পর্বতের রিজলাইন থেকে সকলে স্নো ফিল্ড ধরে তাড়াহুড়ো করে নেমে যাচ্ছে। সকলের ইচ্ছা তাবুতে পৌঁছে ওম লাগা স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে আরামদায়ক একটা ঘুম দিবে। সকালের কোমল রোদের উষ্ণতায় এখানে ঘুমটা ভাল হয়। আবার মধ্য দুপু্রের প্রচন্ড গরমে তাবুর ভিতরে আর তিষ্ঠানো সম্ভব হয় না। তখন পাহাড়ের খাঁজে একটু ছায়া দেখলেই ঠান্ডা বাতাসের মধ্যে গিয়ে বসে থাকতে হয়। কি অদ্ভুত, একদিকে রোদের তাপে গা পুড়ে যায়। আবার একই সাথে ঠান্ডা বাতাসে হাড়ে কাপুঁনি উঠে। তাই সকলে দ্রুত নেমে যাচ্ছিল যেন রোদ তাঁতিয়ে উঠার আগেই লম্বা একটা ঘুম দিয়ে উঠা যায়।
দলের মধ্যে কথনের গতিই সবচেয়ে ধীর। কিছুক্ষণের মধ্যে দলের সবার সাথে তার দূরত্ব অনেক বেড়ে গেল। কিছুক্ষণ চারপাশে তাকিয়ে সে জায়গাটি দেখে নিল। প্রায় ৩০ ডিগ্রি ঢাল হয়ে ক্রাম্পণ পয়েন্টের কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে এই স্নো ফিল্ড। হঠাৎ তার মনে হল স্নো ফিল্ড টা এভাবে ঘুরে অতিক্রম করতে অনেক সময় লাগবে। আড়াআড়ি ভাবে স্লাইড করে নেমে গেলে সহজেই দলের সবাইকে ধরা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। নরম তুষারে বসে পড়ে সে পায়ের ক্রাম্পন জোড়া খুলে ফেলল।
এরপর সে স্লাইড করে নামতে শুরু করল। রোদের তেজ এখনও বাড়েনি। তাই তুষার এখনও শক্ত অবস্থায় আছে। শরীরের উষ্ণতায় উপরের স্তর একটু গলে যায় আর তাতেই হুশ হুশ করে দ্রুত গতিতে সে নেমে যাচ্ছে। দুই হাত-পা দিয়ে মাঝে মাঝে সে তার দিক ঠিক রাখছে। নামতে নামতে এক পর্যায়ে সে লক্ষ্য করল, সামনে আর স্নো ফিল্ড নেই। হুট করেই স্নো ফিল্ড শেষ হয়ে খাড়া একটি দেয়াল হয়ে শেষ হয়ে গেছে। অনেক দূর থেকে দেখার কারনে উচ্চতার এই পার্থক্যটি সে বুঝতে পারেনি। নিজের ভুল বুঝতে পেরে সে পাগলের মত নিজের গতিকে থামাবার চেষ্টা করতে লাগল। এই হুটোপুটিতে নিজের ব্যালেন্স রাখতে না পেরে তার দিক গেল পাল্টে। ঢালটি সবচেয়ে বেশী যেখানে খাড়া হয়ে নেমে গেছে, ভাগ্য তাকে সেখানেই টেনে নিয়ে গেল।
এভাবেই যদি সে দ্রুত নামতে থাকে তাহলে একেবারে প্রান্তে পৌঁছে তাকে ছিটকে নিচে ফেলে দিবে। একেবারেই যখন শেষ সময় তখন জীবনের সবচেয়ে তীব্রতম কামনার জন্য সে প্রথমে বা পায়ের গোঁড়ালি তুষারে গেঁথে দিল। কিন্তু তার ভাগ্য খারাপ। আগের কোন এক দূর্ঘটনায় জখম হওয়ার ফলে তার বা পায়ে একদমই জোর নেই। তুষারে গোঁড়ালি শক্ত করে বসে যাওয়ায় তার শরীর সামনে এগিয়ে গেল। তার বাম পা বেঁকে হাঁটুর কাছে ভাঁজ হয়ে গেল। হঠাৎ করে টান লাগায় বা পায়ের গোঁড়ালি মুচড়ে গেল। তবুও বেঁচে থাকার তাগিদে সে ডান পায়ের গোঁড়ালি দিয়ে সর্বশক্তি দিয়ে ঠিক শেষ মুহুর্তে নিজেকে আঁটকে ফেলল।
সাড়ে চার হাজার মিটারের উপরে এমনিতেই অক্সিজেনের অভাবে শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা হয়। তার উপর এত পরিশ্রম আর নিজের সাথে ধ্বস্তাধস্তি করে সে ক্লান্ত হয়ে গেল। জোরে জোরে শ্বাস নিয়ে একটু ধাতস্ত হতেই সে তার সামনে কি আছে দেখতে পেল। প্রায় বিশ ফিটের একটি খাড়া দেয়ালের প্রান্তে বসে আছে সে। তার বসবার ভঙ্গি খুবই কিম্ভুত। তার বাম পা হাটুর কাছে বেকে শরীরের সাথে লেগে আছে। আর ডান পা সোজা সামনে আটকে রেখেছে। আর নিচে ছোট বড় বোল্ডারে ভরা বিস্তীর্ন মোরেইন জোন। ঠিক তখনই সে অনুভব করল তার বা পায়ে অসহ্য ব্যথা হচ্ছে।
কথন দ্রুত চিন্তা করা শুরু করল। তার পক্ষে এই অবস্থায় আবার ব্যাকপ্যাক থেকে ক্রাম্পন বের করে দুই পায়ে সেটা লাগানো সম্ভব হবে না। ডান পা একটু উঠানোর চেষ্টা করলেই সে উলটে নিচে পরে যাবে। আবার চিৎকার করে সাহায্যের জন্য দলের কাউকে ডাকাও সম্ভব নয়। যা করার নিজেকেই করতে হবে। এদিকে পায়ের ব্যথা রীতিমত অসহ্য হয়ে উঠছে। চিনচিনে সুস্পষ্ট একটা ব্যথা পা ছাপিয়ে তার মেরুদন্ডে উঠে আসছে।
যা করার খুব তাড়াতাড়ি করতে হবে। খুব বেশীক্ষণ এইভাবে পা মুচড়ে বসে থাকা সম্ভব হবে না। এদিকে একভাবে বসে থাকার ফলে ঠান্ডাও জাঁকিয়ে বসেছে। এভাবে বসে থাকলে এক সময় ঠান্ডায় জমে যেতে হবে। যা করার খুব দ্রুত করতে হবে। কেউ সাহায্য করতে আসবে এই আশায় বসে থাকা যাবে না। তার উপর পা আর মেরুদন্ডের ব্যথা এখন অসহ্য হয়ে উঠেছে। সবকিছু বিবেচনা করে সে এই খাড়া দেয়াল দিয়েই নিচে নেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল, এভাবে নামতে গিয়ে তার মাথা পাথরে থেতলে যেতে পারে এটা খুব ভালমত বুঝার পরেও।
কিন্তু ডান পা উঠিয়ে তুষারের উপর দিয়ে স্লাইড করে নিচে ঝাঁপ দেয়ার চেষ্টা করতেই সে থমকে গেল। তার বা পা বরফের ভিতর শক্ত করে আঁটকে গেছে। কিছুতেই টেনে বের করা যাচ্ছে না। এতক্ষণ ধরে পা দাবিয়ে রাখায় তুষার গলে গলে পা একদম ভিতরে ঢুকে গেছে। আর উপরের স্তর জমে আরও শক্ত হয়ে গেছে। এই অবস্থায় বুঝতে পারল, সে ফেঁসে গেছে।
কিছুক্ষণ চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে দেয়ার মত অবস্থায় চলে এল। কিন্তু পা আর পিঠে ছড়িয়ে পড়া ব্যথাই তাকে হতাশ হতে দিল না। সে সর্বশক্তি দিয়ে তার শরীরকে উপরে টেনে তুলার চেষ্টা করতে লাগল। দাঁতে দাঁত চেপে ব্যাথা অগ্রাহ্য করে, অবশিষ্ট সর্বশক্তি দিয়ে নিজেকে কোন রকম টেনে তুলেই সে শুন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
বিশ ফিট উপর থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়তে কতক্ষণই বা লাগে। কিন্তু আর মনে হচ্ছিল যেন যুগ যুগ ধরে সে শুন্যে ভেসে বেড়াচ্ছে। আর হা করা এক বিশাল কৃষ্ণগহ্বরের দিকে সে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ছোট্ট মুহুর্তে সে কত কিছু যে ভেবে ফেলল! সে ভাবল বাবার মোবাইল চার্জারটা খাটের পাশে পড়ে গিয়েছিল, তাঁকে আর বলা হল না। মাকে বলা হল না সে আসলেই একদিন সব ছেড়ে চলে যেতে চায়। কাজাকিস্থানে যার যাওয়া হল না, অক্সাস নদীর পাড়ে তাবু খাটিয়ে জংলি আইবেক্স শিকার করা হল না। কাউকে ভালবেসে বিদায় বলা হল না। অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সব সাথে তালগোল পাঁকিয়ে তার মাথায় হট্টগোল লাগিয়ে দিল।
পরমুহুর্তেই ধপ করে একটি আওয়াজ হল। এরপর শুধুই নিস্তব্ধতা। মন্ত্রবলে মাথার হট্টগোল গুলো সব থেমে গেল। হুড়মুড় করে চলে আসা স্মৃতি গুলোও কঠোরে লুকিয়ে গেল। সব চিন্তা উধাও হয়ে গেছে। তার শরীরের ভারও শূন্য হয়ে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার তার সেই অসহ্যকর ব্যাথাটিও সে আর অনুভূব করছে না। সে গভীর কৃষ্ণগহ্বরে শূন্য দেহ নিয়ে নিথর পড়ে রইল।
৩০/১০/১৭