অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয় না মনে হতেই পিঠে ব্যাকপ্যাক নিয়ে চলে গেলাম কমলাপুর। আমাদের গন্তব্যের চেয়ে যাত্রাটাই যেহেতু মুখ্য তাই স্টেশনে গিয়ে অবু দশ বিশ বলে সামনে যেটা পেয়েছি তাতেই উঠে বসে গেছি। ভাগ্যে জুটল চাপাইগামী এক সুপার লোকাল। ট্রেনের হৈ চৈ, চেঁচামেচি, মারামারি, সিট দখলের প্রতিযোগীতা, সিদ্ধ ডিম, চানাচুর, নেতিয়ে যাওয়া ফুলুরি, তিলের খাজা, ঝাল মুড়ি, চালের বস্তা, মাছের হাড়ি, শাড়ির গাট্টি, একেকজনের সাথে দশ বিশটা করে বোজকা, ক্ষণে ক্ষণে পা মাড়িয়ে দেয়া, প্রতিটা স্টেশনে নির্লিপ্ত স্থবিরতা, দ্রুতগতির সহ লোকোমোটিভ গুলোর প্রতি অপরিসীম উদারতা কয়েক ঘন্টা হজম করে এক সময় বাধ্য হয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম।
একবার ভাবলাম এখানেই নেমে যাই। মহেরা জায়গাটাই একটু ঘুরে দেখি। পরে আবার ভাবলাম ধুর কি আর হবে, না হয় কালকে ভোরেই পৌঁছাব। আরেকবার ভাবলাম ছাদে উঠে যাই, একটু আরামে যাওয়া যাবে। আমাদের হাবভাব টের পেয়েই বুঝি আশপাশের ঝানু যাত্রী ও স্থানীয় বিজ্ঞজনেরা মুখ খুলল, ”এই লাইনের ট্রেন খুব খারাপ। প্রতিদিনই ছাদে প্রচুর ছিনতাই হয়। টাকাকড়ি মোবাইল শুধু নিয়ে যায় না সেই সাথে চ্যাংদোলা করে ট্রেন থেকে নিচে ফেলেও দেয়।”
পকেটে টাকা পয়সা আর একটা জিপিআরএস মোবাইল মিলিয়ে সর্বসাকূল্যে হাজার খানেক টাকা আছে বলেই ভিতরের উত্তপ্ত পরিবেশ থেকে উপরের শীতল পরিবেশে চলে যেতে দুবারের বেশী ভাবতে হয়নি।
ট্রেনের ছাদে পরিচয় হল পিচ্চি একটা ছেলের সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের মধ্যে আলাপ জমে উঠল। ঢাকায় থেকে বেশ চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলা শিখে গেছে। ছেলেটার আগাগোড়া শহুরে মাঞ্জা মারা- বহুমাত্রায় তালি মারা জিন্সের প্যান্ট, ফুলহাতা টিশার্ট, পায়ে বার হাত কাকরের তের হাত বিচির মত বিশাল সাইজের কনভার্স পড়া ছেলেটার নাম শেখ আব্দুর রহিম, বাড়ি নওগাঁ। কতই বা বয়স, খুব বেশী হলে দশ কি বার হবে। ঢাকায় তাঁর চাচার সাথে কেরানীগঞ্জের একটা চামড়ার কারখানায় কাজ করে।
ইতোমধ্যে আমাদের ট্রেন যমুনা নদীর পূর্ব পাড়ে এসে থেমে গেছে। এই ফাঁকে আব্দুর রহিমকে দেখলাম বেশ ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাঁর সাইজেরই আরেকটি পিচ্চিকে বেশ কর্তৃত্বের সাথে তাড়া দিয়ে ট্রেনের নিচে নামিয়ে দিল। সেই পিচ্চিটা নিচ থেকে তাঁকে ঢিল দিয়ে পাঠালো বড় এক টুকরো পাথর।
ভেবেছিলাম খাবার-দাবার কিছু আনতে পাঠিয়েছে বোধ হয়। পাথর দেখে স্বভাবতই অবাক হয়ে জিজ্ঞাস করলাম এই পাথর দিয়ে কি হবে। প্রথমে সে কিছু বলতে চায় না। এত সপ্রতিভ ছেলেটি দেখলাম চুপ মেরে গেছে। পরে জানলাম যমুনার জলে পাথর নিক্ষেপ করলে প্রেমকামনা নাকি পূর্ণ হয়। তাই তো বলি ‘প্রেম যমুনা’ শব্দটা আসলো কই থেকে।
এই পিচ্চি ছেলে প্রেম করে শুনে আমরা দুজন থতমত খেয়ে গেলাম। প্রথমে এই নিয়ে একটু ফাজলামো করলেও কিছুক্ষণ পর লামাজীও পাথর নিক্ষেপের জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল। এদিকে আবার ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। নিচ থেকে পাথর আনা গেল না বলে লামাজী এইবার রহিমকে পটানো শুরু করল। এই বয়সকালে পাথরখানি যে তাঁরই বেশী দরকার সে কথাই হাজারখানেক যুক্তি দিয়ে রহিমকে বুঝানো শুরু করল।
হুপিং কাঁশির রোগীর মত ধুঁকতে ধুঁকতে ট্রেন একসময় মাঝ নদীতে চলে এল। মনে মনে বিড়বিড় করে রহিম পাথরটা তার কচি হাতের সর্বশক্তি দিয়ে দূরে ছূড়ে দিল। তার প্রেমের ভাগ্য বোধ হয় ভাল ছিল না তাই পাথর পড়ল গিয়ে বালু চরের মধ্যে। ব্রিজের নীচে পুরো নদী জুড়েই বিশাল বালু চর। তাই ভাগ্য ভাল হলেও আসলে কোন লাভ হত না। রহিমের বিব্রত ভাব দেখে লামাজী আবার তাকে উপুর্যপুরি খোঁটা দেয়া শুরু করল। চুপচাপ খোঁটা শুনতে শুনতে নওগাঁর ছেলে দশ বছরের আব্দুর রহিম একসময় বলে উঠল, ‘প্রেমের মরা জলে ডুবে না ভাই। এই কথা কখনো শোনেন নাই?’