শিকড়

পরশু একজনের পোস্ট দেখে একটা বই নিয়ে কিছু ভাবনা না লিখে পারলাম না। এই লেখাকে কোনভাবেই বুক রিভিউ পর্যায়ে ফেলা যাবে না। এই ধরণের বই পড়ে মোটা দাগে ভালো লেগেছে বা খারাপ লেগেছে বলারও কোন উপায় নেই। তাই এটা স্রেফ বইটি পড়ে মাথায় আসা কিছু এলোমেলো ভাবনা!

প্রথমেই ফেসবুকের পোস্টটি নিয়ে কিছু বলা যাক , তাহলে আলোচনার কনটেক্সটগুলো বুঝাতে সুবিধা হবে। সেদিন ফেসবুকে দেখা প্রথম পোস্টটি নিজাম ভাইয়ের। বহু বছর ধরে উনি বান্দরবানের কানাচে কানাচে ঘুরে বেরান, পাহাড়ে সমাজসেবামূলক কাজ করেন। আমার ধারণা এমন খুব কম পাড়া পাওয়া যাবে যেখানে কারবারির ঘরে তার প্রিন্ট করা ছবি নাই। খ্রিষ্টান পাড়ারগুলোতে জিসাসের সাথে সাথে নিজাম ভাইয়ের উপস্থিতিও পাওয়া যাবে।

উনি আজকে প্রাংজং পাড়া নিয়ে একটি তথ্যবহুল পোস্ট দিয়েছেন। রাইক্ষ্যং হ্রদের পূর্ব পাড়ে অবস্থিত এই ত্রিপুরা পাড়াটির একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস লিখেছেন। এই পাড়ার লোকজন আগে কোথায় ছিল, কত সালে এখানে পাড়া স্থাপন হয়েছে, সচরাচর সাধারণ পর্যটকদের এই সকল তথ্যের বিষয়ে আগ্রহের বালাই থাকে না। কিন্তু আমাকে আবার পাহাড়ের মেঘ ঝর্ণা ঝিরির চাইতে এই তথ্যগুলোই বেশী আকর্ষণ করে।

প্রাংজং পাড়ার কথাই ধরা যাক। ১৯৮০ সালের আগে রাইক্ষ্যং বেসিন প্রায় পুরোটাই ছিল রিজার্ভ। এখানে সেইভাবে কোন মানববসতি ছিল না। সত্তর দশকে এই বিশাল বর্ডার অংশ জুড়ে ছিল ইনসার্জেন্সিদের প্রতাপ। দেশি বিদেশী বিদ্রোহীদের জন্য একটি সেইফ হাউজ। আশির দশকে বাংলাদেশ সরকার এই সুবিশাল অরক্ষিত অঞ্চলকে নিজেদের গ্রিপে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই বড়থলি ও পুকুর পাড়ার মত আর্মি ক্যাম্প এই দুর্গম জায়গায় স্থাপন করা হয়। মজার বিষয় হল, পাহাড়ের জাতিগুলো ইনট্রিনসিকলি মাইগ্রেটরি। তাদের স্বাভাবিক জীবনধারার জন্যই তাদের এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় অভিবাসন করতে হয়। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় তাদের এই শিফট হওয়ার কারণ পুরোটাই তাদের জুম নির্ভর জীবনব্যবস্থা। ৯, ৫ থেকে কমতে কমতে এখন ৩ বছরে এসে ঠেকা জুমের চক্রের জন্য তাদের এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে যেতেই হয়। পাড়ার জনসংখ্যা বেড়ে যায়, জুম উপযোগী পাহারি ঢাল কমে যায়, খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয় ইত্যাদি নানা কারণে তারা মাইগ্রেট করে। কিন্তু রাইক্ষ্যং বেসিন ও অন্যান্য আরও অনেক জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সুবিধার কারণে এই ধরণের নতুন পাড়া স্থাপন ঠিক ন্যাচেরাল মাইগ্রেশনের মধ্যে পড়ে না, একে ফোর্সড মাইগ্রেশন বলাই যথাযথ হবে।

এক পাড়া থেকে আরেকটি পাড়া সম্পূর্ন নতুনভাবে স্থাপন করা কি খুব সহজ একটা কাজ? শহরে আমরা যখন বাসা পাল্টাই তখনকার মত কি বিষয়টা? যে সব গোছগাছ করলাম, বাক্স পেটরা, থাল বাসন গুছালাম, খাট ভেঙে পার্ট বাই পার্ট আলাদা করে ফেললাম, এরপর পিক আপ ডাক লাক, কামলাদের দিয়ে সব ট্রাকে উঠিয়ে নতুন বাসায় নিয়ে গেলাম, এরপর আবার গোছগাছ- বাসা পাল্টানো শেষ? আমি শিওর যাদেরই এভাবে বাসা পাল্টানোর অভিজ্ঞতা আছে তারা সবাই স্বীকার করবেন এই পুরো প্রক্রিয়াটির মত হেকটিক এক্সপেরিয়েন্স আর হয় না। শহরে প্রতিবার বাসা পাল্টালে আমার মতে পাঁচ বছর হায়াত কমে যায়। পাহাড়ে নতুন একটি পাড়া গঠন কি শহরের বাসা পাল্টানোর মতই একটি প্রক্রিয়া?

এটা আসলে আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু না। আমাদের পাহাড়গুলোতে কিভাবে আর কোন প্রক্রিয়ায় নতুন একটি পাড়া গড়ে উঠে সেটিই আমার কৌতুহল। পাহাড়িদের কাছে কিন্তু আধুনিক কোন যন্ত্রপাতি নেই, নেই আমিনশীপের কোর্স করা কোন সার্ভেয়ার, তারা কোন মানচিত্র ব্যবহার করে না। তাদের আছে শুধু ছয়টি ইন্দ্রিয়, এগুলোই তাদের হাতিয়ার। নতুন পাড়ার গোড়া পত্তন হয় মূলত কোন ভবঘুরে, সাহসী শিকারি বা ওয়ান্ডারারের হাত ধরে। পাড়া থেকে বহু দূর দূরান্ত পর্যন্ত তারা চলে যায়, কখনো শিকারের খোঁজে, কখনো বা শুধুই রোমাঞ্চের নেশায়।

যখনই তারা হেঁটে যায় তখনই তাদের ইন্দ্রিয়গুলো পুরোপুরি সজাগ হয়ে যায়। কোন শব্দ, কোন ঘ্রান তাদের মিস হয় না। পাথরের গঠন, নদীর বাঁক, পানির প্রবাহ, পাহাড়ের ঢাল, মাটির রঙ,গাছের প্রজাতি আর বনের ঘ্রান দেখেই তারা পুরো অঞ্চলের একটি চিত্র স্ক্যান করে তাদের মাথায় সেট করে নেয়। কোন পাহাড়ে জুম ভালো হবে, কোন ঝিরিতে সারা বছর পানি থাকবে, কিভাবে রাস্তা কাটলে পথটি সহজ হবে আবার প্রকৃতিরও ক্ষতি হবে না (খেয়াল করে দেখবেন পাহাড়ের পথগুলো বিশাল গাছের শিকড়কে কেন্দ্র করেই তৈরি করা হয়), পথ বানানোর জন্য তারা বৃক্ষ নিধন করে না, উল্টো বৃক্ষের শিকড়গুলো পোক্ত সিঁড়ির মত কাজ করে। কোথায় ঘর বাঁধলে চমৎকার আলো বাতাস পাওয়া যাবে- অর্থাৎ পুরো বাস্তুশাস্ত্র তাদের মাথায় সেট করা আছে।

পরবর্তীকালে যখন প্রয়োজন হয় তখন পাড়ার একজনের নেতৃত্বে কয়েকটি পরিবার ধিরে ধিরে ঐ জায়গাটিকে বসতি স্থাপনের জন্য তৈরি করা শুরু করে। মাটি কেটে পরিষ্কার করে, বাঁশ কেটে ঘর বাঁধে। প্রথমে বেসিক একটি ছোট ঘর বানিয়ে আগে শেল্টার নেয়, পরে ধীরে ধীরে সময় নিয়ে তৈরি করে তাদের অস্থায়ী আশিয়ানা। আশপাশে ফল ফুলের গাছ লাগাই কয়েক বছরের মধ্যে একটি পরিপূর্ণ পাড়ার রুপ নেয়। কয়েক বছর পর আবার এই পাড়ার পাট চুকিয়ে কেউ কেউ অন্য কোন পাহাড়ে, অন্য কোন অঞ্চলে মাইগ্রেট করে। এখানে মজার বিষয় হল এসব শেখানোর জন্য কিন্তু তাদের আলাদা কোন স্কুল কলেজ ফ্যাকাল্টি, ক্রেডিট, সিজিপিএ নেই। প্রকৃতির মাঝে টিকে থাকার প্রজ্ঞাগুলো তাদের মধ্যে বংশানুক্রমিকভাবে রিলে হতে থাকে। এই বিষয়টি নিয়ে বইয়ে বিস্তারিত লিখার ইচ্ছা আছে।

আরেকটি মজার বিষয় আমি খেয়াল করেছি পাড়াগুলোর এই ন্যাচেরাল মাইগ্রেশনগুলো চমৎকার একটি প্যাটার্ন ফলো করে। লুসাই পাহাড় থেকে নেমে আসা ব্যোমদের ক্ষেত্রে এই মাইগ্রেশনের প্যাটার্নটি খুব সুন্দরভসবে বুঝা যায়। ব্যোমরা প্রথমে রোয়াংছড়ির দিকে বসতি স্থাপন করেছিল। বান্দরবানের প্রাচীন পাড়াগুলোর একটি হল ফিয়াং বিদিয়াং, যা পরবর্তীতে রনিন পাড়া হয়ে যায়। এখান থেকে মাইগ্রেট হয়ে কিছু পাড়া রুমার মুন্নাম, আর্থার দিকে এসেছে আবার কিছু সুনসাং হয়ে থাইকিয়াং থিনদোলতের দিকে চলে গেছে। আবার কেওক্রাডংয়ের ঢালের সাইকত পাড়া থেকে কয়েক পরিবার বগা কাইনে নেমে এসেছে। মানচিত্রে তাদের এই অভিবাসনের চিত্রটি প্লট করলে গাছের শিকড়ের মত একটি প্যাটার্ন ভেসে উঠে। আমার কাছে এটি খুব অদ্ভুত মনে হয়েছে। শিরা উপশিরার মত ব্রাঞ্চ আউট কি তাঁরা ইচ্ছা করে করেন, এর পিছনে আদৌ বিশেষ কোন কারণ আছে কিনা আমি শিওর না। এর আদৌ হয়ত বৈজ্ঞানিক কোন ব্যখ্যা নেই, আর এত ছোট ডাটা সাইজ নিয়ে এই ধরণের কোন ডেফিনিট কনক্লুশনে পৌঁছানোও সম্ভব না।

আফ্রিকা থেকে শুরু করে পুরো পৃথিবীব্যাপী দীর্ঘ সময়কাল ধরে চলা মানবজাতির এমন বৈচিত্র্যময় প্রক্রিয়ায় ধারাবাহিকভাবে প্রসারিত হওয়ার কথা ভাবতে বসলে আমি আশ্চর্যচকিত হয়ে যাই। খেই হারিয়ে ফেলি। পাহাড়ে ঘুরে জীবনের এই বিস্তার নিজের চোখে না দেখলে এই অসম্ভব গভীর বিষয়টি আমি কখনো সেইভাবে উপলব্ধি করতাম না বোধ হয়। আমাদের গোড়ার কথা, আমাদের শিকড়ের সন্ধান করা এখন তাই নেশার মত হয়ে গেছে।

বেশ কয়েকদিন ধরে বান্দরবান নিয়ে আমি একটি বই লেখার চেষ্টা করছি। আসলে লিখছি কম পড়ছি বেশী। এই শিকড়ের সন্ধান করতে গিয়েই তথ্য সাগরের অতল গভীরতায় হারিয়ে যাচ্ছি। এক বই থেকে আরেক বই, এক তথ্য থেকে আরেক তথ্য, যেখানেই খোঁজ পাচ্ছি আমাদের পাহাড় নিয়ে কোথাও কিছু লেখা হয়েছে সেগুলো সংগ্রহ করে পড়ছি, নোট করছি। সেখান থেকেই হয়ত আবার নতুন কোন তথ্য বা উৎসের খোঁজ মিলছে- তথ্য ভান্ডারের এ এক দুষ্টচক্র- একবার এর ফাঁদে পড়ে গেলে আর উঠে যাবার জো নেই! মাঝে মাঝে আফসোস হয় এমন করে যদি স্কুল কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়তাম তাহলে হয়ত এখন গাড়ী ঘোড়া ,থাকত! আবার এখন যে এই পড়ালেখা করছি এরও জাগতিক কোন আউটকাম নেই, জাস্ট আমার মনের শান্তি! এরকমভাবেই খুঁজতে খুঁজতে আমি সন্ধান পাই চমৎকার এক বইয়ের; বইয়ের নামই হল শিকড়।

‘শিকড়’ বইটি লিখেছেন ড. মুহাম্মদ ইব্রাহীম। বিজ্ঞান নিয়ে যারা চর্চা করেন বা ছোটবেলায় বিটিভিতে লেখাপড়ার অনুষ্ঠানগুলো দেখতেন তারা হয়ত উনাকে চিনতে পারবেন। এটি মূলত একটি তাত্ত্বিক বই। তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে বইটি লেখা হয়েছে। মানবজাতির মাইগ্রেশনে জিন, জীবনধারা ও ভাষার প্রবাহের প্রভাবই এই বইয়ের মূল বিষয়বস্তু। সেলিব্রেটি লেখক ইউভাল নোয়াহ হারিরির জনপ্রিয় বই স্যাপিয়েন্স পড়ুয়াদের কাছে এই বইটি একই ধাচের মনে হতে পারে। দুটি বই-ই যেহেতু মানবজাতির ইতিহাস ও বিবর্তন বিষয়ক তাই এমনটি ভাবাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার কাছে বই দুটির জনরা এক হলেও, উপস্থাপনা ভিন্ন লেগেছে তারচেয়েও বড় কথা শিকড় বইটি স্যাপিয়েন্সের মত ব্রড স্পেকট্রামে লিখা হয়নি, বরং লিমিট ইন্টিগ্রাল হিসেবে অভিবাসনের গল্পটি আফ্রিকা থেকে শুরু করে নানা দেশ জাতি ঘুরে লেখকের জন্মস্থান চট্টগ্রামে এসে শেষ হয়েছে। আর এই বইটি খুঁজে বের করে পড়ে নেয়ার পিছনে এটাই ছিল মূল পয়েন্ট অফ ইন্টারেস্ট ।

বিজ্ঞান বলে আফ্রিকায় জ্ঞানী মানুষের উৎপত্তি, এটাই আমাদের গোঁড়া। এখান থেকে আমার পূর্বপুরুষ ও মায়েরা পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে- উত্তর আমেরিকা, দক্ষিন আমেরিকা, আন্দামান হয়ে ইন্দোনেশিয়া থেকে অস্ট্রেলিয়া, মাঝে এই ভারতবর্ষ। এরও কয়েক শতাব্দীকাল পর উত্তরের ভল্গা তীর থেকেও আরেকদল ধস্পে ধাপে মাইগ্রেট করে দক্ষিনে গঙ্গার পাড়ে এসে বসতি গেড়েছে। একটি উৎসমুখ থেকে মানুষের শিরা উপশিরার মত এই দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার সময় সে কিছু না কিছু চিহ্ন বা মার্কার রেখে গেছে, যেগুলো ট্রেস করে পিছনের পথে ঘুরে আসা যায়! লেখক এখানে এমন মূল তিনটি চিহ্ন বা মার্কার দিয়ে পুরো বইটি সাজিয়েছেন। একটি হল জেনেটিক্স, আরেকটি মেমেটিক্স ও তৃতীয়টি হল ভাষা।

আমার মনে হয় সবাই কোন এক সময় প্রশ্ন করে, এর আগে আমি বা আমার পরিবার কোথায় ছিল? এখন যেখানে থাকছি এর আগে কোথায় ছিলাম? আমার বাবা, আমার মা কোথায় ছিল? আমার দাদা, আমার নানার জন্মস্থানই বা কোথায়? এই নারায়ণগঞ্জ-এ মানুষ বসতি স্থাপন করল কবে? মানুষ্যহীন নারায়নগঞ্জ দেখতে কেমন ছিল? জেলা থেকে বিভাগ, বিভাগ থেকে দেশ…এভাবে পিছনে যেতে যেতে আমরা একটি উৎসে গিয়ে হারিয়ে যাই। এই বইটি এই উৎস সন্ধানকে নিয়েই লেখা হয়েছে।

মাঝে আমিও আমার ফ্যামিলি ট্রি নিয়ে অনেক কৌতুহলী হয়ে উঠেছিলাম। আমার বড় চাচার সিন্দুক থেকে আমার পাঁচ পুরুষের একটা ফ্যামিলি ট্রি আঁকা কাগজ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল। প্রায় দেড়শ বছর আগে সদূর পশ্চিম পাঞ্জাব থেকে এক উর্দু কবির ব্রিটিশ সরকার দ্বারা ঢাকায় নির্বাসিত হওয়া, এরপর পরিবারটির পুরান ঢাকার চুরিহাট্টায় নতুন করে জীবন শুরু করা, তারও প্রায় আশি বছর পর আমার দাদার ভাগ্য সন্ধানে নারায়নগঞ্জে চলে আসা, নিজের মত করে নতুন জায়গায় আরেকটি বংশের সূচনা করা…এই গল্পটি আমাকে খুব প্রভাবিত করেছিল সেই সময়। যদি কখনও সময় সুযোগ মিলে তাহলে এদের গল্পগুলো লিখে যাবার ইচ্ছে আছে।

অভিবাসনের সময় মানুষ প্রধানত যেই চিহ্নটি সবচেয়ে বেশী রেখে যায় সেটি হল তার জিন। আধুনিক বিজ্ঞানের সাহায্যে যেকোন্মানুষ বা প্রাণীর জিন সিকোয়েন্স এর মাধ্যমে আগাপাশতলা খুঁড়ে বের করা সম্ভব। মানুষের প্রবাহ ট্রেস করার চিহ্নগুলোর মধ্যে এই জিনের প্রবাহ খুবই সুনির্দিষ্ট – বাবা মা থেকে সন্তানের মধ্যে তা বইতে থাকে। এভাবেই অবশ্য প্রত্যেকে তার বাবা মা’র অসংখ্য আত্মীয়ের জিন অর্থাৎ দেহ ও মনে অনেক গুনাবলী বা বৈশিষ্ট্য লাভ করে। একটি নির্দিষ্ট পরিসরে এভাবেই গঠিত হয় একেকটি বিস্তৃত পরিবার বা গোষ্ঠী।

এই এক ধারার প্রবাহের মধ্যে কোন বাবা বা মা যদি বাইরের কোন গোষ্ঠী থেকে আসে, তাহলে তার গোষ্ঠীর ভাবগুলোও ঐ ধারায় ঢুকে পড়ে- জিন মিশ্রণ ঘটায়! সেই প্রবাহের মধ্যে তখন বৈচিত্র্য বাড়ে! আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রাকৃতিকভাবে কিছু জিনের মিউটেশনও হয়- এভাবেও প্রবাহের মধ্যে পরিবর্তন আসে ফলে কালক্রমে কিছু বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয়। সবার মধ্যে জিনের রক্ষনশীলতা বজায় রাখার অদ্ভুত এক চেষ্টা লক্ষ করা যায়- তাই এত হাজার হাজার বছর পরও মানুষের দেহ ও মন অনেকটা হুবুহু একই থাকে। আর এ কারণে জিনের চিহ্ন ধরে আমরা উৎসমুখে পৌঁছে যেতে পারি।

জেনেটিক্স যেহেতু পিওর সায়েন্স সেখানে মেমেটিক্সের বৈজ্ঞানিক কোন ভিত্তি নেই। বিখ্যাত অনুজীব বিজ্ঞানী রিচার্ড ডকিন্স সংস্কৃতি বা জীবনধারাকে একটু ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার জন্য জিন প্রবাহের আদলে এই চর্চার নাম দিয়েছেন মেমেটিক্স। জিন যেমন মানব বৈশিষ্ট্যের এক একটি ছোট কোড বা বার্তা বহন করে তেমনি জীবনধারার ছোট ছোট বৈশিষ্ট্যকে তিনি নাম দিয়েছেন মিম। মিমকে কালচারাল ইনফরমেশনের একটি ইউনিট হিসেবেও ধরা যায়। মিম শব্দটি তিনি নিয়েছিলেন গ্রীক শব্দ মিমেমা থেকে, যার অর্থ হল অনুকরণ করা জিনিস। বসবা মা থেকে জিন প্রবাহ সন্তানের মধ্যে যায় প্রজননের মাধ্যমে । আর মিম এক মানুষ থেকে অন্য মানুষের কাছে যায় অনুকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে।

জনপ্রিয় কোন গানের কথা ভাবা যাক। ধরুন মাইলস এর নীলা গানের কোন কলি একজনের মস্তিষ্কে যেভাবে ইম্প্যাক্ট ফেলে তার আনন্দ-উচ্ছাস দেখে এবং অনুকরণ করেই এটি অন্যজনের মস্তিষ্কেও ইম্প্যাক্ট ফেলতে পারে। এভাবেই জনে জনে এই মিমটির একটি প্রবাহ সৃষ্টি হয় যা কালকে অতিক্রম করতে পারে। জিন যেভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে যেতে পারে সেভাবে মিমও তা পারে নানা প্রজন্মের নানা কালের মানুষের মধ্যে চলে যেতে। এক্ষেত্রে এরিস্টটলের দার্শিনকতার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে যা একই সাথে স্থান আর কাল অতিক্রম করে প্রবাহিত হয়ে গেছে আর যেতেই থাকবে।

জিনের মধ্যে যেমন মিউটেশনের ফলে প্রকাশিত বৈশিষ্টে পরিবর্তন দেখা দেয়, মিমের ক্ষেত্রেও এমন ঘটতে পারে। যেমন পুরাতন কোন জনপ্রিয় গান আধুনিক সুর ও ইন্সট্রুমেন্ট দিয়ে রিমেক করে নতুন একটি রুপ দেয়া যায়। তখন জিনের মত মিমেরও একাধিক রুপ এক্সিস্ট করে। নেচেরাল সিলেকশনের কারণে একটি বিশেষ জিন যেভাবে অগ্রাধিকার পেয়ে কোন গোষ্ঠির মধ্যে ডমিনেট করতে পারে একইভাবে বিশেষ সুবিধার কারণে নির্দিষ্ট কোন মিমের রুপ বেশি জনপ্রিয় হয়ে বেশী মানুষের মধ্যে অনুকৃত হতে পারে। পরে হয়ত দেখা যেতে পারে মূল গানটির বদলে রিমেক করা গানটিই কালের বিচারে টিকে যাবে, মূল গানটি হারিয়ে যাবে একসময়। এভাবেই সংস্কৃতির একেকটি এক একটি দিক কোন জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশভাগের সময় পশ্চিমবঙে মাইগ্রেট করে যাওয়া প্রচন্ড ঝাল খেতে অভ্যস্ত বাঙালরা ঘটিদের দেখা দেখি তরকারিতে চিনি ব্যবহার করা জীবন ধারা প্রবাহ বা মেমেটিক্সের আরেকটি উদাহরণ হতে পারে।

শিকডে আলোচিত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চিহ্ন বা মার্কার হচ্ছে মানুষের ভাষা। কিন্তু আমার মতে এটি সবচেয়ে দুর্বল চিহ্ন। কারণটাও নিজেকে দিয়েই ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। আমার বাবার বংশের ভাষা হল ঢাকাইয়া, যা উর্দুর একটি উপভাষা। বাবা চাচা ফুপুরা নিজেদের মধ্যে এখনো এই ভাষাতেই কথা বলে। আমার বাবা চাচাদের আবার বিয়ে হয়েছে বাংলা ভাষী মেয়েদের সাথে। এই কারণে আমার বাবা যখন বলে ‘জী ঠো আচ্ছা লাগ রাহা নি’, তখন পাশে বসে থাকা আমি তাঁর যে শরীরটা ভালো লাগছে না সেটা বুঝে বাংলাতেই জিজ্ঞেস করি কোথায় খারাপ লাগতেসে? আমরা চাচাতো ভাইবোনরা বাপ চাচাদের কথা বুঝলেও, দরকার পড়লে সেই ভাষায় কথা বলতে পারলেও ন্যাচেরালি নারায়নগঞ্জের খাস বাংলা- খাইসি, গেসি, পড়সি…তেই কথা বলি। বাপ চাচার প্রজন্মের পর তাদের এই কথ্য ভাষাটি আমাদের মধ্যেই স্বহজাতভাবে আসেনি, পরের প্রজন্ম প্রজন্ম পর্যন্ত আসতে আসতে হয়ত এটি হারিয়েই যাবে। জেনেটিক্স বা মেমেটিক্সের মত ভাষার এই প্রবাহটি একইভাবে ফ্লো হতে পারেনি কিন্তু। আমার মত লেখক ও তার জন্মস্থান চট্টগ্রামের আঞ্চলিক চাটগাঁইয়া ভাষার অস্তিত্ব আর কতদিন টিকবে এই নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।

আমি খুব সরলভাবে বইটির বিষয়বস্তু নিজের মত বলার চেষ্টা করেছি। আদপে বইটির ক্যানভাস আরও বিশাল আর বিস্তৃত। বইটির প্রথম কয়েক পাতা পড়ে এটিকে কাঠখোট্টা বিজ্ঞান গবেষনামূলক প্রবন্ধ মনে হলেও পরবর্তীতে এটি বেশ সরস হয়ে যায়। আফ্রিকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত মানুষের মাইগ্রেশন নিয়ে সীমাবদ্ধ থাকার কথা থাকলেও লেখক আসলে অল্প অল্প করে পুরো পৃথিবীর গল্পই তুলে ধরেছেন। দক্ষিন আমেরিকার পেরু, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ থেকে আগত আর্য, ভারতের অনার্য, দ্রাবিড়, মোঙ্গল, চাইনিজ হান, আরাকান, বার্মিজ কাউকেই তিনি বাদ দেননি। এক লমেয়া টাইম লাইন জুড়ে সমাজ, ধর্ম, অর্থনীতি, সংস্কৃতির বিকাশ ও বিবর্তন নিয়ে মজার মজার ঘটনা ও গল্প লিখে গেছেন! চন্ডাল অশোকেড় ব্রাক্ষ্মী লিপির প্রবর্তন ও তা থ্রক্র ধাপে ধাপে আজকের বাংলা হরফ দিয়ে এই যে লেখাটি লিখছি এর পিছনে গল্পগুলোই তিনি লিখে গেছেন। এই বাংলা ভাষার বিবর্তনের অংশটি পড়তে গিয়ে আরেকটি মজার বইয়ের সন্ধান পাই, প্রীতম বসুর লেখা ‘পাঁচমুড়োর পঞ্চাননমঙ্গল’! ড্যান ব্রাউন আদলে লেখা এটি বাংলা ভাষার একটি থ্রিলার, যেখানে তাল পাতায় লেখা প্রাচীন পুঁথির স্মাগলিং নিয়ে উপন্যাস এগিয়ে গেছে। উপন্যাসটি ওভারঅল মাঝারি মানের হলেও এতে বাংলাভাষা আর হরফের বিবর্তনের যেই গল্পগুলো বলা হয়েছে সেগুলো খুবই আগ্রহ জাগানিয়া।

আফগানি, ইরানি, তুর্কি, মোগল, চাইনিজ, তিব্বতি, পর্তুগিজ , ওলন্দাজ, আরাকান, ইংরেজ, আরবদের আগমনে কিভাবে আজকের চট্টগ্রাম গড়ে উঠল এটাই বইটির ইউএসপি। দেশ বিদেশের অন্যান্য ঘটনাগুলো বোনাস। তবে পার্বত্যচট্টগ্রাম সম্পর্কে নতুন কিছু জানতে পারব এই আশা নিয়ে যেই বইটি ধরেছিলাম সেই আশাটি পূরণ হয়নি, তেমন কোন নতুন তথ্য এই বইটিতে নেই। একইসাথে এই বইটিতে বিবলোগ্রাফি খুব মিস করেছি! লেখক কোন কোন বই বা জার্নালগুলো পড়ে এই তথ্যগুলো এত চমৎকারভাবে সন্নিবেশিত করেছেন সেই সূত্রগুলো জানতে পারলে ভালো হত।

আরো কিছু লিখার ছিল! কিন্তু এখন আর পারছি না। আমার মনে হয় এই বইটি আমাদের সকলের পড়া উচিত। নিজের সম্পর্কে প্রশ্ন করার জন্য এমন বই খুব দরকার। কি কারণে এমন বইগুলোযে পাঠক্রমে যোগ করা হয় না কে জানে। কলেজ লেভেলে এই বইটি পড়তে পারলে কতই না চমৎকার হত। তবে এই বইটি যদি পরীক্ষা পাশের জন্য পড়তে হত তাহলে এতটা আগ্রহ নিয়ে পড়তাম বলে মনে হয় না। এটাই হয়ত আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার দুষ্টচক্র!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!