এবারের ঈদ বাসার সবার জন্য অনেক স্পেশাল ছিল। এবারের ঈদে আমি বাসায় ছিলাম বলে না, বহু দিন পর পুরো পরিবার আবার এক ছাদের নিচে আসলাম তাই। কতদিন পর পুরো বাড়ি মানুষে মানুষে গম গম করছে, চারিদিকে হৈ চৈ চিল্লাচিল্লি…. জাস্ট লাইক দ্যা ওল্ড টাইমস।
ঈদের আগের দিন থেকেই আম্মুর শরীর ভাল যাচ্ছিল না। নতুন বাসার ধুলাবালি থেকে তার শ্বাস কষ্ট হচ্ছিল। মরার উপর খাড়ার ঘার মত হাটুর পুরনো ব্যথাটিও ফিরে এসেছিল। তার এই হাটুর ব্যথাটি খুবই অদ্ভুত ধরনের। এই রোগের নাম ‘রেস্টলেস লেগ সিন্ড্রোম’। এই রোগের উপসর্গ হল দুই পায়ে অসংখ্য পোকা কিলবিল করার মত অসহ্যকর এক ধরনের সেনসেশন হয়।
পা যখন রেস্টে থাকে তখনই এই সেন্সেশন সর্বোচ্চ পর্যায়ে চলে যায়। এর মানে হচ্ছে এই সিন্ড্রোমের রোগী তার দুই পা কে রেস্টে রাখতে পারে না। অসহ্যকর এই অনুভূতি থেকে বাঁচতে তাদের দুই পা নাড়িয়ে যেতে হয়। এমনকি ঘুমের মধ্যেও নিস্তার নেই। রাতে ঘুমাতে পারে না বলে তারা বাজে রকমের ইনসমনিয়ায় আক্রান্ত হয়। রাত তিন হোক বা চার টা রোজই আম্মুকে দেখি ঘরের এদিক সেদিক অযথাই সে হেঁটে বেড়াচ্ছে।
ঈদের তিনদিন পর আম্মুর শরীর আরও খারাপ হয়ে গেল। খারাপ হয়ে গেল বলতে একেবারে বিছানায় পড়ে গেল। প্রেশার লো হয়ে মাথা ঘুরে গিয়ে যাচ্ছেতাই অবস্থা। এর মধ্যে আপিও কিশোরগঞ্জ থেকে বাসায় চলে এল। সেই সাথে এল আম্মুর তীব্র জ্বর। আমাদের জন্য আম্মুর এমন অসুস্থতা একেবারেই নতুন। আব্বুকে অসুস্থ অবস্থায় দেখে অভ্যস্ত আমরা আম্মুর দৃঢ়তা দেখে ভাবতাম আমার মা ইনভিন্সিবল। সে তো আছেই, তার কিছুই হতে পারে না।
গত বৃহস্পতিবার বাসার ছাদে আমাদের ভাই বোনদের চড়ুইভাতির অনুষ্ঠান ছিল। এই উপলক্ষ্যে চাদা টাদা তুলে বাজার সদাই রান্না বাড়ি নিয়ে পুরো বাড়ি ছিল সরগরম। আজকাল এসব গেদারিং ভাল্লাগে না বলে আমি আর এসবে যাই নাই। সারাদিন ঘরেই বসে ছিলাম। রাত সাড়ে এগারটার দিকে আম্মুর শরীর আরও খারাপ হয়ে গেল। জ্বর বেড়ে হয়ে গেল ১০৩। প্রেশার নেমে গেল ৯০/৬০ এ। আমি তখনই ওষুধ আনার জন্য বেড়িয়ে পড়লাম।
সেদিন ছিল আবার আর্জেন্টিনার খেলা। রাত দুইটা তিনটা বাজেও যেই শহর ঘুমায় না তা আজ সাড়ে এগারতেই সুনসান হয়ে গেছে। আধা ঘন্টা লাগিয়ে পুরো শহর চক্কর দিয়ে হাসপাতাল থেকে ওষুধ নিয়ে আসলাম। পাঁচ তলায় লিফট থেকে নামতেই দেখি ঘরের সামনে অনেক অনেক স্যান্ডাল রাখা। প্রথমে ভেবেছিলাম ভুল করে বুঝি ছাদে চলে গেছি। আসলে বাসার সবাই আমাদের ঘরে চলে আসছে। সবার মুখ থমথমে। ধীর পায়ে আম্মুর ঘরে গিয়ে একেবারে স্টানড হয়ে গেলাম। আমার বোনেরা, ভাবিরা, চাচিরা সবাই দোয়া দুরুদ পড়তেসে, আম্মুর পুরো শরীর ভয়ঙ্করভাবে কাঁপতেসে, শরীর ঠান্ডা হয়ে ফ্যাঁকাসে হয়ে আসছে আর আম্মু বুক খামচে ধরে হা করে নিঃশ্বাস নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এরপরে পনের মিনিট খুব দ্রুত কেটে গেল। বাসায় এম্বুলেন্স চলে আসল। আমরা হাসপাতালে চলে গেলাম। জীবন মৃত্যুর সাথে ফয়সালা করতে আম্মু চলে গেল আইসিইউ তে। আমাদের জন্য শুরু হল এক দীর্ঘ অপেক্ষার পালা। বসে বসে শুধু ভাবছিলাম আমাদের চোখের সামনে কিভাবে তার নিউমোনিয়া একিউট আকার নিতে পারে। সেই নিউমোনিয়া থেকে সেপটোসেমিয়া হয়ে কিভাবে রেসপিরেটরি ফেইলিউর হতে পারে।
অনেক ভেবে বের করলাম আমার মা ঠিক আমার মতই। নাকি আমিই অনেকটা মায়ের মত। নিজের কোন সমস্যা অন্য কেউ জানুক ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হয় না। সে এখন যতই আপন হোক না কেন। কিছু হলে বাবা, মা, ভাই, বোন কাউকেই কিছু বলতে ইচ্ছা করে না। বরং সবার থেকে লুকিয়ে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করি। আমার চরিত্রের এই ব্যাপারটি কই থেকে আসছে এতদিন পর বুঝতে পারলাম। তার যে শ্বাস নিতে এত কষ্ট হচ্ছে, বুকে ব্যথা করছে এসব ঘুনাক্ষরেও আমাদের বুঝতে দিতে চায়নি। আর আমরাও বোকার মত ভেবে গেছি পায়ের ব্যথার জন্যই বুঝি আম্মু বিছানায় শুয়ে আছে।
কে জানে এসব হাবিজাবি কেন লিখতেসি। আসলে কিছু করার পাচ্ছি না। সময় কাটানোর জন্য কিছু তো একটা করা দরকার। আম্মুর অবস্থা নিজ চোখে দেখতেও পারতেসি না। শুধু সকাল বিকাল দুইবেলা তার একটু খবর পাওয়ার দীর্ঘ প্রতীক্ষা….
২৩/৬/১৮
…..আম্মু এখন কিছুটা সুস্থ আছে। সবাই দোয়া করবেন।