ঝড়

বছর পাচেক আগে এমন সময়ে বান্দরবানে ছিলাম। সেবারও ফাগুন আসার আগে ভরা মাঘেই পাহাড়ে অঝোর বৃষ্টি ঝরেছিল। এমনই বৃষ্টি পড়েছিল যে বেশ কয়েকদিন ঘর থেকে বের হতে পারিনি। একেবারে যাকে বলে নাস্তানাবুদ অবস্থা।

সেই অভিযানের কোন এক সকালে আমরা একটি পাহাড় চূড়ায় ছিলাম। তখনও কোথা থেকে যেন ঝুম বৃষ্টি শুরু হল। কোথাও মাথা গোঁজার জায়গা ছিল না। অনেকটা বাধ্য হয়েই ঠকঠক কাঁপুনির মধ্যে চূড়া থেকে সামনের খোলা দিগন্তপানে চেয়ে বৃষ্টি দেখছিলাম। এখন মনে হয় খুব ভাগ্যবান ছিলাম বলেই এমন একটি জায়গা থেকে এমনভাবে প্রকৃতির এত শক্তিশালী এলিমেন্টকে চাক্ষুষ করতে পেরেছিলাম।

পুরো সময় জুড়ে মনে হচ্ছিল আমি কোন ম্যাজিক শো দেখছি। কথা নেই বার্তা নেই ঈশান কোণ থেকে বইতে শুরু করল ঝড়ো হাওয়া। যেন জানান দিল; পরিবর্তন ঘটাতে আসছে পরবর্তী যোদ্ধা। সকালে যেখানে তপ্ত সূর্যে সব ঝলসে যাবার কথা তখন কালো কালো মেঘ এসে রাত নামিয়ে দিল। কড় কড় কড়াৎ শব্দে দেবতা জিউস অলিম্পাস থেকে তার বিজলীর তৈরী বল্লম ছুড়ে মারল। কালো রঙ দিয়ে ঘুলে দেয়া ক্যানভাসে সেই বিজলীর শত শত রঙ ফুটে উঠল। এত রঙের নামও আমার জানা নেই। কোনটা লালের মত, কোনটা নীলাভ আর সবুজ। গগনবিদারী শব্দ পুরো পাহাড়কে যেন কাঁপিয়ে দিল।

এরপর হুট করে থমকে যাওয়া অসহ্যকর এক নীরবতার পালা। এই সময়টুকুতে মনে হয় প্রলয়ের প্রতীক্ষায় যেন সবাই উন্মুখ হয়ে আছে। খুব বেশীক্ষণ আমাদের অপেক্ষা করতে হয় না। মুহুর্তের মধ্যেই গুম গুম করে আকাশ ভেঙে পড়ে। মেঘে মেঘে জমে থাকা সঞ্জীবনী বড় বড় বৃষ্টির ফোটা হয়ে তীব্র আক্রোশে ধরত্রীর বুকে আছড়ে পড়া শুরু করল। ঘন সাদা ঘোলাটে মেঘ ঢেকে দিচ্ছিল সব জীর্ণ মলিনতা।

এরপর একসময় প্রকৃতি শান্ত হল। জাদুকর শুষ্ক, ম্যাড়মেড়ে, ধুলোভরা, নির্জীব পাহাড়গুলোর উপর থেকে তার মেঘের চাদর ধিরে ধিরে তুলে ধরছে। ঘোলাটে ভাব পরিষ্কার হয়ে তার ভিতর থেকে বেড়িয়ে আসছে সজীব ও স্নিগ্ধ পাহাড়, আমাদের সবুজ পাহাড়- অপূর্ব আর মোহময়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!