এক. ব্যাকগ্রাউন্ড স্টোরি
আমার অবজারভেশনগুলো লিখার আগে মনে হয় এই পুরো কর্মকান্ডের ছোট্ট করে ব্যাকগ্রাউন্ডটা তুলে ধরা দরকার। পৃথিবীতে মোট ১৪ টি পর্বতশৃঙ্গ আছে যেগুলোর উচ্চতা ৮ হাজার মিটারের বেশী। এই ১৪ টি চূড়ার মধ্যে ৮ টি চূড়া হল নেপালের হিমালয়ে আর ৫ টি হল পাকিস্থানের কারাকোরাম আর একটা তিব্বতে। আমাদের মত যারা পর্বতারোহণে আগ্রহী তাদের কাছে এই ১৪ টা পিক ক্লাইম্ব করার গুরুত্ব অনেকটা টেনিসের গ্র্যান্ডস্ল্যামের মত। সব টেনিস খেলোয়াড়দের যেমন ইচ্ছা থাকে অস্ট্রেলিয়ান, ফ্রেঞ্চ, উইম্বলডন ও ইউএস ওপেন জিতবে, ঠিক তেমনি ভাবে কিছু পর্বতারোহী এই ১৪টি চূড়া আরোহণ করে মাউন্টেনিয়ারিং গ্র্যান্ডস্ল্যাম শেষ করার স্বপ্ন দেখেন।
সবার প্রথম এই কাজটি করে দেখিয়েছিলেন রেইনহোল্ড মেসনার। তিনি সেই যুগে এটি করে দেখিয়েছেন যখন মনে করা হত সাপ্লিমেন্টারী অক্সিজেন ছাড়া আট হাজার মিটারের উপর পর্বতারোহণ সম্ভব নয়। সেই মেসনার সবাইকে দেখিয়েছেন অক্সিজেন ট্যাংক ব্যবহার না করেও আট হাজার মিটারের উপর দিব্যি আরোহণ করা যায়। এভারেস্ট থেকে শুরু করে একে একে বাকি ১৩ টি চূড়াও তিনি অক্সিজেন ট্যাংক ছাড়া আরোহণ করে মানুষের ক্যাপাবিলিটিকে এক অন্য উচ্চতায় পৌঁছে দেন।
এখন পর্যন্ত আনডিসপিউটেডলি ৩৯ জন এই দূরহ কাজটি শেষ করতে পেরেছেন। আরও বেশ কয়েকজন গ্রান্ডস্ল্যাম শেষ করার একেবারে দারপ্রান্তে আছেন। এই বছরেই হয়ত আরও কয়েকজনের নাম তালিকায় উঠে আসবে। সেই সম্ভাব্য কয়েকজনের মধ্যে সবচাইতে জনপ্রিয় নাম হচ্ছে নির্মল পূর্জা।
দুই. হোয়াটস দ্যা হাইপ
হঠাৎ করে বছরের শুরুতে একটা বিষ্ময়কর ঘোষণা পর্বতারোহণ মহলে ছড়িয়ে পড়ল। নেপালি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ আর্মির এক্স গুর্খা সোলজার, নির্মল পূর্জা নামে এক ব্যক্তি মাত্র সাত মাসের মধ্যে ১৪ টি আট হাজার মিটারের চূড়া আরোহণের ‘প্রজেক্ট পসিবল’ পরিকল্পনা করছে। শুরুর দিকে অনেকেই বিষয়টাকে পাত্তাই দেয় নি। কারণ পরিকল্পনাটি এবসার্ড লাগছিল। মেসনারের এই গ্রান্ডস্ল্যাম শেষ করতে লেগে গিয়েছিল প্রায় ১৬ বছর। তার পরের জন আমার দৃষ্টিতে সর্বকালের সেরা পর্বতারোহী জার্জি কুকুজকার লেগেছিল প্রায় আট বছর। বর্তমানের রেকর্ড খুব সম্ভবত সাত বছরের। সেই জায়গায় এক ব্যক্তি বলল বছরও না মাত্র সাত মাসের মধ্যে সব আরোহণ শেষ করবেন, তখন সবার ভ্রু তো একটু কুচকাবেই।
আমরা এখানে বলছি আট হাজার মিটারের পর্বতশৃঙ্গের কথা। প্রতিটি চূড়ায় স্ট্যান্ডার্ড অভিযানে এক্লিমাটাইজেশন রোটেশন ও রুট ফিক্সিং মিলিয়ে কমবেশী দেড় থেকে দুই মাস সময় লেগে যায়। আর এক বছরে পর্বতারোহণের উপযোগী মৌসুম থাকে সবমিলিয়ে তিনটি। এখানে শীতকালীন অভিযানের মৌসুম বাদ দেয়া হচ্ছে।
এপ্রিল-মে (হিমালয়)
জুলাই-অগাস্ট (কারাকোরাম)
অক্টোবর-নভেম্বর (হিমালয়)
প্রতি মৌসুমে একটি করে চূড়া ধরলেও ১৪ টি শেষ করতে কমবেশী ৫ বছর লেগেই যাবার কথা। সেখানে কেউ কিভাবে মাত্র সাত মাসের মধ্যে এই পিকগুলো ক্লাইব করবে?
প্রথম প্রথম খটকা থাকলেও ‘প্রজেক্ট পসিবল’ যখন একে একে অন্নপূর্ণ, ধাউলাগিরি, কাঞ্চনজঙ্ঘার মত চূড়া মাত্র দিন কয়েকের ব্যবধানে আরোহণ করে ফেলল তখন সবাই নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হল। এর মধ্যে আবার কাঞ্চনজঙ্ঘায় কোলকাতার আহত দুজন আরোহীকে উদ্ধার করার চেষ্টা নির্মল পূর্জা ও তার প্রজেক্ট পসিবলকে আমাদের নজরে নিয়ে আসে। এরপর এভারেস্ট আরোহণের পথে নির্মল পূর্জার তোলা হিলারি স্টেপের কাছে বিশাল ট্রাফিক জ্যামের ছবি সোশাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে উঠলে আন্তর্জাতিক মিডিয়াগুলোতেও তার নাম আসা শুরু হয়।
তার বোল্ড, সেল্ফ ইন্সপায়ারিং মোটিভেশনাল
কথাবার্তা, পিঠের বিশাল ট্যাটু, ফিজিক আর একটা মডারেট ডিজিটাল মার্কেটিং ক্যাম্পেইন তাকে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের মধ্যে সুপার হিরোর আসনে বসিয়ে দেয়। পাকিস্তানের দ্বিতীয় ফেইজে নাঙ্গা পর্বত, গাশেরব্রাম ১, গাশেরব্রাম ২ আরোহণের পর ইতোমধ্যে নির্মল পূর্জা জাস্ট ৩ মাসের মাথায় ৯ টি পিক ক্লাইম্ব করে ফেলেছে। আমাদের রেসপন্স হল- ওহহহহ…দিজ গাই ক্যান ডু ইম্পসিবল স্ট্যাফস, নির্মল পূর্জা ইজ আওয়ার নিউ সুপার ম্যান।
তিন. চতুর্থ প্রজন্মের মিডিয়া হাইপ
বর্তমান পৃথিবীর ভাগ্য অনেকটাই মিডিয়ার হাতে। গোয়েবলস থেকে শুরু করে রুপার্ট মারডক সবারই চিন্তা থাকে কিভাবে ইনফরমেশন দিয়ে জনতাকে প্রয়োজনমাফিক ম্যানিপুলেট করতে হয়। আর এখন তো এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই কাজটি আরও অনেক বেশী সহজ। এখন পাঠকরাও আরও নতুন পাঠক ও কনজিউমার তৈরীতে প্রতক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে।
সবাই নির্মল পূর্জার অসামান্য ক্লাইম্ব নিয়ে মেতে আছে। কিন্তু সবার ধারনাই একেবারে ভাসা ভাসা। সবাই জানছে সে এই এই পিক দ্রুততার সাথে ক্লাইম্ব করেছে কিন্তু এটা তলিয়ে দেখছে না কিভাবে এই ক্লাইম্বগুলো করছে। সবচাইতে দুঃখের ব্যাপার হল সে যে একটা অতুলনীয় টিমের সাহায্যে এই রেকর্ডগুলো করতে পারছে মিডিয়াতে এই তথ্যের ছিটে ফোটাও পাওয়া যায় না। কেউ যদি উল্লেখ করেও তাও দায়সারাভাবে নিচে একলাইন লিখে দেয়, এরা এরাও নির্মল পূর্জার সাথে ছিল। এজ ইফ…
আসল কাহিনী হচ্ছে নির্মল পূর্জা একা একা এই প্রজেক্ট পসিবল করছে না। সে তার এই প্রজেক্টের জন্য কয়েকজন অতুলনীয়, সুপারফিট, সুপার ডুপার স্কিলড মাউন্টেইন গাইড হায়ার করেছে। এদের মধ্যে দুজন শেরপা ও একজন তামাং আছেন। নির্মল পূর্জা নিজে একজন গুর্খা। এরা হলেন মিংমা ডেভিড শেরপা, গিয়ালজেন শেরপা, গেসমান তামাং। অন্নপূর্ণা থেকে গাশেরব্রাম ২ পর্যন্ত, প্রজেক্ট পসিবলের প্রতিটি ক্লাইম্ব লিড করেছে মিংমা ডেভিড শেরপা। কোমর সমান বরফে প্রথমে রুট ওপেন করা, রুট ফিক্সিংয়ের মত জটিল কাজগুলো এই টিম মিলেই করেছে। রেস্কিউ অপরেশনগুলোয় (অন্নপূর্না ও কাঞ্চনজঙ্ঘ) নির্মল পূর্জার সাথে এই টিম ও ছিল, কিন্তু মিডিয়ার কল্যানে প্রেজেক্টের হায়ার্ড কামলারা কোন পাত্তাই পাচ্ছে না।
অদ্রি থেকে সদ্য প্রকাশিত @এভারেস্ট বইটি যদি কেউ পড়ে থাকেন তাহলে দেখবেন সেখানে এই বিষয়ক একটি নিবন্ধ আছে। সৌখিন পর্বতারোহীরা, বা কমার্সিয়াল এক্সপিডিশনে যোগ দেয়া পর্বতারোহীরা নিজেদের বীরত্বের কথা যখন বলেন তখন তাদের সাহায্যকারী, কিছুক্ষেত্রে নিজেদের ঘাড়ে করেও যাদের সামিট করিয়ে আনেন সেই মাউন্টেইন গাইডদের উল্লেখ পর্যন্ত করেন না। আর মিডিয়াগুলোও অদ্ভুত কারণে তাদের নাম চেপে যায়। এজ ইফ এরা হায়ার করা কামলা মাত্র, এরা কেন পর্বতারোহী হতে যাবে।
আমার চারপাশেও দেখছি নির্মল পূর্জার স্থুতি চলছে দিকে দিকে। বাট ওর সাথে যারা ক্লাইম্ব করেছে, প্রজেক্ট পসিবলের ক্লাইম্বগুলো যারা লিড করেছে তাদের কোন ছবি, ভিডিও, তথ্য, গল্প নির্মল ও দেন না, আমরা যারা অডিয়েন্স আছি তারাও জানতে চাই না।
ব্যাপারটা খুব দুঃখজনক!
চার. পর্বতারোহণে নতুন কি যোগ হচ্ছে?
এককথায় বলে দেয়া যায় কিচ্ছু না। এই প্রজেক্ট পর্বতারোহণে নতুন কিছু যোগ করছে না। সময়ের কারণে সো কলড রেকর্ড হয়ত ভেঙে যাবে কিন্তু এর ফলে মাউন্টেনিয়ারিংয়ের কোন লাভ হবে না।
মেসনারের মত এই প্রজেক্টের কেউই সাপ্লিমেন্টারী অক্সিজেন ছাড়া ক্লাইম্ব করছে না। নির্মল পূর্জা অক্সিজেন সিলিন্ডার ইউজ করছে তার প্রতিটি ক্লাইম্বে।
আবার জার্জির মত এই ১৪টি চূড়া সে ভিন্ন ভিন্ন বা নতুন রুটে বা শীতকালের দূরহ মৌসুমেও ক্লাইম্ব করছে না। নির্মল পূর্জা সবগুলো চূড়ায় প্রচলিত পথে আরোহণ করছে।
নির্মল পূর্জা আল্পাইন স্টাইলেও ক্লাইম্ব করছে না।
মাউন্টেনিয়ারিং এর মধ্যে সবচাইতে চমৎকার যেই এসপেক্টটি রয়েছে সেটি হল নান্দনিকতা, এই প্রজেক্টে নান্দনিকতাটাই মিসিং।
প্রজেক্ট পসিবলের মধ্যে আমি নতুন কিছু, বৈচিত্র্যময় কিছু দেখছি না।
হ্যা, প্রজেক্ট পসিবলের সাথে জড়িত প্রত্যেকেই একেকজন সুপার এথলিট। তারা নিজেদের ট্রেইন করে এমন এক জায়গায় নিয়ে গেছেন যেখানে সাধারণ মানুষ পরিবেশের বৈরীতায় বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। তারপরেও মনে রাখতে হবে তারা ডেথজোনে সাপ্লিমেন্টারী অক্সিজেন ব্যবহার করছে। এতে তাদের বেইন সেলের ড্যামেজ বলতে গেলে হচ্ছেই না।
ট্রেইনিং, সুপার হিউম্যান স্ট্রেন্থ আর এনডিউরেন্স ডেভেলাপমেন্টের ক্ষেত্রে এই প্রজেক্ট অবশ্য অনেককেই নিজেকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উৎসাহ যোগাব। বাট ইন টার্মস অফ মাউন্টেনিয়ারি, দিজ প্রজেক্ট ওন্ট এড এনি ভ্যালু।
পাঁচ. ইম্প্যাক্ট
আমার কাছে মাউন্টেনিয়ারিং আর্ট, সায়েন্স আর এথলেটিসিজমের একটা জগাখিচুরি। যেখানে এর আর্টিস্টিক ভাবটাই আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করে। এর মধ্যে ফিলোসফিক্যাল ব্যাপারটি এতটাই গভীরভাবে প্রোথিত যে খুব র্যাশিওনালি দেখার কোন সুযোগ নাই। তারপরেও মনে হয় নির্মল পূর্জা আমাদের উপর একটা নেগেটিভ ইম্প্যাক্ট ফেলবে। একধরনের কম্পেটিটর ভাব আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়বে। সবাই হয়ত ভাববে, মাউন্টেনিয়ারিংয়ের মধ্যে সামিট করাটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, বাই হুক বাই ক্রুক- এখন যেভাবেই, যে পথেই তা হোক না কেন। এই পথে চলতে থাকলে আমাদের মধ্যে কখনোই সেই নান্দনিকতা ডেভেলাপ করবে না।
হেলিকপ্টার ব্যবহার করে, হাইটেক গিয়ার, ও ফিটনেস প্রোগ্রামের কল্যানে, হাইটেক ওয়েদার ফোরকাস্ট ও ড্যাম গুড মাউন্টেইন গাইডদের প্রত্যক্ষ সহযোগীতায়, সাত মাসে ১৪ টি চূড়া আরোহণ হয়ত এখন আর অলীক কল্পনা নয়। এবছরই হয়ত রেকর্ড হয়ে যাবে। কিন্তু তাতে মেসনার বা জার্জি কুকুজকার এচিভমেন্ট বা নান্দনিকতার সাথে তুলনা করার কোন সুযোগই নেই। আর এটাই হচ্ছে আমার হতাশা। এই প্রজন্ম জানবে এক অতিমানব সব রেকর্ড ভেঙ্গে চুড়ে দিয়েছে।
খেয়ে দিলাম, মেরে দিলাম, কোপায় দিলাম…এখনই আমাদের অনেকের মধ্যে পাহাড় পর্বত নিয়ে এই ধরনের মনোভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। নির্মল পূর্জার কার্যক্রম ও তার হিরোইজমের বন্দনা, তাদের এই মনোভাবকেই বৈধতা দিবে এটাই যা হতাশাজনক।
পপুলার বিলিফের সম্পূর্ণ বিপরীতে গিয়ে কথাগুলো বললাম। আশা করি, স্রোতের সাথে জাস্ট গা ভাসিয়ে না দিয়ে আমরা সবাই একটু গভীরে গিয়ে ভাবার চেষ্টা করব।