মৃত্যু চূড়ায় আগুন্তক

৭ই অগাষ্ট, টানা সাতদিন পর আজ ঝকঝকে রোদ উঠেছে। ঠান্ডায় কুকড়ে যাওয়া শরীরে একটুখানি সূর্যের তাপ লাগানোর লোভের একে একে বিধ্বস্ত নাবিকের মত সবাই তাঁবুর ভিতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়িয়ে আসলো। আজকে তীক্ষ্ণ চাবুকের মত বাতাসও বইছে না। আবহাওয়ার এই আপাত উষ্ণতা তাদের সবাইকে নতুন করে উজ্জীবিত করে তুলল।

একদম হঠাৎ করেই তাদের একজন, আর্ট গিলকে ধপাস করে মাটিতে শুয়ে পরল। খুব তাড়াতাড়ি নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে হতবাক সঙ্গিদের বলল, ” আমি ঠিক আছি। আমি ঠিক আছি। কিছুই হয় নাই। একটা পা শুধু ঝামেলা করছে। ঠাসাঠাসি করে টেন্ট এ শুয়ে থাকায় দুদিন আগে থেকে চার্লি হর্স (ক্র্যাম্প) ঝামেলা করছিল। একটু হাঁটাহাঁটি করলে কালকের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে।”

অশুভ কিছু একটা অনুমান করেই বোধ হয় অভিযানের দলনেতা ও চিকিৎসক চার্লস হাউসটন একপ্রকার জোর করেই গিলকে কে পরীক্ষা করল; আর সাথে সাথেই সে জেনে গেল- এক ভয়াবহ দুর্ঘটনা ইতোমধ্যেই ঘটে গেছে। আর্ট এর পায়ে থ্রম্বোফ্লিবাইটিস হয়ে গেছে। রক্ত কণিকাগুলো জমাট বেঁধে আর্ট এর পায়ের শিরা-উপশিরা গুলো বন্ধ করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় সমূদ্রের উচ্চতায় থাকলেও জমাট বাঁধা রক্ত ভেঙে ভেঙে ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছতে কয়েক ঘন্টা লাগে মাত্র। আর এখন তারা আছে সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৭৮০০ মিটার উপরে- কে টু’র ঠিক কাঁধের উপর- এইখানে আর্ট এর বেঁচে থাকার বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা কল্পনাতেও সম্ভব নয়। দলনেতার ম্লান হাসি দেখে বাকিরা কেউ বুঝেই উঠতে পারেনি- সে কতটা হতাশ, ক্রুদ্ধ, বিধ্বস্ত। তার দীর্ঘ ১৩ বছরের এই সাধনাকেনিজের চোখের সামনে এভাবে হোঁচট খেতে দেখে তার ভিতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে। 

একই সাথে হাউসটনের মাথায় চিন্তার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ঠিক এই মুহুর্তেই তাকে জীবনের সবচেয়ে কঠিন এবং নির্মম একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। নিজেদের স্বপ্ন নাকি একটি জীবন? কোনটা কে সে বেঁছে নিবে? পরিচিত মহলে লৌহ মানব হিসেবে খ্যাত হাউসটন তার ব্যক্তিগত আবেগকে সরিয়ে রেখে একজন দলনেতার মত চিন্তা করার দুর্বার চেষ্টা করে যাচ্ছে। দলের সবার কাছে অশুভ বার্তাটি খুলে বলার আগে তাদের সামনের সব কয়টি সম্ভাবনা খুঁটিয়ে পর্যালোচনা করছে:

১. ঠিক এই মুহুর্তে এই উচ্চতা থেকে পঙ্গু আর্ট গিলকে কে বেইজ ক্যাম্প এ নামানো- যদিও বেইজ ক্যাম্প পর্যন্ত সে বেঁচে থাকবে কিনা সেটার কোন নিশ্চয়তা নেই। একবার নিচে নেমে গেলে কে টু আরোহণের স্বপ্ন এখানেই শেষ হয়ে যাবে।

২. আর একদিন সময় নিয়ে সামিট পুশ করা- এইক্ষেত্রে আর্ট গিলকে’র জীবন নিয়ে বাজি ধরতে হবে। প্রতিটি মুহুর্তে আর্ট মৃত্যুর দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। ২৪ ঘন্টা টিকে থাকার মত সেই শক্তিও এখন তার নাই। এরই মধ্যে যদি আবহাওয়া আবার খারাপ হয়ে যায়???

৩. দল দুই ভাগে টীম ভাগ হয়ে যাবে। একদল আর্টকে নিয়ে এখনই নিচে নেমে যাবে। আরেক দল সামিট পুশ দেবে। এইক্ষেত্রে গিলকে’র সাথে সাথে বাকীদেরকেও মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে হবে। দলীয় শক্তি অর্ধেক করে স্ট্রেচারে করে আহত কাউকে ৭৮০০মিটার উঁচু ব্ল্যাক পিরামিড থেকে নিচে নামানোর চেষ্টা মৃত্যুর সাথে আলিঙ্গন করারই আরেক নাম।

তাকে এখন একজন লিডার হতে হবে। কঠিন এক সিদ্ধান্ত টীম কে জানাতে হবে। এত কাছ থেকে এভাবে ফিরে যেতে তার মন সায় দিচ্ছে না। আবার অন্যদিকে…আর্ট গিলকে এখনো দুই পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতে পারছে, এখনো তার নিঃশ্বাস চলছে…

নির্লিপ্ত স্বরে চার্লি ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়ার আদেশ দিলেন। এই প্রথমবারের মত সে পাহাড়ের উপর কোন ক্যাম্প সাইট পরিষ্কার না করেই নেমে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। দলের সদস্যরা নেতার এমন নির্দেশ পেয়ে অবাক হল সেই সাথে খুশিও হল। কারন তাবু গুলো গুটিয়ে, এতদিনের আবর্জনা গুলো একসাথে করে ব্যাগে ভরার মত তাদের কারোরই শক্তি অবশিষ্ট ছিল না। 

সবকিছু ফেলে রেখে তারা নিচে নামতে শুরু করলো। কিন্তু, ভাগ্যের চাওয়া একটু অন্যরকম ছিলো। গত কয়েকদিনের ভারি তুষারপাতের ফলে শক্ত বরফের উপর ফুট খানেক পাতলা তুষারের আবরন পড়ে গিয়েছিলো। পাহাড়ের এমন একটা ঢালে ঝুরঝরে বরফে নামতে যাওয়া মানে নিশ্চিত বরফ ধস। চার্লি আবার তার টিমকে ক্যাম্পে ফেরত নিয়ে চলে আসলো আর সিদ্ধান্ত নিলো নীচে নামার জন্য সে এই পর্বতে বাস করা দেবতাদের অনুমতির অপেক্ষা করবে। মৃত্যুর কাছাকাছি চলে যাওয়া একজনকে বাঁচাতে বাকিদের জীবনকে হুমকিতে ফেলা তার কাছে গ্রহনযোগ্য মনে হয়নি। 

অগাস্ট ০৯, দুইদিন হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে তারা ৭৮০০ মিটার উচ্চতায় গত নয়দিন ধরে আছে। প্রথমবারের মত চার্লির মনে হল তারা সবাই কে-টুর বুকে মারা যাবে। রাত নামতে না নামতেই আর্ট গিলকে’র বেদম কাঁশি শুরু হয়ে গেল, তার পালস বিট হয়ে গেল মিনিটে ১৪০। আর্ট বারবার চার্লিকে বুঝানোর চেষ্টা করছিলো যেন তারা আরেকটা সামিট বিডের জন্য অপেক্ষা করে। তার অবস্থার ব্যাপারে সে কিছুই বলছিলো না। নিজের মৃত্যু ছায়া বুঝার মত সে যথেষ্ট বুদ্ধিমান ছিল।

অগাস্ট ১০, তাবুর বাইরে ভয়ানক ঝড় হচ্ছে। একে অপরের সাথে কথা বলতেও গলা ছেড়ে চেঁচাতে হচ্ছে। আর্ট এর অন্য পায়েও রক্ত জমাট বেঁধে যাচ্ছে। আর এক মুহুর্ত এই উচ্চতায় রাখলে তাকে আর বাঁচানো যাবে না। তাই সবাই হালকা কয়েকটি তাবু নিয়ে ঝটপট নেমে যেতে লাগলো। একটি তাবুর দিয়ে স্ট্রেচার বানিয়ে আর্ট কে তার ব্যাগ সহ বেঁধে ফেলা হল। ভয়ানক ঝড় আর হোয়াইট আউটের মধ্যেই নানা রকম কসরত করে তাকে নিচে নামানো শুরু হল। জমাট বরফের উপর দিয়ে প্রথমে তার শরীর টেনে আনার পর, ঢাল শুরু হলে ধীরে ধীরে নিচে নামানো হল। আর্ট এর চেহারা ততক্ষনে ধূসর নীল হয়ে গেছে। একটু পর পর করা সঙ্গীদের “এখন কেমন লাগছে” প্রশ্নের একটাই উত্তর দিচ্ছিলো আর্ট- ভালো, খুব ভালো !

…নামার এক পর্যায়ে হঠাৎ করে জর্জ বেল এর পা শক্ত বরফের পাটাতনে হড়কে গেলো। তার শরীরের সাথে রোপ আপ (পাহাড়ে সাবধানতার জন্য পর্বতারোহীরা একে অপরের সাথে রশি দিয়ে যুক্ত থাকেন) থাকা স্ট্রিথার কে নিয়ে তাদের নীচে থাকা চার্লি আর বেটস এর দিকে ছুটে যায়। এই দু জনের ধাক্কায় চার্লি আর বেটস ও তাল রাখতে না পেরে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে। তাদের নীচে গডউইন-অস্টেন হিমবাহ ছড়া আর কিছু দেখা যাচ্ছিলো না।

ভাগ্যের পরিহাস সবার আগে পিট সোয়েনিং এর বিলে তে নামতে থাকা আর্ট গিলকে-মলিনার রশিতেই কোনভাবে টনি স্ট্রিথারের আইস এক্স আটকে গেলো। চারটে শরীরের টানে মিলিনার ছিটকে পড়ে গেলো। অবাক করা বিষয় হচ্ছে শোয়েনিং সবাইকে একটি আইস এক্স বরফে গেঁথে আঁটকে ফেললো। আরও অবাক করা বিষয় হল, এত ঝড় ঝাপটায় একটিও রশি ছিড়ে যায় নি।

কয়েক মুহুর্তের ঝাটকায় সবাই কেমন থতমত খেয়ে গেলো। একটু ধাতস্ত হতেই দেখতে পেলো সবার নিচে বেল তার ব্যাগ, চোখের চশমা, হাতের মিটন সব কিছু হারিয়ে কেমন ভ্যাবলার মত উপর দিকে তাকিয়ে আছে। বেটস আর মলিনারের শরীরে লাগানো রশি স্ট্রিথার এর পেটে পেঁচিয়ে তাকে দু টুকরো করে দিচ্ছে। আর সব থেকে নিচে চার্লি হাউসটন একটি ওভার হ্যাং এর নিচে অসহায় অবস্থায় ঝুলছে।

বব বেটস ধীরে ধীরে ওভার হ্যাং এর উপর তার শরীর টা নিয়ে গিয়ে চার্লির চোখের দিকে তাকিয়ে স্পষ্ট ভাষায় বললো, “ তুমি যদি ডরকা আর পেনিকে (স্ত্রী ও মেয়ে) আবার দেখতে চাও তাহলে এখনই উঠে আসো”।

যন্ত্র মানবের মত এক অমানুষিক চেষ্টার পর চার্লি কোন রকম তার শরীরটা উপরে তুলেই অজ্ঞান হয়ে গেল। হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া এই অঘটনে সবাই হতবাক হয়ে গেল। তারচেয়েও বেশি ছিলো ঠান্ডার কষ্ট আর অমানুষিক এক উদ্ধার অভিজানের পর কাহিল হয়ে যাওয়া শরীর। টিমের বাকিরা তাড়াতাড়ি তাবু টাঙিয়ে পানি গরম করার তোড়জোড় শুরু করলো। টিমের অন্য সদস্যদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে ছিলো আর্ট গিলকে। যে এই ধকলে পড়েই নি। সোয়েনিং দুটি আইস এক্স দিয়ে আর্ট কে এংকর পরে বাকিদের উদ্ধার করেছিলো। এদিকে টিমের বাদ বাকি সবার অবস্থা প্রায় যায় যায়। কিছুক্ষন বিশ্রাম নেয়ার পর তাদের শ্বাস-প্রশ্বাস কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে আসলে স্ট্রিথার আর বব বেটস আর্ট গিলকে কে নিচে নামিয়ে আনার জন্য এগিয়ে গেল…।

বব তার ডায়রিতে লিখেছিলো, “ সেখানে পৌঁছে যা দেখেছি, সেটা আমি কোনদিন ভুলতে পারবো না। পুরো ঢালে জীবনের কোন চিহ্ন ছিলো না। আর্ট হারিয়ে গেছে”

অনেকেই ধারনা করেন আর্ট গিলকে এই হট্টগোলের ফাঁকে কোনভাবে তার শরীরের সাথে লাগানো রশিটি কেটে ফেলে। তার জন্য যে অন্যদের জীবন ও এখন ঝুঁকির মধ্যে আছে সেটা সে কখনোই মানতে পারছিলো না।

কিন্তু অভিযানের নেতা চার্লি এই মতামত মানতে পারেন নাই।

এই প্রসঙ্গে তিনি তার ডায়রিতে লিখেছেন, “ শেষবার যখন তার সাথে কথা হয় তখন সে প্রায় অজ্ঞান ছিল। ব্যাথা কমার জন্য আমি তাকে ডেক্সার (ডেক্সামিথাসন) শেষ ডোজ টা দিয়ে দেই। তখন তার মধ্যে রশি কেটে ফেলার মত জ্ঞান, শক্তি, স্বাধীনতা বা ইচ্ছার কোন টাই ছিল না। এটা আমি বিশ্বাস করি…”

…ততক্ষনে আর্ট গিলকে তুষার ধসে হারিয়ে গেছে। দুঃস্বপ্নের মত একটা ঘটনা শেষ হতে না হতেই তারা এমন একটা ধাক্কার জন্য প্রস্তুত ছিলো না। কোনভাবে তারা দুইজন তাবুতে ফিরে আসলো। তাদের সামনে এখন দুঃস্বপ্নের বিরাট একটা রাত পড়ে আছে।

রাত বাড়ার সাথে সাথে চার্লির কিছুটা মানসিক ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। বারবার তার জ্ঞান হারিয়ে যাচ্ছিলো আর অক্সিজেনের অভাবে দম আটকে যাওয়ার অযুহাতে বারবার তাবুতে ছিদ্র করতে চাচ্ছিলো। যখনই জ্ঞান ফিরে আসতো সবার নাম ধরে জোরে জোরে চিৎকার করে উঠতে লাগলো। কোনভাবে এই সাতজন আগুন্তুক আরেকটি রাত পার করে দিলো; মৃতপ্রায় শরীর গুলো নিয়ে আরেকটি দিন পাহাড়ের সাথে যুদ্ধ করার জন্য …।

১৯৫৩ সালের আমেরিকার এই কে-টু অভিযান নানা কারনে পর্বতারোহণ অভিযানের একটি সর্বোত্তম উদাহরন হয়ে আছে। অভিযানের সদস্যরা আজও একে অপরের সাথে বন্ধুত্বের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আছেন। মৃত্যুকে খুব কাছ থেকে দেখা আর একে অপরের সাহায্যে মৃত্যুর সেই গ্রাস থেকে মুক্ত হওয়া প্রতিটি সদস্য নিয়মিত গেট টুগেদার করেন।

চার্লি হাউসটনের জন্য এই অভিযানটি সবচেয়ে বড় ধাক্কা ছিলো। আর্ট এর মৃত্যুকে সে কিছুতেই মানতে পারছিলো না। তার সিদ্ধান্ত, কে-টু আর তার স্বপ্ন গুলো নিয়ে সে দিন দিন হতাশা ও অবসাদে জর্জরিত হয়ে যাচ্ছিলো।

১৯৫৪ সালে চার্লি আবার কে-টু এর জন্য নিজেকে প্রস্তুত করেন কিন্তু ইটালিয়ান অভিযাত্রি দল তার আগেই পারমিট নিয়ে ফেলে। পাকিস্তান সরকার তাকে শ্রদ্ধা জানাতেই ১৯৫৫ সালে চার্লি হিউসটনকে কে-টু অভিযানের অনুমতি দেয়।  কিন্তু উনি এরপর আর কখনোই তার স্বপ্নের দিকে পা বাড়াননি।

এরপর তিনি নিজেকে হাই অল্টিটিউড মেডিসিন (অতি উচ্চতার জন্য ঔষধ) গবেষনায় ব্যস্ত করে ফেলেন। চার্লি হাউসটন তার স্বপ্নের বিনিময়ে আর্ট গিলকে কে বাঁচাতে না পারলেও তার এই গবেষনার মাধ্যমে এখন পর্যন্ত পরবর্তী সময়ের হাজারো পর্বোতারোহীর জীবন বাঁচিয়ে যাচ্ছেন।

ফিচার ছবি: কেটু বেইজ ক্যাম্পে আর্ট গিলকে’র জন্য নির্মিত স্মৃতিফলক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!