ডিসপ্যাচ [তিন]

অক্টোবর ১৪, ২০১৪ । তারিখটি আমার এখনো মনে আছে। সেবারই প্রথমবারের মত অর্গানাইজড কোন হিমালায়ান অভিযানে আমি নেপাল এসেছি। এটি একই সাথে দ্যা কোয়েস্টেরও প্রথম কোন অভিযান। কোয়েস্টের প্রথম অভিযান হিসেবে আমরা খুবই মডেস্ট একটি চূড়া সিলেক্ট করেছিলাম; অন্নপূর্ণা ম্যাসিফের মধ্যমণি, থারপু চুলি। থারপু চুলি অভিযান ও অন্নপূর্ণা বেইজক্যাম্প মিলিয়ে বেশ বড় একটি দল। এই দিন আমরা ট্রেক করে মাচ্ছাপুচ্ছেরে বেইজক্যাপ পৌঁছে ছিলাম। পরদিন আমাদের অন্নপূর্ণা বেইজক্যাম্প চলে যাবার কথা ছিল। কিন্তু প্রকৃতির সিদ্ধান্ত একটু অন্যরকম ছিল।

বিকেলের পর থেকে আবহাওয়া হঠাৎ করেই খারাপ হতে থাকে। সন্ধ্যার পর পর শুরু হয় ভয়াবহ ব্লিজার্ড। হু হু করে বিশালকায় কোন পৌরানিক জানোয়ারের আক্রোশের মত গর্জন করে বাতাস আছড়ে পড়ছিল ক্যাম্পের পাথুরে দেয়ালে। এরপর শুরু হল তুষার ঝড়। সারারাত ধরে চলল সেই তান্ডব। নেপাল হিমালয়ে প্রথম অভিযানে এসেই তুষারপাত দেখার সৌভাগ্য হচ্ছে- তখন পর্যন্ত নায়িভ স্টুপিডিটির মত উৎফুল্লই ছিলাম। তুষার থাকবে, আইস থাকবে- আইস এক্স গেথে গেথে ক্লাইম্ব করব তবেই না রিয়েল মাউন্টেনিয়ারিং হবে- সিনেমা টিনেমায় যেমন দেখি আর কি!

সেই ঝড় যখন পরদিন সকালেও থামলো না তখন আমরা বেকুবের মত আরেকটু আনন্দিত হলাম। এদিকে এজেন্সির এলোকেটেড সময়ের মধ্যে যেই রিজার্ভ ডে ছিল সেটা আমরা গুলতানি, আড্ডাবাজী, তুষারপাত উপভোগ করে পাড় করে দিলাম। সারাদিন ধরে চলল তুষারপাত আর থেমে থেমে দমকা হাওয়ার চপেটাঘাত।

পরদিন সকালে ঝকঝকে রোদ উঠল। তাকিয়ে দেখি চারিদিক ধবল তুষারে সাদা হয়ে গেছে। আমরা উত্তেজিত, আজ এবিসি যাব। পরশু অভিযান শুরু হবে। কিন্তু পথে নেমে দেখি প্রায় দুই মিটারের মত তুষারপাত হয়েছে। পর্বতের পরিবর্তিত অবস্থা দেখে শেরপারাও একটু চিন্তিত। প্রচলিত রুট সব আতর্কিত ঝড়ে হারিয়ে গেছে, আবার নতুন করে ট্রেইলব্রেক করে রুট ওপেন করতে হবে।

এরপরের ঘটনা নিয়ে অনেক কথা বলা যাবে। কিন্তু হাতে সময় বড় অল্প। শুধু এটুকুই বলি, শেষ পর্যন্ত আমাদের সাপোর্ট ক্রুদের পারদর্শীতায় আমরা অভিযান চালিয়েছিলাম। হাইক্যাম্পের একটু উপরে, পাঁচ হাজার কি পাঁচ হাজার একশ মিটার উচ্চতা পর্যন্ত গিয়ে আমি থেমে গেলাম। সেখান বেশ বড় একটি পাথরের চাতাল ছিল। এই পর্যন্ত এসে আমি বুঝে যাই, আমার দৌড় এই পর্যন্তই। আমার সঙ্গী হিসেবে পেয়ে গেলাম রাব্বি ভাইকে। আমরা দুজন মিলে ঠিক করলাম, এই কার্ডিনাল মোমেন্টে পর্বতারোহণের চাইতে একটি পাওয়ার ন্যাপ দেয়া বেশী জরুরী। দলের বাকিরা নিজেদের ম্যাটেল যাচাইয়ে সামনে এগিয়ে গেল। আমরা দুজন পাথরের চাতালে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সত্যি বলছি, হিমালয়ের বুকে হিম হিম ঠান্ডা বাতাস আর চামড়া জ্বালিয়ে দেয়া রৌদ্রতেজে সেই ঘন্টা দুয়েকের ঘুমের মত প্রশান্তি আর কখনো পাইনি। এই অভিযানে একটা জিনিস আমি খুব ভালোভাবে শিখে গিয়েছিলাম- দ্যা মোমেন্ট হোয়েন ইউ হ্যাভ টু স্টপ। পর্বতারোহণ জোরজবরদস্তি কোন লক্ষ্যে পৌঁছানো নয়। আমি যদি উপভোগই না করি, আমার যদি দম বের করে দেয়া কষ্টই হয় তাহলে এর কোন মানেই হয় না। আমি ততক্ষণ পর্যন্তই পথ চলব, যতক্ষন পর্যন্ত আমি উপভোগ করব। যখনই দেখব আমার এবিলিটির বাইরে পরিস্থিতি চলে যাচ্ছে, আমি ইমিডিয়েটলি থেমে যাব। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই ফিলোসফির কোন ব্যত্যয় হয়নি।

সত্যি কথা হল, থারপু চুলি অভিযানের জন্য আমি কোনভাবে প্রস্তুতই ছিলাম না। না ফিজিক্যালি আর না মেন্টালি। কিন্তু নিজেদের সীমাবদ্ধতার জায়গায় প্রকৃতিকে দায়ী করা ইগোস্টিক্যালি ইজিয়ার। আফটার অল আমিও মানুষ, তাই বলে বেড়াতে ভালোলাগে- আরে বঙ্গোপসাগরে ঘুর্নিঝড় উঠেছিল সেবার। সেই ঝড়ের নাম ছিল হুদহুদ। এমন ঝড় বিগত দশ বছরে কেউ দেখে নাই। সেই ঝড়ের রেশ হামলে পড়েছিল হিমালয়ের বুকে। কোমড় সমান স্নো দিয়ে ভরে গিয়েছিল পুরো ট্রেইল। প্রকৃতি চায় নাই আমরা সফল হই, তাই আমাদের অনুমতি দেয়নি…

আমরা আসলে ভাগ্যবান ছিলাম, তাই একটু ঘুমিয়ে নিতে পেরেছি। সহি সালামত ফিরে এসে জোড়াতালি দিয়ে, ফুলিয়ে ফাপিয়ে রঙটঙ লাগিয়ে গল্প শোনানোর জন্য এখনো বেঁচে আছি এটলিস্ট। কিন্তু ঠিক অপরপাশের থরং লা পাসে শ’খানেক অভিযাত্রীর ভাগ্য মোটেও ভালো ছিল না। হুদহুদের প্রভাবে নামা তুষারঝড়, সেখান থেকে নেমে আসা এভালাঞ্জ, বরফে চাপা পড়ে হাইপোথারমিয়ার মারা যায় ৪৩ জন ট্রেকার, চিরতরে হারিয়ে যায় আরও প্রায় পঞ্চাশজন। ইলেকট্রিকসিটি, টেলিক্লানেক্টিভিটি সহ এইপুরো অঞ্চলের সাথে সকল ধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

আহ… হিমালয় ও বঙ্গোপসাগর। কি গভীর ও রহস্যময় একটি ক্যামেস্ট্রি। সেই ২০১৪ থেকে আজ অবধি যতবার আমি হিমালয়ে কোন অভিযানে এসেছি প্রতিবার বঙ্গোপসাগরে ডিপ্রেশন জন্ম নিয়েছে। এখন সেটা প্রি-মনসুন হোক বা পোস্ট। এই পুরো বিষয়টি মেলোড্রামাটিক মনে হলেও এবারও এর কোন ব্যত্যয় ঘটেনি। বিগত বিশ বছরে বঙ্গোপসাগরে মার্চ মাসে কোন ডিপ্রেশন জন্ম নেয়নি। কিন্তু এবার আমি মার্চে এসেছি হিমালয়, এন্ড গেস হোয়াট?

পরশু খবরটি শোনার পর থেকেই বঙ্গোপসাগরে জন্ম নেয়া ডিপ্রেশন সিস্টেমটির গতিপ্রকৃতি বিভিন্ন ওয়েদার মডেলে ফলো করে যাচ্ছি। এই নিম্নচাপটি যদি আগামীকাল ঘূর্ণিঝড়ে রুপ বেয় তাহলে এর নাম হবে ‘অশনি’। এই নামটি শ্রীলঙ্কার প্রস্তাবিত। সিংহলী ভাষায় এর অর্থ ক্রোধ বা আক্রোশ। আগামীকাল সিস্টেমটির আন্দামান নিকোবার আইল্যান্ডে ল্যান্ডফল হবার সম্ভাবনা আছে। এসময় বাতাসের গতি থাকবে প্রায় ৯০ কিলোমিটার। এখন পর্যন্ত গতিবিধি দেখে আবহাওয়াবিদরা ধারণা করছেন আগামী ২৩ তারিখে সিস্টেমটির বাংলাদেশ-মায়ানমার উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানবে।

আমি এখন কি দোয়া করতে পারি? ঘূর্ণিঝড়ের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যেন আর উত্তর পশ্চিমমুখী না হয়। এখন যা আছে সেখানেই যেন ল্যান্ডফল হয় নাকি যেন সিস্টেমটি সাগরেই দুর্বল হয়ে ঘুমিয়ে যায়, কোথাও-ই তার আঘাত হানার দরকার নাই। এখন আমি আগের চাইতে অল্প হলেও একটু পরিণত হয়েছি। এখন আর যা হয় হবে বলে পথে নেমে যাইনা। একটু বুঝেশুনে পরিস্থিতি বিচার বিবেচনা করে পথে নামতে হয়। এখন আমি মেঘ চিনতে পারি। দুপুরের পর পর উপত্যকা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠা মেঘেদের কুন্ডলি দেখে তাদের অভিপ্রায় বুঝতে পারি। মেঘেদের ফিসফিস, গোঙানি, আক্রোশ, ক্ষোভ, অভিমান পুরোপুরি না হলেও আন্দাজ করতে পারি। তবুও মাঝে মাঝে ভুল হয়ে যায়, প্রেয়সীর মন বোঝার মত।

প্রেয়সীর কথায় মনে পড়ল, এইযে গৌরী শঙ্কর মাউন্টেইন রেঞ্জের উপত্যকায় বসে হাজার মাইল দূরের সাগরে জন্ম নেয়া একটি ক্রোধান্বিত উন্মাদ ঘূর্ণি নিয়ে দুঃচিন্তা করছি এর পিছনে তো যক্ষের প্রেমই দায়ী।

বহুদিন আগে আমার প্রথম প্রেমিকা আমাকে একটি বই উপহার দিয়েছিল। কবি কালিদাসের লেখা মহাকাব্য মেঘদূতম এর সহজ বাংলা ভার্সন। সাথে অবশ্য মূল সংস্কৃত শ্লোকগুলিও ছিল। সত্যি বলছি, কিছুই তখন বুঝি নাই। কিন্তু যঝন বড় হয়েছি, বহুদিন আগে পড়া এই প্রাচীন কবির কবিতাখানি আমার কাছে একদম নতুনভাবে ধরা দিয়েছে।

সবাই হয়ত জানেন এই পৌরাণিক গল্প, তবুও বলি।

প্রাচীনকালে কুবের ছিলেন ধনসম্পদের দেবতা, উত্তরদিকের অধিষ্ঠাতা ও লোকপাল তথা জগতের সংরক্ষক হিসাবে পূজিত হতেন। তার সেবায় নিয়োজিত ছিল একদল অর্ধদেবতা। তাদের নাম হল যক্ষ। এই যক্ষদেরও অলৌকিক ক্ষমতা ছিল। তারা যেকোন বেশ ধারণ করতে পারত ও যেখানে সেখানে হাজির হয়ে যেতে পারত। একবার এক যক্ষের অবহেলায় কুবেরের রাজ উদ্যানে এক হাতি ঢুকে যায় ও সাজানো বাগানের সব তছনছ করে দেয়। ক্রোধান্বিত কুবের যক্ষের সব ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে তাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে শাস্তি দেয়।

সেই যক্ষের আবার নতুন নতুন বিয়ে হয়েছিল। অলকা থেকে রামগিরি পর্বতে নির্বাসিত হয়ে বেচারা যক্ষ প্রেয়সীর বিরহে কাতর হয়ে পড়েছিল। অসহায় যক্ষ বিরহে থাকতে না পেরে মেঘকুন্ডুলির সাহায্য চায়। মেঘকে অনুরোধ করে, আর্জি জানায়, সে যেন উড়ে উড়ে উত্তরে অলকায় গিয়ে প্রেয়সীর কাছে বার্তা পৌঁছে দেয়। কিভাবে মেঘ তার প্রেমিকার কাছে পৌঁছাবে তার পথে বর্ণনাও দিয়ে দেয় যক্ষ। সে বলে,

‘তোমাকে যেতে হবে অলকায়, অলকা যক্ষরাজগনের বিলাসভুমি। চন্দ্রের দিপ্তিতে আলোকিত অট্টালিকা পুর্ণ নগর সেটা। তোমায় উড়ে যেতে দেখলে মীনকুমারীদের মনে আশায় সঞ্চারিত হবে। বুঝবে মিলনকাল এবার সমাসন্ন। তোমার গর্জনে ভুমি ভেদ করে ভুকন্দলী ফুল উঠে আসবে, শস্যশালিনী হবে ভূমি, মানস যাত্রী রাজহংসের দল কৈলাস পর্যন্ত তোমার সফর সংগী হয়ে পাখার সমীরনে তোমায় দিবে অনাবিল আনন্দ । যেতে যেতে যখনই তুমি ক্লান্ত হবে তখন র্পবত শিখরে শিখরে একটু বিশ্রাম করে নিও। যাত্রাপথে জলবর্ষণের ফলে ক্লান্ত হলে তখন জলপান করে নিও।

তোমার যাত্রা এবার শুরু হবে বেতসকুঞ্জ থেকে আকাশ পথে সোজা উত্তর দিকে ।

তখন তোমার দেহে ফুটবে ইন্দ্রধনু। কৃষিফল তো তোমারই অধীন, ফসলের মাঠ তোমাকে করবে পান। তুমিও হর্ষমনে বর্ষণ করো। তোমার স্পর্শে ভুমি হবে সৌরভময়। সেই সৌরভ আঘ্রাণ করতে করতে একটু বেঁকে পশ্চিম দিকে যেও, তারপর আবার উত্তর দিকে তোমার যাত্রা চলতে থাকবে যথাযথ ।

একটু বেঁকে পশ্চিমে যেতে তোমার পথে পড়বে আম্রকুট পর্বত। এরই অরণ্য দাবানলে দগ্ধ হওয়ার সময় তোমারই বর্ষণে হয়েছিল নির্বাপিত। পথশ্রমে ক্লান্ত দেখে কৃতজ্ঞ আম্রকূট তোমায় মস্তকে ধারণ করবে।

ঐ আম্রকুটের কুঞ্জবনে মুহুর্তকাল বর্ষণ করো – বর্ষণের পর নিশ্চয়ই তোমার ভার লঘু হয়ে যাবে; তখন তুমি দ্রুত গতিতে অগ্রসর হইয়ো। তখন দেখতে পাবে বিন্ধ্য পর্বতের পাদদেশে বিশীর্ণ রেবা নদী প্রবাহিতা। বিন্ধ্য গাত্রে বিচিত্র ধারা দেখলে মনে হবে যেন হস্তির গায়ে বিচিত্র রেখায় রচিত সজ্জা । তুমি যেতে যেতে দেখবে, কোথাও চাপা ফুটে উঠবে , তোমার বর্ষণে মাটি থেকে মধুর গন্ধ উঠতে থাকবে, সেই গন্ধ আঘ্রাণ করতে করতে বিচিত্র হরিণগুলি তোমার বর্ষণসিক্ত পথে ছুটবে।

সিন্ধেরা এক দুই করে গুনে যাবে তোমার সাথে সাথে ঘেষে চলা সারিবদ্ধ বলাকার দল। এমন সময় হঠাৎ মেঘের গর্জন ! চকিত, ভীত ও শংকিত হবে সিধাঙ্গনরা, সঙ্গে সঙ্গে দাঁয়তের বক্ষে আশ্রয় নেবে। অযাচিত এ আলিঙ্গনে সিন্ধেরা খুশী হয়ে তোমাকেও সমাদর করবেন।

ওগো বন্ধু আমার প্রিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে যে তুমি দ্রুত পথ চলবে তা আমি জানি।

তবু মনে হয় , কুরচি ফুলের সুগন্ধে আমোদিত পর্বতে তোমার কিছু বিলম্ব হতেও পারে।

কুরচিফুলের সুগন্ধের কথা ছেড়ে দিলেও , আকাশে তোমাকে দেখে জলভরা চোখে

তোমার দিকে তাকিয়ে ময়ুরের দল যখন স্বাগত সম্ভাষণ জানাবে, তখন তুমি কষ্ট হলেও

না থেমে আমার দু:খের কথাটা ভেবে একটু তাড়াতাড়ি চলবার চেষ্টা করো।

এরপর তোমার যাত্রাপথে পড়বে সুন্দর দশার্ণ দেশ। দশার্ণের চারদিকে শ্যামবন, তাদের ফল পরিপক্ক, বাইরে পান্ডূছায়া ভরা কেতকির বেড়া ঘেরা উপবন। তুমি সেখানে এলে কেতকির কুঁড়ি ফুটে উঠবে ,পথের পাশে বৃক্ষে বৃক্ষে পক্ষিরা দেখবে নীড় নির্মাণে রত, সে সকল অবলোকনে তোমার খুব ভাল লাগবে হে বন্ধু মেঘদূত।

দশার্ণ দেশেরই বিখ্যাত রাজধানী বিদিশা, সেখানে গেলে তোমার বিলাসী হৃদয়ের কামনা হবে পুর্ণ, নীল নেত্রবতির স্বাদু জল খানিকটা পান করে নিয়ো। বিদিশা নগরীর উপকন্ঠেই এক সুন্দর পাহাড় নীচৈ: সেই পাহাড়ে বিশ্রাম নেবার জন্য কিছুক্ষন অপেক্ষা করো, তোমার সংস্পর্শে এলে সেখানে প্রস্ফুটিত কদম্ব পুলকিত হয়ে উঠবে । সেখানে নির্জন গিরিগুহায় যৌবনবিলাসী প্রেমিকের দল বিলাসিনী রমণীদের সঙ্গে মিলিত হয় , তাদের সুবাসিত অঙ্গের পরিমলে গিরিগুহাগুলি সুগন্ধে হয়ে উঠে পুর্ণ , সেটাও তুমি দেখে নিও।

পাহাড়ে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর আবার তুমি যাত্রা করবে । বননদীর দুই তীরে দেখতে পাবে যুথিকার ঝাড়, সেখানে তুমি তোমার নতুন জলকণা একটু বর্ষণ করে যেয়ো । যে রমণীরা সেই পুষ্পবনে পুষ্পচয়ন করতে আসে তারা রৌদ্রে ক্লান্ত , ঘাম ঝরে পড়ছে , ঘাম মুছতে গিয়ে তাদের কর্ণে পরিহিত পদ্মফুলে লাগছে । তুমি তাদের ছায়া দিয়েছ বলেই তাদের ক্ষনপরিচিত বন্ধু । তাই পুষ্পচয়নকারিণীদের প্রসন্ন এবং কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তুমি অভিসিক্ত হবে ।

সোজা উত্তরে গেলে চলবে না, পথ একটু বাকা হলেও তোমাকে উজ্জয়িণী দেখে যেতে হবে । উজ্জয়িনীর বিশাল অট্টালিকার ক্রোড়ে একটু বসে যেয়ো , প্রণয়ে বিমুখ হয়োনা । সেখানে উজ্জয়নীর পুরললনাদের সুন্দর নৃত্যময় দৃষ্টিই যদি ভোগ না করলে তবে তোমার জীবন ব্যর্থ হবে হে বন্ধু মেঘদুত।

পথে নির্বিন্ধা নদী তরঙ্গে তরঙ্গে ছুটে যাচ্ছে , বাধাহীন স্থানে সৃস্টি হয়েছে নদীর আবর্ত, ঐ আবর্ত যেন নদী সুন্দরীর নাভিকূপ! তুমি একটু নেমে এসে এর রস আস্বাদন করে যেও।

এরপর কৈলাস, আর তার কোলেই তো অলকা। কুবেরের গৃহের উত্তরেই একটা মন্দারতরুর সামনেই আমার গৃহ। তথায় অবস্থান করছে আমার প্রাণাধিক প্রিয়া। হে মেঘদূত, তাকে জানাবে আমার বেদনা-মথিত অনুভবের বার্তা।’

এইরকম করে কেউ আর্জি জানালে মেঘেরা তো উত্তরে ছুটে যাবেই। দক্ষিণ সাগর থেকে উঠে আসা মেঘেদের আর কি দোষ। তারা তো প্রেমিকার কাছে বিরহের বার্তা পৌঁছে দিতেই হিমালয় পানে ছুটে যায়।

মেঘদূত আমার কাছে শ্রেফ প্রেম বিরহের কবিতা হিসেবে রয়ে যায়নি। প্রাচীন ভারতের বাস্তব ভৌগোলিক বিবরণের অসামান্য চিত্রও রয়েছে মেঘদুতের মধ্যে। সে বিবরণী এত বাস্তব ও তথ্যবহুল যে মনে হয় কালিদাস হয়তো নিজেই এই পথ দিয়ে পরিভ্রমণ করেছেন বার-বার অথবা অভিজ্ঞ কোন পরিভ্রমণকারীর কাছে শুনে এই পথের বিবরণ দিয়েছেন। কালিদাস তাই আমার কাছে একজন অসামান্য এক্সপ্লোরার আর মেঘদূত হচ্ছে তার এক্সপ্লোরেশনের আর্টিস্টিক এক্সপ্রেশন। যে কারনে মেঘদুত শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে যুগের শ্রেষ্ঠ মনিষি, পণ্ডিত, লেখক , কবি , সাহিত্যিক, সমঝদার সকলকে এক অমোঘ আকর্ষণে মন্ত্রমুগ্ধের মত কাছে টেনেছে। এর প্রতিটি শ্লোক, প্রতিটি চিত্রকল্প, প্রতিটি উপমা, ভৌগলিক অবস্থান, ঋতুভেদের প্রকৃতির পরিবর্তন, রুপের সম্ভার ও সম্পদ নিয়ে এতো বেশী ব্যপক এবং বিস্তর আলোচনা, গবেষণা, বিচিত্র দৃষ্টিভঙ্গি, মতামত এবং বিরুদ্ধ মতের সৃষ্টি হয়েছে যে সেগুলির কাহিনি নিয়েই বৃহৎ কয়েকখণ্ড বই লেখা যায়।

এখন রোমাঞ্চের খোঁজে আমরা হিমালয়ে যাবার সময় শুধু খেয়াল রাখতে হবে যেন প্রেমিক প্রেমিকার এই বিরহবার্তার মাঝে পড়ে না যাই। বুঝে শুনে পথ চলতে হবে। অভিমানভরা বার্তা উত্তরমুখী যেতে দেখলেই সাবধান হয়ে যেতে হবে। আমিও এখন যক্ষের আগামী ম্যাসেজের দিকে নজর রেখে যাচ্ছি…

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!