নিষিদ্ধ নগরে ফরাসী তরুণী

আমি গরম দেশের মানুষ। বাংলাদেশে আজকাল সারাবছর জুড়েই গড় তাপমাত্রা ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকে। আর গরমকালে সেটা চল্লিশ ছুঁই ছুঁই করে। পৌষ-মাঘ মাসেও এখন আর শীত পড়ে না। তবে আমি ভাগ্যবান। মাউন্টেনিয়ারিং ও ট্রেকিংয়ের কল্যানে ঢাকা যখন দাবদাহে পুড়তে থাকে আমি তখন হিমালয়ের কোলে আশ্রয় নেবার জন্য ছুটে যেতে পারি। হিমালয়ের তীব্র শীত, বিশেষ করে শীতকালীন অভিযানে বা সামিট পুশের সময় তীব্র শীতের সাথে মানিয়ে নেয়া বেশ কঠিন একটি চ্যালেঞ্জ। তীব্র শীতের সাথে কিভাবে আরও ইফেক্টিভলি অ্যাডপ্ট করা যায় সেটা নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরেই লেখাপড়া করছিলাম। বিশেষ করে আমার জানার আগ্রহ ছিল, হিমালয়ের সাধু সন্ন্যাসী বৌদ্ধ লামারা একদম নগণ্য জামাকাপড় পড়েও কিভাবে এত ঠান্ডার মাঝে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়ান? খুঁজতে খুঁজতে তিব্বতের একটি প্রাচীন  তান্ত্রিক প্র্যাক্টিশের খোঁজ পাই। সেটার নাম হচ্ছে ‘তাম্মো রেস্কিয়াং’। 

তাম্মো হল তিব্বতের উগ্রতা ও আবেগের দেবী। এই দেবীর সংস্কৃত নাম বললেই সকলে একনামে চিনে যাবেন। সংস্কৃতে এই দেবীকে ডাকা হয় চণ্ডালী। আবার এর শাব্দিক অর্থ করলে দাঁড়ায় অভ্যন্তরীন তাপ। তাম্মো রেস্কিয়াং প্রণায়ামের মতই ধ্যানের বিশেষ একটি কৌশল যেখানে শ্বাস- প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে নাভি থেকে উষ্ণতা শরীরের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। এই তাম্মো রেস্কিয়াং প্র্যাক্টিশ করেই তিব্বতের তীব্র ঠান্ডায় বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সাধারণ জামাকাপড় পড়েই আরামসে থাকতে পারেন। কিন্তু আজকে এই ধ্যান প্রক্রিয়া নিয়ে কিছু বলব না। আজকে গল্প বলব একজন এক্সপ্লোরারের, যিনি নিষিদ্ধ নগরী লাসায় অনুপ্রবেশ করেছিলেন। 

শরীর উষ্ণ রাখার উপায় খুঁজতে গিয়ে তাম্মো রাস্কিয়াংয়ের খোঁজ পেলাম। আর তাম্মো রাস্কিয়াং নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে গিয়ে খোঁজ মিলল আলেক্সান্ড্রা ডেভিড নীল এর লিখা ‘মাই জার্নি টু লাসা’ নামের একটি বই। এখন বলি এই বইটি নিয়ে আমি এতটা উচ্ছ্বাসিত কেন। 

আলেক্সান্ড্রা ডেভিড নীল, একজন ফ্রেঞ্চ মহিলা যিনি হিমালয়ের কঠিন পথ পায়ে হেঁটে প্রথম পশ্চিমী নারী হিসেবে নিষিদ্ধ নগরী লাসায় অনুপ্রবেশ করেছিলেন- মাই জার্নি টু লাসা বইটি তাঁর সেই অভিযাত্রা নিয়েই লেখা হয়েছে।। তরুন বয়স থেকেই তিনি বৌদ্ধ ধর্মের রহস্যমতার প্রতি আকৃষ্ট হন ও উচ্চতর বিদ্যা রপ্ত করার জন্য ভারত, নেপাল, ভুটান, চিন, জাপান তিব্বত ভ্রমণ করেন। সিকিমে দীর্ঘদিন বাস করে তিনি তিব্বতী ভাষা এত ভালোভাবে রপ্ত করেছিলেন যে স্থানীয়দের মতই সাবলীলভাবে কথা বলতে পারতেন। ব্রিটিশ ইন্ডিয়ায় বসে তাঁর কাছে সবসময় মনে হত লাসায় যেতে পারলেই বুঝি বৌদ্ধ ধর্মের নিগূঢ় সব রহস্য তিনি ভেদ করতে পারবেন তাই বেশ কয়েকবার তিব্বতে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন।  

অবশেষে ১৯২৪ সালে, তাঁর বয়স যখন ৫৫ বছর তখন তিনি তীর্থভূমি লাসায় প্রবেশের আরেকবার চেষ্টা করেন।  আর এবার শীতকালে, যখন হিমালয়ের সমস্ত পর্বত তুষারে ঢেকে থাকে , সীমানা প্রহরীরাও ঝিমিয়ে পড়ে কারণ, একমাত্র পাগলই এমন অবস্থায় এখানে পথ মাড়ানোর কথা ভাববে। গরীব কৃষকের ছদ্মবেশে, সিকিমের এক গুম্ফা থেকে দত্তক নেয়া একজন বৌদ্ধ লামাকে সঙ্গে নিয়ে; মাসের পর মাস হিমালয়ের দুর্গম ও কঠিন পথ পাড়ি দেন। সেইসব দিনগুলোর বর্ণনা, তাঁদের সংগ্রাম, রোমাঞ্চ, নানা বিপদ ও দুর্ঘটনা, ত্যাগ তিতিক্ষার পর একসময় তাঁর দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নের সামবালা- লাসায় পৌঁছাতে সক্ষম হন। 

খুব অল্প কথায় কিভাবে যে এই রোমাঞ্চকর অভিযাত্রাটির মাহাত্ম্য বুঝানো সম্ভব জানি না। তবে সেটা বোঝার জন্য সেই সময়ের সামাজিক ও ভূরাজনৈতিক অবস্থার কথা একটু ভেবে দেখতে হবে। ইউরোপের প্রথম মহিলা হিসেবে তিনি এমন এক নগরীতে প্রবেশ করার চেষ্টা করছিলেন যখন সেই নগরীতে বিদেশীদের প্রবেশ সম্পূর্ণ রুপে নিষিদ্ধ ছিল। একই সময়ে তিব্বত নিয়ে ব্রিটিশ, রাশিয়া ও চায়নার চলমান টানা হ্যাচড়া চলছিল, যা বিখ্যাত দ্যা গ্রেট গেইম নামে পরিচিত। আর সবচেয়ে বড় কথা- বিংশ শতাব্দীর গোঁড়ায় ইউরোপের মেয়েদের স্বাধীনভাবে চলাচল তখনও সামাজিকভাবে প্রচলিত হয়নি। সবকিছুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, আলেক্সান্ডা ডেভিড নীল তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন নিষিদ্ধ নগরী লাসা ভ্রমণ করেছিলেন। পালক পুত্রকে সাথে নিয়ে, ফর্সা চেহারায় কালি মেখে, ইয়াকের লেজ দিয়ে পরচুলা বানিয়ে গরীব কৃষকের ছদ্মবেশ ধরে দুজন মিলে শীতকালীন হিমালয়ের দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন দিনের পর দিন। বেশির ভাগ দিন তাঁদের সাথে ছিল না কোন পোর্টার, ঘোড়া, খচ্চর, ইয়াক। অচেনা অজানা, অনিশ্চয়তায় ভরা ছিল প্রতিটি মুহুর্ত।

বাজে আবহাওয়া, তুষার ঝড়, সীমান্ত রক্ষীদের তল্লাশী, ডাকাত ও ফড়িয়াদের কবলে পড়া, পশ্চিমা সকল স্বাচ্ছন্দ্য পরিত্যাগ করে দিনের পর দিন যৎসামান্য খাবার খাওয়া, খাবার শেষ হয়ে গেলে গ্রাম থেকে গ্রামে ভিক্ষে করে সামনে এগিয়ে যাওয়া, সেটিও না পেলে অভুক্ত থাকা। কিছু কিছু জায়গায় ভিক্ষা করতে গেলে স্থানীয় গ্রামবাসীরা পিছু ছাড়ানোর জন্য তাঁদের উপর কুকুরও লেলিয়ে দিয়েছিল। আশ্রয় জুটত না বলে বেশীর ভাগ দিন খোলা আকাশের নিচেই তাঁদের ঘুমাতে হত। এভাবেই সকল বিপদ অতিক্রম করে হিমালয়ের বরফাচ্ছাদিত একের পর এক উঁচু গিরিবর্ত্ম অতিক্রম করা ৫৫ বছর বয়সী একজন মহিলার শারীরিক ও মানসিক দৃঢ়তা ও সহনশীলতার গল্প পড়ে আমি বিস্মিত হয়েছি। এত বিপদ ও অবর্ণনীয় কষ্টের পরেও তাঁরা অটল ছিলেন। একবারও ভেঙে পড়েননি। দীর্ঘ চেষ্টার পর অবশেষে আলেক্সান্ড্রা ডেভিড নীল তাঁর স্বপ্নের শহর পবিত্র লাসায় প্রবেশ করেন। এখানে তিনি দীর্ঘদিন থাকেন। তিব্বতের প্রকৃতি, মানুষজন, তিব্বতের সংস্কৃতি, ধর্ম, আচারকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। এই বইতে তাঁর সেই অভিযাত্রা ও লাসায় অবস্থানকালে নানা ঘটনা দুর্ঘটনার অভিজ্ঞতাগুলোই লিখেছেন। সেইসময়কার তিব্বতকে ব্রিটিশদের বাইরে পশ্চিমের অন্য একটি পার্সপেক্টিভ থেকে জানার জন্য এটি একটি চমৎকার বই।

এখন এই অভিযাত্রী বিষয়ে কিছু আলোচনা করা যাক। আমি যতই উনার সম্পর্কে জানছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি। ১৮৬৮ সালের ২৪ অক্টোবর তিনি তৎকালীন ফরাসীর সাম্রাজে জন্মগ্রহন করেন। ছোটবেলা থেকেই দুরন্ত আলেক্সান্ড্রা ১৮ বছর বয়স বাড়ি থেকে পালিয়ে সাইকেল চালিয়ে স্পেনে চলে যান। কলেজে রেডিক্যাল রাজনীতিতে যোগ দেন। নারীবাদ নিয়ে সংবাদপত্রে লেখালেখি করে মুসোলিনির নজরে পড়েন। খুব বেশীদূর না গেলেও দুজনের মধ্যে রোমান্টিক একটি সম্পর্ক ছিল। এরপর সব ছেড়ে দিয়ে তিনি অপেরায় গান গাওয়া শুরু করেন। হুট করেই প্রেমে পড়ে আফ্রিকার ট্রেন কোম্পানির মালিক একজন ধনী ব্যবসায়ীকে বিয়ে করে ফেলেন। কিছুদিন না যেতেই সবকিছু ছেড়ে ইন্ডিয়া চলে আসেন ও বৌদ্ধ ধর্ম নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন। সিকিমে এক গুম্ফায় তিন বছর অধ্যায়ন করেন। এখানে থাকতেই একজন অনাথ লামাকে তিনি দত্তক নেন। বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জানতে জানতেই লাসা যাবার ব্যাপারে তিনি আগ্রহী হয়ে উঠেন। গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ব্রিটিশ ইন্ডিয়া থেকে তাঁকে বের করে দেয়া হয়। যুদ্ধ চলছিল বলে তিনি দেশে ফিরে যেতে পারেননি বলে চলে যান জাপান। সেখান থেকে কোরিয়া হয়ে চায়না। এরপর চায়নার দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মঙ্গোলিয়া হয়ে আবারো তিনি লাসা পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। 

এত বিপদ সঙ্কুল পথ পাড়ি দিয়েও তিনি বহুদিন বেঁচে ছিলেন।, মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০১ বছর। তাঁর অসামান্য জীবনের অভিজ্ঞতাগুলো নিয়ে তিনি লিখে গেছেন ৩০টি বই। এর মধ্যে দুটি বই খুবই ইন্টারেস্টিং। প্রথমটির কথা তো এতক্ষণ আলোচনা করলাম। আরেকটা অবশ্য পাঠ্য হচ্ছে- ম্যাজিক অ্যান্ড মিস্ট্রি ইন টিবেট। যারা তিব্বতের রহস্যময় আধ্যাত্মিকতা, মিস্টিসিজম, অকাল্টিজম, জাদুটোনা তন্ত্রমন্ত্র নিয়ে আগ্রহী তাঁরা এই বইটিও পড়ে দেখতে পারেন।

আলেক্সান্ড্রা ডেভিড নীল- একটি লার্জার দেন লাইফ ক্যারেক্টার। উনাকে নিয়ে এত এত মিথ প্রচলিত আছে যে কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা বলা মুশকিল। তাঁর রঙিন জীবন নিয়ে ১৯৯৮ সালে একটি আত্মজীবনী লিখেছেন বারবারা ও মাইকেল ফস্টার। আলেক্সান্ডার জীবনের নানাদিক নিয়ে লেখা বইটির নাম, “ দ্যা সিক্রেট লাইফ অফ আলেক্সান্ড্রা ডেভিড নীল”। আপাতত এই বইটি পড়ছি। পড়ার পর অসীম সাহসী এই মহিলা সম্পর্কে আশা করছি আরও অনেক কিছু নতুনভাবে জানতে পারব।

ধান ভানতে যে কারণে এতক্ষণ ধরে শীবের গীত গাইলাম অর্থাৎ তাম্মো রেস্কিং থেকে আলাক্সান্ড্রা দ্যা এক্সপ্লোরারে কিভাবে চলে গেলাম সেটাই বলা হয়নি। শ্বাস-প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের মাধ্যে শরীরে তাপ তৈরীর অনুশীলন প্রক্রিয়াটির সম্পর্কে আলেক্সান্ডা ডেভিড নীল তাঁর মাই জার্নি টু লাসা গ্রন্থের ১৩৪ নম্বর পৃষ্ঠায় আলোচনা করেছেন।

2 Responses

  1. চমৎকার, নতুন দিগন্ত দৃষ্টি কেড়ে নিল। অনুসন্ধানী স্পৃহা মানুষকে কত দুঃসাহসী ও কষ্ট সহিষ্ণু করে তুলতে পারে আবার সেটা পুস্তকাকারে বিবৃত করা মানুষের অসাধারণ যোগ্যতার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
    অসংখ্য ধন্যবাদ সালেহীন ভাইকে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কৌশল জানতে গিয়ে তারচেয়েও উত্তপ্ত একজন ফরাসি অভিযাত্রী ও তার বইগুলো আমাদের নজরে আনার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!