ছন্নছাড়া

আজকাল কেন জানি খুব ঘন ঘন হ্যালুসিনেশন হচ্ছে। আজকে ঢাকা থেকে বাসায় ফেরার পথে লিংক রোডের দু’পাশের খোলা আকাশে কালো মেঘের জমজমাট আনাগোনা দেখে মুহুর্তের জন্য চলে গিয়েছিলাম চার বছর আগে। সেদিন এমনই এক বিকাল বেলায় মুখোমুখি হয়েছিলাম প্রকৃতির এক ভীষণ রুদ্রমূর্তির সাথে।

ঘটনার শুরু হয়েছিল দিন চারেক আগে। বগালেক এসেছিলাম স্কুলের বন্ধুদের সাথে। সেখানে সিয়াম ফুপুর কড়া নজরদারির কারনে আমি বগালেকে কার্যত গৃহবন্দী হয়েছিলাম। তিনদিন শুয়ে বসে কাটানোর পরই একদম হাঁফিয়ে উঠেছিলাম। এর মাঝে একদিন কেবল চ্যামায় নেমে গোসল করে এসেছিলাম। তারপর আবার যেই কে সেই রুটিন- ঘুম থেকে উঠো-খাও-কার্ড খেলো-খাও-আড্ডা দাও-আবার খাও-কার্ড খেলো-আবার আড্ডা-ঘুম খাওয়া…আর কত ?

পরদিন এক রকম জোর করেই চিংড়ি ঝর্ণায় গোসল করার নাম করে বেড়িয়ে পড়লাম আমরা। আমাদের ব্যাগ ট্যাগ দেখলে কেউ যেতে দিবে না বলে সাথে কিছুই নিয়ে বের হইনি। আমাদের প্রথমে পরিকল্পনা ছিল চিংড়ি ঝর্ণা পর্যন্তই যাব। আমার পায়ে কোন সমস্যা হচ্ছে কিনা আর আমি হাঁটতে পারব কিনা সেটা বুঝার পর সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে, এর পর আমরা কি করব।

চিংড়ি ঝর্ণায় পৌঁছাতে আমা্র তেমন কোনো বেগই পেতে হয়নি। যদিও বড় বড় পাথরের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় দুই পা একটু একটু কাঁপছিল তবে কিছুক্ষনের মধ্যেই সেটা ঠিক ও হয়ে গেল। চিংড়ি পর্যন্ত যখন এসেই গেছি তখন সবাই ভাবলাম দার্জিলিং থেকে না হয় একটু চা খেয়ে আসি। সবাই মিলে গুটুর গুটুর করতে করতে ১২ টার দিকে দার্জিলিং পাড়ায় চলে আসলাম। চা-বিস্কিট দিয়ে নাস্তা করতে করতে কিভাবে যেন ঘড়িতে দুটা বেজে গেল। সেই সাথে আমাদের পেটেও ক্ষিদের জ্বালায় মোচড় দিয়ে উঠল। অনেকক্ষন ধরে আমরা ভাবলাম, এখন কি বগা লেকে নেমে যাওয়া উচিৎ হবে নাকি দার্জিলিং পাড়াতেই কিছু খেয়ে রোদ টা একটু কমলে পড়ে বগালেকে নামব?

দার্জিলিং পাড়ায় যদি এখন রান্না শুরু করি তাহলে খেতে খেতে কমপক্ষে ঘন্টা খানেক লেগে যাবে। এতক্ষন ক্ষিদে সহ্য করার কোন মানেই হয় না। এর চাইতে ভালো হয় না যদি আমরা আরেকটু কষ্ট করে কেওক্রাডং চলে যাই? লালা দা’র ওখানে তো খাওয়া ও রেডি পাব। দুপুরে খেয়ে ভাত ঘুম দিয়ে বিকালের মিস্টি রোদে বগা লেক নেমে যাব।

বুদ্ধিটা সবার মনে ধরল। এতই যখন কাছাকাছি চলে এসেছি তখন কেওক্রাডং কেন বাদ যাবে। আবার ক্ষিদের জ্বালা মিটানোর ও ব্যাপার আছে। তাই আর সময় নষ্ট না করে সবাই কেওক্রাডংয়ের দিকে হাঁটা দিলাম। লালা দা’র ঘরে বসে এক গামলা ভাত শেষ করে আমি ওখানেই কাইত হয়ে গেলাম।

বিকালের দিকে ঘুম ভাঙল। সবাই আড়মোড়া দিয়ে নিচে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। এর মধ্যে শিশির বলে উঠলো, “কেউ চূঁড়ায় যাবে না?” কারো মধ্যেই কেওক্রাডংয়ের চূঁড়ায় উঠার মত আগ্রহ দেখা গেল না। এতদূর চলে আসা অভিযাত্রীদের শরীরে এই কয়েক ধাঁপ সিঁড়ি ভাঙতে গিয়ে রাজ্যের আলস্য এসে ভর করল। শিশির প্রথমবারের মত এসেছে। তাই ওকে বললাম, “তুই যা। দেখে আয়”।

এদিকে শিশির উপর থেকে নামতে নামতে আশফাক ভাইয়ের পান খাওয়ার সাধ জাগলো। পান পাওয়া যায় পাশেই পাসিং পাড়ায়। একবার পাসিং পাড়ায় যাওয়ার কথা উঠতেই কিভাবে যেন একসাথে সবার তীব্র চায়ের তেষ্টা পেয়ে বসলো। সবার চোখে মুখে এখনো ভাত ঘুমের রেশ কাটেনি। ঘুমের রেশ নিয়ে নীচে নামতে গেলে দূর্ঘটনা ঘটতে পারে। তাই সবার নিরাপদ অবতরনের কথা ভেবে দার্জিলিং পাড়ায় না নেমে পাসিং পাড়াতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়ে গেল।

পাসিং দা’র ঘরে বসে চায়ের সাথে আলাপ জমে উঠল। আমাদের এক্সিডেন্টের কথা উঠতেই পাসিং দা’র কাছে জানতে পারলাম রামথন দা’র ও এক্সিডেন্টে পা ভেঙ্গে গেছে। আলাপে আলাপে চায়ের কাপ ও রিফিল হতে লাগলো। কিছুক্ষনের মধ্যেই পাসিং পাড়ার চারদিক থেকে ঠান্ডা বাতাস বইতে লাগল। বাইরে এসে দেখি রীতিমত হুলুস্থুল ব্যাপার। পুব দিকের আকাশ জুড়ে কালো মেঘের একটা কুন্ডুলী পাঁকিয়ে উঠছে।

হতবাক চোখে আমরা সবাই মেঘের যুদ্ধের আয়োজন দেখছিলাম। এই যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝে ঘন কালো মেঘের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেলাম ছোট একটা জুম ঘর পাহাড়ের একটা রিজ লাইনের উপর ঝুলছে। ঝড় দেখার এই চাইতে ভালো জায়গা আর হতেই পারে না। মুহুর্তের মধ্যেই কি যেন হয়ে গেল। সবাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, এই জুমের মাচাতে দাঁড়িয়ে এর মুখোমুখি হতেই হবে। আমাদের নিচে নামার চিন্তা, আমাদের জন্য যারা অপেক্ষা করে আছে তাদের চিন্তা সব বেমালুম মন থেকে হারিয়ে গেল। একদল ছন্নছাড়া ঝড় দেখতে বেড়িয়ে গেল।

সবাই চোখ বন্ধ করে দৌঁড় শুরু করলাম। যেকোন মুহুর্তে ঝড় শুরু হয়ে যাবে। যেভাবেই হোক বাতাসকে আজ হারাতেই হবে। ঝড় আসার আগেই জুম ঘরে পৌঁছাতে হবে। আমার ভাঙা পায়ের কথা ভুলে গেলাম। পায়ের-পিঠের সেই অসাড়তা টা কেটে গেল। কেমন এক ঘোরের মধ্য দিয়ে সবার সাথে তাল রেখে আমি দৌঁড়াতে থাকলাম। এখন ভাবতে অবাক লাগে, যেই আমি তখনও খুঁড়িয়ে হাঁটি সেই আমি কিভাবে আর কিসেরি বা টানে এভাবে সেদিন দৌঁড়ে ছিলাম?? কোন ব্যাখ্যাই খুঁজে পাই নি…

ভাগ্যিস আমাদের সাথে কোন ব্যাগ ট্যাগ ছিল না। থাকলে নিশ্চিত প্যারা খেতে হত। দুই তিনটি পাহাড় ডিঙিয়ে হাঁফাতে হাঁফাতে যখন আমরা জুম ঘরের মাচায় গিয়ে দাঁড়ালাম তখন পুরো পুব আকাশ জুড়ে যুদ্ধের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে। এদিক থেকে এক থোকা মেঘ, ওদিক থেকে এক থোকা মেঘ এসে একে অপরের সাথে মিলে মিশে মেডুসার চুলের মত ভীষণ আকার নিয়ে গম্ভীর গতিতে সামনে এগিয়ে আসছে। এ এক মাথা নষ্ট করা দৃশ্য। চোখের সামনে প্রকৃতির রুদ্র রুপ জন্ম নিচ্ছে।

কিছুক্ষনের জন্য আমার চারদিকে তাকালাম, সবাই যার যার মত ঝড়ের প্রস্তুতি নিচ্ছে। শিহাব ভাই ঝড়ের ছবি তুলতে আরো সামনে এগিয়ে গেছে। নিবিড় ও ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত। তূর্য তার স্বভাব অনুযায়ী দৌঁড়াচ্ছে। শিশির আর দীপ থম মেরে বসে আছে- দৃষ্টি ঝড়ের দিকে।

কুন্ডুলী পাঁকানো কালো মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সম্মোহিত হয়ে গেলাম। সময়ের হিসাবে সূর্য এখনো ডুবে যায় নি। কিন্তু চরাচর কালো মেঘের ছায়ায় ঢেকে গেছে। এতক্ষন ধরে যেই ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাচ্ছিলো হঠাৎ করেই সেটা বন্ধ হয়ে গেলো। ভয় ধরানো এক গুমোট একটা ভাব চারিদিকে। সেই সাথে বুকে কাঁপুনী ধরানো এক ধিরিম শব্দে ঠিক আমাদের সামনেই একটা বাজ এসে পড়লো। সেই বজ্রাঘাতের আলোয় বেজে উঠলো দামামা। শুরু হয়ে গেলো প্রকৃতির তান্ডব। মুহুর্তের মধ্যে আবার সেই ঝড়ো বাতাস ফিরে এল। মনে হচ্ছিলো বাতাস আমাকে উড়িয়ে নিয়ে চলে যাবে। এই জুম ঘর টা টিকবে না। কিন্তু তবুও আমি আবিষ্ট হয়ে তাঁকিয়ে ছিলাম সেই আতঙ্কের দিকে। এক পা ও নড়তে পারি নাই। একের পর এক বাজ প্রচণ্ড আক্রশে যখন আমাদের চারপাশে আঁছড়ে পড়ছিলো, সেই আলোর ঝলকানিতে ঝড়ের ভয়াবহ আকার দেখতে পেয়ে অজানা উৎকন্ঠায় বুক হিম হয়ে যাচ্ছে। তবুও এক মনে তাকিয়ে আছি তার দিকে, মুখোমুখি হয়ে। যা হবে হোক আজ আমি প্রস্তুত। একটু পরেই শুরু হয়ে গেল বৃষ্টি। ফোঁটায় ফোঁটায় সূঁচের মত এসে বিঁধতে লাগল। আমরা রীতিমত ঠান্ডায় কাঁপছিলাম, তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। এ যেন প্রকৃতির সাথে আমি এক জুয়া খেলছি।

আমি খুব একটা রোমান্টিক না। মনের মধ্যে পদ্য সব সময় খেলেও না। কবিতা টবিতা আমার সব মনেও থাকে না। কিন্তু সেদিন অশুভ অন্ধকারে আকাশের উন্মত্তা দেখে রবিবাবুর লেখা দুই তিন লাইন খাপছাড়া মাথার মধ্যে খেলা করছিল।

জয়তববিচিত্রআনন্দ, হেকবি,

জয়তোমারকরুণা।

জয়তবভীষণসবকলুষনাশনরুদ্রতা।

সেদিন ঝড়ের মুখোমুখি তো হলাম। বৃষ্টিতে ভিজে এক সাঁ ও হলাম। সাথে কোন জামা কাপড় নাই। কোন খাবার নাই। এদিকে অন্ধকার হয়ে গেছে। ফিরে যাওয়ার কোন উপায় নাই। আশেপাশের সব কিছু ভিজে গেছে। আগুন জ্বালানোর জন্য শুকনো কিছু নাই। ঠান্ডায় সবাই থর থর করে কাঁপছি। দুই ঘন্টার জন্য আমরা বগা লেক থেকে বের হয়েছিলাম। কিন্তু কে জানত আমরা দুই ঘন্টা কেন, দুই দিনেও বগা লেক ফিরতে পারব না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!