ট্রেকিং পোলের উপযোগিতা

ট্রেকিং শুরু করার প্রথম দিনগুলোতে মুরুব্বিদের বলতে শুনতাম, হাতে একটি লাঠি থাকলে পাহাড় চড়তে আরাম হয়। আমি ট্রেকিং শুরু করেছি আমাদের সবুজ পাহাড়ে। সে সময় আমাদের এখানে ট্রেকিং পোলের তেমন চল ছিল না, বাজারে খুব একটা পাওয়াও যেত না। এখানে বেসীরভাগ ক্ষেত্রেই ঝাড় থেকে কেটে নেয়া লম্বা চিকন বাঁশই বেশী ব্যবহৃত হত। কিন্তু কোন এক কারণে হাতে লাঠি নিয়ে হাঁটতে আমি একদমই স্বাচ্ছন্দবোধ করতাম না। উলটো আমাদের পাহাড়ের টেরেইন, ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গলের মধ্য দিয়ে ট্রেক করার সময় ঝাঁড় থেকে কেটে নেয়া চিকন বাঁশটিকেও বাড়তি বোঝা বলেই মনে হত। সেই সাথে বোকার মত একটি মনস্তাত্বিক ব্যাপারও কাজ করত- মনে হত বুড়োদের মত লাঠিতে ভর দিয়ে পাহাড়ে চড়া এক ধরনের দুর্বলতা।

আমার কয়েক বছর লেগে গেছে ট্রেকিং পোলের উপযোগীতা উপলব্ধি করতে। সেই সময়ে ভাবিনি এই জিনিসের আমি কখনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করব। কিন্তু আজ আমার প্রতিটি অভিযানে এই ট্রেকিং পোল গুরুত্বের সাথে প্যাকিং লিস্টে চলে আসে।

আমি হিমালয়ের অন্নপূর্ণা ট্রেইলে দুই হাতে দুটি ট্রেক্লিং পোল নিয়ে প্রথমবারের মত আমি ট্রেক করেছিলাম। সেই ট্রেকের আমার পারফর্মেন্স দেখে আমি নিজেই হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। প্রথম যেই সুবিধাটি আমি টের পেয়েছি সেটা হল আমার হাঁটার রিদম। দুটি ট্রেকিং পোল নিয়ে হাঁটার মানে হচ্ছিল আমি তখন চারপায়ের জন্তুদের মত পাহাড়ে উঠছিলাম। ইয়াক, খচ্চর, গাধা, ঘোড়া বা পাহাড়ি ছাগল যেভাবে স্বচ্ছন্দে পাহাড়ের চড়াই ভেঙে অনায়াসে উঠে যায়, আমারও তখন নিজেকে তাদের মতই মনে হচ্ছিল।

ডান হাতের পোল সামনে এগিয়ে বাম পা, এর পরের স্টেপে বাম পায়ের পোলের সাথে ডান পা এভাবে প্রতিটি নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সিংক্রোনাইজেশন করে একটা ছন্দময় গতিতে হাঁটতে পারছিলাম। সামনের দিকে ঝুঁকে শরীরের ভর ট্রেকিং পোল দুটির উপর দিতে আরেকটু আরাম পেলাম। দুটি পোলে ভর দিয়ে হাতের মাসল ব্যবহার করে শরীরকে একটু লিফট করলে পায়ের উপর পুরো প্রেশার পড়ে না। এতে লাভ হল আমি হাফাচ্ছিলাম কম, ক্লান্ত হচ্ছিলাম কম আর বিশ্রামের জন্য না থেমে একটানা অনেকদূর পর্যন্ত ট্রেক করতে পারছিলাম। দুই পেয়ে জীব থেকে আমাদের চার পেয়ে বানিয়ে দেয়া- আমার মতে এটাই ট্রেকিং পোলের সবচেয়ে বড় সুবিধা।      

এর পর থেকেই মূলত আমি ট্রেকিং পোলের গুরুত্বটা অনুধাবন করতে শুরু করি। বিশেষ করে পিঠে ভারী ব্যাকপ্যাক থাকলে ডাউনহিলে নামার সময় হাতে থাকা ট্রেকিং পোল দুটি শরীরের ব্যালেন্স রাখতে অনেক সাহায্য করে। সেই সাথে নামার সময় শরীরের পুরো ভর তখন আর দুই হাটুর উপর পড়ে না। শরীরের উপরভাগের ভর ট্রেকিং পোলে চলে যায়। এতে হাটুর উপর চাপ অনেক কম পড়ে।

হিমালয়ের নদীগুলো ক্রস করা আমার মতে কোন অভিযানের সবচেয়ে কষ্টকর একটা কাজ। একে তো হিমশীতল পানি আর উপর খড়স্রোতা- পানিতে কিছুক্ষণ থাকলেই পা জমে আর চলতে চায় না। নেপালের ধাউলাগিরির চরচরবান হিমবাহ গলা নদী ক্রস করতে গিয়ে এমন সমস্যায় পড়েছিলাম। নদীটা অনেক প্রশস্ত ছিল। কিছুদূর যাওয়ার পরই পায়ের নিচে বড় বড় বোল্ডার চলে আসল। এর মধ্য দিয়ে চলতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল। তখন হাতে থাকা পোল দিয়েই শরীরের ব্যালেন্স রাখছিলাম। এগিয়ে যাওয়ার জন্য এক পা উপরে তুলতেই অন্য পায়ের উপর অনেক বেশী পানির চাপ পড়ছিল। এমন ক্রিটিকাল পরিস্থিতিতে আরও দুটি এংকর পয়েন্ট থাকা খুবই জরুরী।   

এগুলো হচ্ছে আমার জন্য ট্রেকিংপোলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ। এছাড়াও বড় বড় বোল্ডার পার হওয়ার সময় ব্যালেন্স রাখতে, গ্লেসিয়ারে লুকিয়ে থাকা ফাটল বুঝতে, বরফ ঠুকে তার ঘনত্ব বুঝতে, আপদকালীন শেল্টার বানাতে, পিচ্ছিল জায়গা অতিক্রম করতে ট্রেকিং পোলের কোন বিকল্প আমার জানা নেই। তাই আমার সব অভিযানের জন্য ব্যাকপ্যাকে এখন দুটি ট্রেকিং পোল মাস্ট থাকবেই।    

আমার অভিজ্ঞতা থেকে এখন ট্রেকিং পোলের কিছু সুবিধা অসুবিধা্র কথা বলছি। অন্যান্য মাউন্টেনিয়ারিং গিয়ারের মত ট্রেকিং পোলও নানা রকমের হয়। একেক কোম্পানী একেক রকম ফিচার দিয়ে ট্রেকিং পোল তৈরী করে। কোন টেরেইনে একটি ফিচার ভাল কাজ করে, কোন ফিচার অন্য রকম টেরেইনে। ফিচার ও ম্যাটেরিয়ালের উপর আবার দাম ও পুরোপুরি নির্ভর করে।   

ট্রেকিং পোল কেনার সময় তাই কয়েকটি বিষয়ের দিকে নজর দেয়া উচিৎ, যেমন-

[১] উচ্চতা- ট্রেকিং পোলের উচ্চতা এমন হওয়া উচিৎ যেন গ্রিপ ভালভাবে ধরে পায়ের কাছাকাছি রাখলে হাতের ভাজ পুরোপুরি ৯০ ডিগ্রি কোনে থাকে। এমন না হলে ট্রেকিং পোলের সুবিধা ঠিকঠাকভাবে পাওয়া যাবে না। উলটো সোল্ডার ব্যাথা করবে। বেশীরভাগ ট্রেকিং পোলের উচ্চতাই নিজের মত করে এডজাস্ট করে নেয়া যায়। যেই ট্রেকিং পোলের উচ্চতা ফিক্সড থাকে সেগুলো কেনা উচিৎ নয়। কারন চড়াইয়ের পথে থ্রাস্ট পাওয়ার জন্য ট্রেকিং পোলের উচ্চতা কয়েক ইঞ্চি কমিয়ে নিতে হয়। আবার ডাউন হিলে নামার সময় ব্যালেন্স ঠিক রাখার জন্য ট্রেকিং পোলের উচ্চতা কিছুটা বাড়িয়ে নিতে হয়।

[২] ম্যাটেরিয়াল- বাজারে সাধারণত অ্যালুমিনাম ও কার্বন ফাইবার এই দুই ম্যাটেরিয়ালের ট্রেকিং পোল পাওয়া যায়। অ্যা লুমিনামের পোলগুলো বেশী মজবুত ও দামে সস্তা হয়। এক্সট্রিম পরিস্থিতিতে এই পোলগুলো বেকে যেতে পারে কিন্তু সহজে ভাঙ্গে না। এদের ওজন সাধারণত ৫০০ থেকে ৬০০ গ্রাম হয়। অন্যদিকে কার্বন ফাইবারের তৈরী পোলগুলো ওজনে খুব হালকা হলেও এক্সট্রিম পরিস্থিতিতে পট করেই ভেঙে যেতে পারে। এগুলোর দাম ও আবার তুলনামূলক অনেক বেশী হয়। যারা নিয়মিত রাফ টেরেইনে ট্রেক করেন তাদের কয়েক গ্রাম ওজন কমানোর জন্য কার্বন ফাইবারের পোল নেয়া উচিৎ না।  

[৩] গ্রিপের ম্যাটেরিয়াল- ট্রেকিং পোলের হাত দিয়ে ধরার গ্রিপ যে এত গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে সেটা কখনোই বুঝতে পারতাম না যদি না এর জন্য বাজে একটা অভিজ্ঞতা হত। প্রথম দিককার একটি শীতকালীন অভিযানে সামিট পুশের জন্য রাতের বেলা তাবু থেকে বেড়িয়েছিলাম। প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল সেরাতে। আধা ঘন্টা এক ঘন্টা ট্রেক করার পরই খেয়াল করলাম আমার হাত রিতিমত জমে যাচ্ছে। আমি কিছুতেই ট্রেকিং পোল গ্রিপ করতে পারছি না। গ্রিপ বরফের মত ঠান্ডা হয়ে গেছে। হাতে ভালোমানের একটা গ্লাভস থাকা স্বত্তেও এমন হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত না সহ্য করতে না পেরে পোল দুটি গুটিয়ে ব্যাকপ্যাকে নিয়ে নেই আর হাত দুটো পকেটে ভর উষ্ণ করার চেষ্টা করি।

পরে বাসায় এসে কারণ ঘাটাঘাটি করে বের করলাম এমনটা হয়েছে ট্রেকিং পোলের গ্রিপের ম্যাটেরিয়ালের জন্য। দুর্ভাগ্যজনকভাগে সেই পোল দুটির গ্রিপ ছিল কর্কের। যেটা ঠান্ডার জন্য মোটেও উপযোগী নয়। কর্কের গ্রিপ সাধারণত তাদের ব্যবহার করা উচিৎ যাদের হাত প্রচন্ড ঘামে। এতে হাতের গ্রিপ খুব ভালো পাওয়া যায় আর ঘাম ড্রেইন করে দেয়। গরমকালে কর্কের গ্রিপ ব্যবহার করা ঠিক আছে।

কিছু ট্রেকিংপোলের গ্রিপে আবার পাতলা ফোম লাগানো থাকে। এদের ওকাজ হচ্ছে ঘেমে যাওয়া হাত শুষ্ক রাখা। এই ফোমের গ্রিপগুলোও ঠান্ডায় খুব সমস্যা করে।

ঠান্ডার উপযোগী ট্রেকিং পোলগুলোতে ক্রিকেট ব্যাটের হ্যান্ডেলের মত রবারের গ্রিপ লাগানো থাকে। এই ম্যাটেরিয়াল ঠান্ডা হয় না। তাই অ্যা ল্পাইন ক্লাইমেটে এই ট্রেকিংপোলই ব্যবহার করা উচিৎ। অন্যদিকে গরমের মধ্যে এই পোল থেকে হাতে ফোস্কা পড়ে যেতে পারে।

[৪] লকিং পদ্ধতি- আগেই বলেছি হাইট এডজাস্ট করা যায় এমন ট্রেকিং পোলই ব্যবহার করা উচিৎ। এই ধরনের পোল গুলো সাধারনত ৩টি অংশে ভাগ করা থাকে। প্রতিটি অংশ একতি লকিং ম্যাকানিজম দিয়ে এডজাস্ট করা যায়। সবচেয়ে সস্তা ধরনের ট্রেকিং পোল গুলোতে এই অংশ গুলো এক্টির মধ্যে আরেকটি স্ক্রুর মত পেঁচিয়ে লক করতে হয়। এই ম্যাকানিজমের পোলগুলো এডজাস্ট করা আমার কাছে একটু বিরক্তিকর মনে হয়। মাঝে মাঝে কম বেসী করতে গিয়ে কোন অংশ ভিতর থেকে খুলে চলে আসে। বেশীদিন হয়ে গেলে প্যাচ কেটে যায়, স্প্রিং ঢিলে হয়ে যায়।

আরেক ধরনের লকিং ম্যাকানিজম হল পুশ বাটন লক। পোলের অংশ গুলো কয়েকটি ক্ল্যাম্প দিয়ে লক করা থাকে। ক্লাম্প বা বাটনটি উপরে তুললে লক খুলে যায়, সুবিধামত হাইট এডজাস্ট করে ক্লাম্পটি লাগিয়ে দিলে আবার লক হয়ে যায়। আমার কাছে এই পোলগুলো বেশী সুবিধাজনক মনে হয়। স্বাভাবিকভাবেই এই পোলগুলোর দাম একটু বেশী হয়।

ট্রিক্স: চলতি পথে ট্রেকিং পোলের হাইট এডজাস্ট করতে হলে হাতের গ্রিপের ঠিক নিচের অংশটি-ই কম বেশী করে এডজাস্ট করা উচিৎ। এতে হাতে বা গ্লাভসে কাদা, মাটি, ময়লা লাগার সম্ভাবনা থাকে না। অনেকেই একেবারে নিচের অংশ এডজাস্ট করতে গিয়ে মাটিতে লেগে থাকা অংশ হাত দিয়ে ধরতে গিয়ে গ্লাভসে কাদা ভরিয়ে ফেলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!