আমরা তখন মদকের রিজ লাইন ধরে উত্তর থেকে দক্ষিণে যাচ্ছি। মাথার উপর চড়া রোদ। রিজের উপর বড় গাছপালা ঘনত্ব স্বভাবতই কম থাকে। এদিকটা খুব খাড়া বলে স্বাভাবিকের চাইতেও গাছপালা একটু কম। শুধু একটু পর পর বাঁশঝাড় আছে বলেই যা রক্ষা। প্রচন্ড গরম আর আর্দ্রতায় ঘামে নেয়ে যাবার কারণে আমাদের সাথে থাকা পানিও প্রায় শেষ।
এক পর্যায়ে গলা ভেজানোর জন্য এক ফোঁটা পানির জন্যই শুধু একটা খাঁজ ধরে আমরা নীচে নেমে যেতে থাকি। আমাদের ভাগ্য সেদিন খুবই ভাল ছিল তা না হলে মাত্র পঞ্চাশ ফিটের মত নামতেই দেখি ছোট একটি ঝর্ণা, মাটি চুইয়ে চুইয়ে সেখান থেকে পানি বের হচ্ছে। কিন্তু ঠিক ঝর্ণা থেকে পানি খাবার কোন উপায় নেই, জায়গাটি পানির স্পর্শ পেয়ে কাদা কাদা হয়ে আছে। পানির ফ্লো ধরে আরেকটু নীচে নেমে দেখা গেল দুই ফিট ব্যাসের একটি গর্ত মত জায়গায় পানি জমে আছে, সেই গর্ত আবার উপচিয়ে পানি নিচের দিকে চলে যাচ্ছে।
অবাক করা বিষয় হল গর্তের পানি একেবারে টলটল করছে। তার চেয়েও অবাক করা বিষয় হল, গর্তের মধ্যে বেশ বড়সর, কালো রঙা একদাঁড় ওয়ালা একটি চিংড়িংও ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিন পাহাড়ের এত উপরে এই চিংড়িকে দেখে খুবই বিস্মিত হয়েছিলাম। আমার মাথায় প্রথমেই যেই প্রশ্নটা জেগেছিল সেটা হল, এমন একটা জায়গায় কই থেকে আসলো এটি?
সেই নিঃসঙ্গ চিংড়িকে দেখে প্রথমবারের মত আমি ঝিরিতে বাস করা প্রাণগুলোর প্রতি সত্যিকারভাবে আকৃষ্ট হয়ে গেলাম। আমাদের ঝিরিগুলোয় কত ধরণের যে প্রাণী বাস করে তার বুঝি কোন লেখাঝোকা নেই এখনো। আমি নিজেই চার ধরণের চিংড়ি দেখেছি। সাদা রঙা, কালো, কোনটার এক দাঁড়, কোনটার দুই। সেই সাথে আছে ছোট বড় কাঁকড়া, শামুক, কচ্ছপ সহ আরও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সব প্রানী।
এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রাণীগুলো বিশেষ করে চিংড়ি আর কাঁকড়াগুলো ঝিরির পুরো ইকো সিস্টেমের জন্য যে কতটা অপরিহার্য সে কথা কিন্তু আমরা একবারও গভীরভাবে ভেবে দেখি না। এরা আমাদের ঝিরির ক্লিনিং এজেন্ট হিসেবে কাজ করে। দিন রাত ২৪ ঘন্টা, সারা বছর জুড়ে। এরা কোন রেস্ট নেয় না, ছুটি নেয় না, ঝিরির পানি সুপেয় রাখার জন্য আমরা তাঁদের কোন পেমেন্ট দেই না।
তাঁরা নিরলসভাবে পানিতে থাকা অর্গানিক পার্টিকেল, ময়লা আবর্জনা, বিশেষ করে পঁচা পাতা পরিষ্কার করে পানিকে সুপেয় করে। একই সাথে অন্যান্য মাছ ও প্রানীদের খাবার যোগান দেয়। এইভাবে তাঁরা স্ট্রিম বেড, অর্থাৎ ঝিরির নিচের জমিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে পানির গুনগতমান বৃদ্ধি করে। অনেকেই দেখবেন একুরিয়ামে ফ্রেশ ওয়াটার স্রিম্প রাখেন ঠিক এই কাজের জন্য।
ইকো সিস্টেমের সবচেয়ে ভাইটাল যেই পানি; সেটিকে যারা ঠিকঠাক রাখে তারাই সবচেয়ে বেশী উপেক্ষিত থাকে। বাঘ ভাল্লুক বড় প্রাণি, সেই সাথে অনেক ইলিউসিভ। এদের নিয়ে তাও কিছুটা কথাবার্তা হয় কিন্তু আমাদের পাহাড়ের এই একুয়াটিক ইকো সিস্টেম নিয়ে আমার মনে হয় না কারও কোন মাথাব্যথা আছে। এটলিস্ট এদের গুরুত্বটা বুঝবার মত সচেতনতা আমাদের মধ্যে নেই। আর আমার মতে আমাদের পাগাড়ে এই একুয়াটিক ইকোসিস্টেমটাই সবচেয়ে বড় রকমের হুমকির মধ্যে আছে।
আর কিছুদিন পর সুপেয় পানির আকাল নামবে।