়ের গেরিলা হয়ে যায়। একপর্যায়ে এই অঞ্চলের সাধারণ মানুষ টাইগার সাঙ্গাকে অবিসাংবাদিত নেতা হিসেবে মেনে নিলেও ধিরে ধিরে তাঁর তাঁর আসল চেহারা সাধারণ মানুষ বুঝতে পারে। নিজের প্রভাব ও প্রতিপত্তি বজায় রাখার জন্য টাইগার সাঙ্গা নিজেদের মানুষের উপরই ত্রাসের রাজ্য কায়েম করেন। স্থাণীয়দের কাছ থেকে চাঁদা আদায় করা, সকল প্রকার যানবাহনের কাছ থেকে চাদা আদায় করা, পুরো এলাকার সকল ব্যবসা বানিজ্য বাজারের কেনা বেচা নিয়ন্ত্রন করা।

কেউ চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালে সকলের সামনে তাঁকে জন্মের মত শিক্ষা দেয়া, যেন ভয়ে আর কেউ কখনও টাইগার সাঙার বিরুদ্ধে যাবার সাহস না পায়। সারা জীবন ধরে যুদ্ধ করতে করতে এক পর্যায়ে টাইগার সাঙ্গা বুড়ো হয়ে যায়। সরকারের সাথে আলোচনায় বসে। সরকার তাঁকে প্রস্তাব দেয় আর কত? এবার এই খেলা রাখেন। গণতান্ত্রিকভাবে এই অঞ্চলের ক্ষমতায় আসেন। আল্টিমেটলি তো এটাই চাওয়া আপনার তাইনা? এদিক দিয়ে সরকার নিশ্চিত করবে আপনার বিপক্ষে যেন আর কেউ না দাঁড়ায়। আপনার এই রাজ্যের বাজেট কি হবে, টাকা কই কই খরচ হবে না হবে এইসব ব্যাপারে সরকার কখনোই আপনাকে হস্তক্ষেপ করবে না। সরকারের এই কথা টাইগার সাঙ্গার পছন্দ হয়। আসলেই তো তাই- তাঁর তো শুধু ক্ষমতাই দরকার। এই বনে জঙলে লুকিয়ে থেকে কি পেল সে এত বছর? তাঁর হাতে যদি অঞ্চলের পুরো ক্ষমতা চলে আসে, সে যদি ইচ্ছামত তহবিল খরচ করতে পারে তাহলেই তো শান্তিচুক্তিতে সাইন করা যেতে পারে।

কেন্দ্রীয় সরকার ও টাইগার সাঙ্গার দল লোক দেখানো শান্তিচুক্তির প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু এতে বাধ সাধে স্থানীয় জনগনের মাঝে বর্তমানের জনপ্রিয় বিদ্রোহী দল- যেই বিদ্রোহী দলটিকে সরকারই ফান্ডিং ও অস্ত্র দিয়ে তৈরী করেছিল। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের দিন সার্কিট হাউজ মাঠে দুইপক্ষের মধ্যে শান্তিচুক্তি অনুষ্ঠিত হবে। আগেরদিন এই মাঠে বিদ্রোহীপক্ষ বোমা বিস্ফোরন করে শান্তিচুক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের অবস্থান জানায়। সরকার ও টাইগার সাঙ্গা বুঝতে পারে এদের দমন না করলে পরিকল্পনা অনুযায়ী শান্তিচুক্তি করা সম্ভব না। তাই দুইপক্ষ মিলে নিজেদের মত করে এদের নিঃশেষ করতে ঝাপিয়ে পড়ে।

এরপরের গল্প অত্যাচারের। একদিকে পুলিশ, আর্মি, প্যারা মিলিটারি বাহিনী স্থানীয় গত্রাম গুলোতে হামলা চালায়। যেখানেই তরুণদের পায় তাদের মেরে বাঁশের তৈরী খাঁচায় বন্দি করে রাখে। থার্ড ডিগ্রি টর্চার করে বিদ্রোহী বাহিনীর অবস্থান জানতে চায়। আরেকদিকে টাইগার সাঙার বাহিনীও গ্রামে গ্রামে হামলা চালায়। ফসলের ক্ষেত, বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়, ত্রাস তৈরী করতে ইচ্ছে মত মানুষকে গুলি করে মারে। একটা দৃশ্যে দেখা যাবে বাবার সাথে ছোট এক মেয়েও তারা ধরে নিয়ে যায়। থানায় অত্যাচার করার পর বাবাকে বন্দী রেখে ছোট মেয়েকে ছেড়ে দেয়। ছোট মেয়েটি এত আতঙ্কিত থাকে যে তাঁর সাথে কি করেছে এই কথাটি মুখ ফুঁটে বলতে পারে না।

শান্তির অর্থ একেকজনের কাছে একেকরকম। একজনের জন্য যেটা শান্তি সেটাই অন্যের জন্য অশান্তির হতে পারে। তাই বলা হয় ‘পিস ইজ অ্যা সাবজেক্টিভ হাইপোথেসিস’। এতক্ষণ যেই টুকরো টুকরো গল্পগুলো পড়লেন সেগুলো আসলে নেটফ্লিক্সের নতুন সিনেমা ‘অনেক’ এর প্লট। সিনেমাটি বানিয়েছেন আনুভাব সিনহা। অভিনয়ে আছে আয়ুষ্মান খুরানা। আমি ইচ্ছে করেই সিনেমার প্লটটি কোন ধরণের স্পয়লার ছাড়া বিস্তারিত লিখেছি। কারণ আমি চাই যেভাবেই হোক এই ঘটনাগুলো, এই গল্পগুলো, সংঘাতের কারণগুলো মানুষ জানুক, বোঝার চেষ্টা করুক। সিনেমাটা অনেক এভারেজ হলেও আমার আর্জি থাকবে সকলেই সিনেমাটি দেখুন। এই সিনেমাটি সবার দেখা উচিত। সিনেমাটি দেখলেই বুঝতে পারবেন কিছু নাম, কিছু জায়গা এদিক সেদিক করে দিলে এটি আসলে আমাদেরও গল্প, আমাদের পাহাড়ের গল্প।

আমি সকাল থেকে শুধু ভারতের শিল্প সংস্কৃতির উদারতার ব্যাপারটি ভাবছি। ভারতে বসে ভারতের সরকারের নেয়া নাগরিক বিরোধী অবস্থান সিনেমায় তুলে ধরতে পারাও বোধ হয় স্বাধীনতা হিসেবে কাউন্ট করা যায়। আমি স্বাধীন না, তাইতো আমাদের পাহাড়ের কথা সরাসরি লিখতে পারলাম না। এই সিনেমার আড়াল নিয়ে লিখতে হল। এদিক দিয়ে আনুভাব সিনহার প্রতি শ্রদ্ধাও হল। তিনি আসলেই সমাজের একটি প্রতিচ্ছবিকে সিনেমায় তুলে আনতে পেরেছেন।

আজ তো আমাদের বিজয় দিবস। এই ছুটির দিনে কেউ চাইলে নেটফ্লিক্সে ‘ANEK’ সিনেমাটি দেখে ফেলতে পারেন। হয়ত আমাদের পাহাড়ের বঞ্চনার গল্পগুলোও কিছুটা উপলব্ধি করতে পারবেন।

ছবি: উইকিমিডিয়া কমন্স

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!