পাহাড়ের ভয়

প্রকৃতি পাহাড় পর্বতকে এমনভাবেই ডিজাইন করেছে যেখানে জেনেটিক্যালি আরামপ্রিয় মানুষ কিছুতেই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে পারে না। যারাই এখানে বসবাস করে তাদের প্রতিটা মুহুর্ত প্রকৃতির সাথে টিকে থাকার সংগ্রামে ব্যয় করতে হয়।

আর অন্যদিকে আছি আমি। সমতলের নিশ্চিত প্রিভিলেজড জীবন ছেড়ে, রোমাঞ্চ আর রোমান্টিসিজমের খোঁজে অনাহুতের মত পাহাড় পর্বতের সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার জোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। এই পাহাড় পর্বত কত যে ভাবনা মাথায় জন্ম দেয় তার ইয়ত্তা নেই কোন। প্রতিবার নতুন কিছুর সন্ধান পাই। প্রতিবার মনে হয় আমি নিগূঢ় সত্যের খুব কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। চাওয়া পাওয়ার শিকল ভেঙে প্রতিবারই মনে হয় মুক্ত হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে গেছি। প্রতিবারই মনে হয় স্টারগেট খুলে গেছে, আমি অন্য কোন ডাইমেনশনে ঢুকে গেছি প্রায়। পরক্ষণেই সেই সংযোগ ছুটে যায়। জানি এসবই একটি ভ্রান্তি, আমার অলীক কল্পনা বই কিছু না।

এখানে শুধু একটি অনুভূতিই শুধু সত্য। সেটা হচ্ছে ভয়। এই পথে প্রতি পদে পদে বিপদ ওত পেতে আছে। এখানে ছোট্ট একটা ভুলের মাশুল জীবনের বিনিময়ে দিতে হয়। সবসময় যে ভুল থেকে বিপদ আসে এমনও নয়। স্রেফ ভাগ্যের ফেরে কেউ ভুল সময়ে ভুল জায়গায় থাকতে পারে।

তুষার ঢাকা প্রায় সমতল হিমবাহের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ পায়ের নিচে মাটি সরে গিয়ে কেউ ক্রেভাসের অতল অন্ধকার গহ্বরে চিরদিনের মত হাঁরিয়ে যেতে পারে। সবাই জো সিম্পসনের মত ভাগ্যবান হয় না। ভাঙা পা নিয়ে ক্রেভাসে পড়ে গিয়েও যে নিজের প্রচেষ্টায় সেখান থেকে বের হয়ে আসবে। কেউ কেউ পেম্বার মত দূর্ভাগা হয়, যে এত এত অভিজ্ঞতা আর পর্বতারোহণের দক্ষতা নিয়েও সামিট থেকে ফেরার পথে বেইজক্যাম্পের ঠিক সামনে এসে হাঁরিয়ে যায়।

হঠাৎ করে পাহাড়ের দেয়াল মাথার উপর ভেঙে পড়ে। বড় বড় পাথর আর বরফের চাঙ্ক শরীরকে দুরমুশের মত পিষে দিয়ে বেড়িয়ে যায়, কেউ টু শব্দটিও করার সুযোগ পায় না। বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট সাইক্লোনের প্রভাবে অন্নপূর্ণার রেইন শ্যাডো এলাকায় ভারী তুষারপাত হয়। তুষারের পাইল জমতে জমতে একসময় ভেঙে পড়ে, জ্যান্ত কবর দিয়ে দেয় পায় চল্লিশজনকে।

এত এত বিপদের মধ্যে সবচেয়ে বিশ্বাসঘাতক বোধ হয় অল্টিটিউড সিকনেস। এর কোন গতি প্রকৃতি নাই, কোন সুনির্দিষ্ট নিয়মনীতি এটি মেনে চলে না। যতই এর সম্পর্কে জেনে থাকেন, পড়ে থাকেন না কেন, এটি কখন কোন পরিস্থিতে আপনাকে কাবু করে ফেলবে সেটি হয়ত বুঝতেও পারবেন না। হালকা মাথা ব্যথা দিয়ে শুরু হবে, এরপর খেতে ইচ্ছা করবে না, পেট মোচড়াবে। ধীরে ধীরে এসব বাড়তেই থাকবে। তখন আপনি নিজের সাথেই ছলনার যুদ্ধে নামবেন। সামিটের হাতছানির সাথে পেরে না উঠলে আপনার নিজের শরীরের পানি ফুসফুসে চলে আসবে। তার কিছুক্ষণের মধ্যে সেই পানি আপনার মাথাতেও চলে যাবে। আপনি একফোটা পানিতে না নেমেও নিজের শরীরের পানিতে ডুবে মারা যাবেন।

এরপর আছে ফ্রস্টবাইট। যেখানে হাত পায়ের আঙুল প্রথমে অসাড় হয়ে আসে। ধীরে ধীরে আঙুলের আগার শিরা উপশিরাগুলো কুচকে রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। অক্সিজেনের অভাবে এই জায়গাগুলোর টিস্যু মরতে থাকে। জায়গাটা হালকা গোলাপি লাল থেকে ধীরে ধীরে বেগুনী এরপর কালো হয়ে যায়। কিছুদিন আগেই কোলকাতার কয়েকজন তরুনের ফ্রস্ট বিটেন আঙুল দেখলাম। খুবই ভয়াবহ। এগুলো এখন কেটে ফেলতে হবে। আজীবন তাদের আঙুলের সাহায্য ছাড়াই বেচে থাকতে হবে।

স্নো ব্লাইন্ডনেসের গল্পটা এখনো বলিনি কাউকে। এটি যে কতটা নির্মম আর অসহ্যকর হতে পারে সেটা কখনোই বুঝানো যাবে না। কেউ এই ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাক সেটাও আমি চাইতে পারি না। হুট করেই যদি টের পান আপনি চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছেন না, কেমন লাগবে তখন? তাও আবার পর্বতে, সম্পূর্ণ একা? চোখ খোলার চেষ্টা করলেই অসংখ্য ছোট ছোট উজ্জ্বল সূর্য ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। সেই ঝলসে দেয়া আলোকরশ্মি খুব বেশীক্ষণ সহ্য করার সাধ্য নেই কার। সেই সাথে অসংখ্য সুই যখন অবিরতভাবে চোখে খুঁচিয়ে যেতে থাকে তখন মনে হয় চোখ দুটা উপড়ে ফেললেই বুঝি এই যন্ত্রনা থেকে মুক্তি মিলবে।

সেদিন রিফাত ভাই ইন্ডিয়ান একটি দলের গল্প করছিল। খুব সম্ভবত নীলকন্ঠ অভিযানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল। দুই নম্বর ক্যাম্প সেট করে অকুপাই করার পরপরই আবহাওয়া খারাপ হয়ে যায়। টানা তুষারপাত হতে থাকে। এই পরিস্থিতিতে তারা সেখানেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নেয়। পরদিনও তারা তাবু থেকে বের হতে পারে না। রাতের দিকেও আবহাওয়া পরিষ্কার না হওয়ায় তারা পাঁচজন একই তাবুতে চলে আসে। একই তাবুতে সবাই মিলে থাকলে ওম থাকবে এটাই ছিল তাদের ভাবনা। বেশ কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর তাদের উদ্ধারে যাওয়া সার্চ এন্ড রেস্কিউ টিম যখন তুষার খুড়ে তাদের তাবু বের করল তখন চেইন খুলে দেখা গেল পাচ জন ঠিক তেমনভাবেই ঠায় বসে আছে। কয়েকজন তাবুর ছাদের হাত ঠেকিয়ে রেখেছে যেন সেটা ভেঙে না পড়ে। এতই তুষার পড়েছিল সেদিন যে তাদের তাবু আপাদমস্তক ঢেকে দিয়েছিল। সেই পাঁচজন আরোহী দম আটকে মারা গিয়েছিল।

আমি নিজেকে অকুতোভয়, দুঃসাহসিক, বীর অভিযাত্রী হিসেবে ভাবতেও ভয় পাই। কারণ এটা মোটেও সত্য নয়। আমি প্রতিমুহূর্তেই ভয়ে ভয়ে থাকি। আমি আমার নিজের চাইতেও বেশী ভয়ে থাকি আমার সাথে থাকা মানুষদের নিয়ে। এই ভয় ভয়াবহ রকমের এক মানসিক চাপ। আমি জানি না এমন অভিযানে পাশে থাকা সঙ্গী চিরদিনের মত হারিয়ে গেলে সেই দায় কিভাবে কেউ কাটিয়ে উঠে। চারপাশে তাকিয়ে যখন শুধু রক্ত, ক্ষত বিক্ষত লাশ, ভেঙে যাওয়া খুলি থেকে বেড়িয়ে আসা নিথর ফ্যাকাশে সাদা ঘিলুর পাশে শুয়ে জীবিত কেউ কি নিজেকে ভাগ্যবান ভাবতে পারে? ছোট একটা মশা কত শক্ত সামর্থ্য এক পুরুষকে ঘায়েল করে ফেলে। শেষ মুহুর্তে মুখ দিয়ে ভক ভক বের হওয়া কালচে লাল রক্ত দেখার সেই মুহুর্ত কি কেউ কখনও ভুলতে পারে?

সেদিনও বলছিলাম আমি কোন স্বপ্নই দেখি না, দুঃস্বপ্ন তো পরের কথা। এটাও আসলে নিজের সাথে একটা প্রতারণা। ভিতর থেকে যখন ফিসফিস করে কেউ বলে উঠে তুমি অভিশপ্, তোমার সাথে থাকা সবার জীবন তছনছ হয়ে যাবে। এরপরও তুমি সেই সাবধানবানী উপেক্ষা করে এগিয়ে যাও। ঠাট্টার ছলে এই সাবধানবানীর কথা সঙ্গীকেও জানাও। দেখ এবার কিন্তু কুফা লেগে গেছে, ভালভাবে ভেবে দেখ যাবি কিনা। কিছু হলে কিন্তু আমি জানি না।

আর সেই অভিযানেই সঙ্গীকে চোখের সামনে ৩০ ফিট উপর থেকে পাথরের উপর আছড়ে পড়তে দেখার পরেও কি কেউ সেই ফিসফিসানি উপেক্ষা করার শক্তি রাখে? এখনো মাঝে মাঝে আমি সেই দৃশ্য দেখি। নিথর হয়ে তার শরীরের পাথরের উপর পড়ে আছে। কোন সাড়া শব্দ নেই। উপরে আমি পাগলের মত নিচে নামার পথ খুজে বেড়াচ্ছি। আর মনে মনে আউড়ে যাচ্ছি, মরিস না প্লিজ। এইবার মরিস না। আমি চাই না কেউ বলুক আমার সাথে তোর পরিচয় না হলেই বুঝি ভাল হত।

এমন না যে আমি কুসংস্কারে বিশ্বাসী বা মাত্রাতিরিক্ত আবেগপ্রবণ যা মানসিকভাবে আমাকে দূর্বল করে দেয়। কিন্তু এটাও ঠিক আমি আমার ইন্টিউশনকেও এখন আর উপেক্ষা করতে পারি না। কোলকাতার বসে দুই পাড় মাতাল খুব সিরিয়াস হয়ে আমাকে বলেছিল, তুই সাথে থাকিস বা না থাকিস তোর দেশ থেকে পাহাড়ে গিয়ে যদি কোন দূর্ঘটনা ঘটে তাহলে এর দায় তোর উপরও খানিকটা বর্তাবে। এন্ড ইউ কান্ট ডিনাই দ্যাট।

এই কথার লজিক্যাল কোন ভিত্তি নেই সেটা আমিও জানি। তবুও, খারাপ কিছু ঘটলে বিন্দুমাত্র খচখচানি কি থাকবে না সেখানে? ইন্সপায়ার, ইনফ্লুয়েন্স বা প্রভোক- যাই বলি না কেন বিন্দু পরিমান হলেও আমি কি কোন অবদান রাখছি না এতে?

এত কিছুর পরেও পাহাড়ের প্রতি সেই আকর্ষণ কিন্তু বিন্দুমাত্র কমেনি। বরং সেটা দিন দিন বেড়েই যাচ্ছে। আর এই মানসিক দূর্বলতাগুলো কাটিয়ে উঠার জন্য আমার মস্তিষ্ক কাউন্টার মেজার হিসেবে আমাকে মানুষের সংস্পর্শ থেকে দিন দিন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ভিড়ের মধ্যে এখন নিজেকে ভারনারেবল লাগে। উপভোগ করা দূরের কথা উলটো অস্বস্তি লাগে। এইসবের উত্তর খোঁজায় আসলে কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। এই ধাধা সলভ করতে চাইলে আমাকে একাই এই পথে হাঁটতে হবে।

কোন কিছু মিলবে না জানার পরেও সেই আলেয়ার পিছনে ছুটে যাওয়া। এ কারণেই বুঝি পর্বতারোহণকে কোন কোন বিজ্ঞানী সাইকোনিউরোটিক টেন্ডেন্সি বলে অবিহিত করে থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!